২৮ অক্টোবর শনিবার ঢাকা সমাবেশকে কেন্দ্র করে যে উচ্চতা বিএনপি তৈরি করতে পেরেছিল, সেটা এখন নেই। বলতে গেলে ২৮ ও ২৯ অক্টোবরের ঘটনাপ্রবাহ বিএনপিকে ‘রিসিভিং এন্ড’ বা ধাক্কা সামলানোর জায়গায় নিয়ে গেছে। বিএনপিকে উজ্জীবিত রাখার জন্য নিবেদিত ইউটিউবারদের ভাষায়—পুলিশ এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের ফাঁদে বা কৌশলের কাছে ধরা খেয়েছে দলটি। কিন্তু যেটাই হোক, বাস্তবতা হলো—উড়তে থাকা বিএনপি হঠাৎ করে কোণঠাসা অবস্থায় পড়েছে। এখন সরকার চেপে ধরেছে বিএনপিকে। দেশের ভেতর দলের প্রধান ব্যক্তি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বেশ কিছু কেন্দ্রীয় নেতা কারাগারে এবং বাকিরা দৌড়ের ওপর। এমন অবস্থায় শুধু হরতাল বা অবরোধের কর্মসূচি দিয়ে আগামী সরকারের আগুয়ান মনোভাবকে ঠেকানো যাবে বলে প্রতীয়মান হয় না। মার্কিন ভিসা নীতি, ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সরকারবিরোধী তীব্র অবস্থানের কারণে বিএনপির ভেতরে একটা বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ সলিলে ডুবেছে। আর সে কারণে ২৮ অক্টোবর দলের অক্টোবর-আন্দোলনের চূড়ান্ত সফলের দিন ভেবেছিল। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক, পিটিয়ে পুলিশ হত্যা, হাসপাতালে আগুন, মিডিয়ার ওপর আক্রমণ, প্রধান বিচারপতিসহ বিচারপতিদের বাসায় হামলা, বাসে আগুনের মতো বেলাগাম হিংস্রতা নতুন করে দলের পুরোনো চেহারা মানুষের সামনে নিয়ে এসেছে। প্রশ্ন হলো, এগুলো করা ছাড়া বিএনপির সামনে কি আর কোনো রাস্তা ছিল না? বিএনপি এক প্রকার মার্কিন ঘোরে ভুগছে। নয়তো যেদিন কর্মীরা মাঠে লড়াই করেছে, সেদিনই দলের কার্যালয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এক ভুয়া উপদেষ্টাকে হাজির করতে পারে? মিয়া জাহিদুল ইসলাম আরেফিকে নিয়ে এসেছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা লে. জে. হাসান সারওয়ার্দী আর তাকে সাদরে বরণ করেছেন কেন্দ্রীয় নেতা রুহুল কবির রিজভী আহমেদ এবং সেই ভুয়া উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনে পাশে বসেছিলেন দলের আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য ইশরাক হোসেন। জো বাইডেনের কথিত এ উপদেষ্টা এখন পুলিশের হাতে বন্দি। এ অবস্থায় তিনি যা বলেছেন তা বড় আলোচনার জন্ম দিয়েছে। গোয়েন্দাদের তিনি বলেছেন, বিএনপির পার্টি অফিসে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী, বিএনপির নেতা অ্যাডভোকেট বেলাল ও ইশরাক হোসেন তাকে বাইডেনের উপদেষ্টা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যা আসলে সত্য নয়। তারা (বিএনপি) মিথ্যাভাবে আরেফীকে উপস্থাপন করেছে। বলেছে, “তারা বাসা থেকে আসার সময় শিখিয়েছে যে, আপনি (আরেফি) বলবেন—‘র্যাবকে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিতে সহায়তা করেছি। এখন পুলিশ, আনসার, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীকেও এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে’।” বিএনপি নেতারা মনে করেছেন, এ কথাগুলো বললে বাংলাদেশের পুলিশ কর্মকর্তারা চুপসে যাবে। একটা দল কতটা পরনির্ভর হতে পারে, তার প্রমাণ এই মিয়া আরেফি কাহিনি। বিএনপি এখন সর্বাত্মক সহিংসতার পথ নিয়েছে। হরতালের পর টানা অবরোধ করছে। বলছে, এটা ছাড়া পথ ছিল না কোনো। কিন্তু এটি রাজনীতিতে যতখানি, তার চেয়েও বেশি অর্থনীতিতে প্রভাব রাখছে। সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ কদিনে যে বিষয়টা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে, সেটি হলো—প্রথমত নির্বাচন বর্তমান সংবিধানের অধীনেই হবে। গত মঙ্গলবার গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকার ছোট না করার ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, ‘আমরাই নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে সরকারি রুটিন কাজ করব।’ আন্দোলন করে নির্বাচন থামাতে পারবে না মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘নির্বাচন যথাসময়ে হবে।’ সেটা বুঝতে পেরে বিএনপির এ সময়ের অবতার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস মঙ্গলবার সকাল সকাল ছুটে গেছেন নির্বাচন কমিশনে, দেখা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে। পিটার হাস বুঝেছেন যে, এই মুহূর্তে নির্বাচন ছাড়া গতি নেই। নির্বাচন নির্ধারিত সময় ও নির্ধারিত পদ্ধতিতে হবে বলে স্পষ্ট জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। পিটার হাস নির্বাচনের অনুকূল-প্রতিকূল পরিবেশ নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছেন। তবে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, তারা সবসময় চান নির্বাচনের জন্য অনুকূল পরিবেশ হোক। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশ হলে নির্বাচন হবে না, এমন ভুল বোঝাবুঝি যেন মানুষের মধ্যে না থাকে। অবস্থা বুঝতে পেরে পিটার হাস বিবাদমান দলগুলোর মধ্যে শর্তহীন সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি আশা করেন, বাংলাদেশে উদ্বেগ প্রশমন এবং একটি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথ খুঁজতে সব পক্ষ শর্তহীন সংলাপে বসবে। তাহলে একটা বিষয় পরিষ্কার হলো যে, ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে নির্বাচন। সেটা বিএনপি যেমন বুঝছে, তার চেয়েও বেশি অনুধাবন করছেন পিটার হাস। সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনকালে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, যাতে আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন হয়। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রক্রিয়া ভোট গ্রহণের বেশ আগে থেকেই শুরু হয়। অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে সরকার, রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ভোটার, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব রয়েছে। আগামী নির্বাচন বিএনপির কাছে এখন আর কোনো কৌতূহল নয়, বাস্তবতা। তবে মানুষের কাছে বর্তমান পরিস্থিতি যেন এক উদ্বেগ। বিএনপির সংবেদনশীল নেতৃত্বের মতো পিটার হাসও নির্বোধ নন। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ অবলোকন করে হয়তো তারা বুঝতে পেরেছে যে, সরকারি অবস্থানকে এতদিন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সস্তা কৌশলে উড়িয়ে দেওয়া গেলেও, এখন আর যাচ্ছে না। শাসকের কণ্ঠস্বর প্রমাণ করে প্রাথমিক কাজে সে সফল। এ সাফল্য মূল্যবান, কারণ তার দাপটে পর্যুদস্ত তার প্রধান প্রতিপক্ষ।
অতঃপর? বিরোধীদের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে দুটি বিষয়ে কিছু সংকেত মিলেছে। এক, জনসংযোগ; দুই, নির্বাচনী প্রস্তুতি। দেশজুড়ে মানুষের কাছে একটি বার্তা পৌঁছে দেওয়া যে দ্রব্যমূল্যসহ নানা কারণে মানুষ ভালো নেই, তাই সর্বত্র যথাসম্ভব সভা-সমাবেশ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের আয়োজন এবং অন্যদিকে শরিক দলগুলোর রাজনৈতিক বার্তার মধ্যে সমন্বয় রেখে নির্বাচনের পথে চলার বন্দোবস্ত। এ কথা মানতেই হবে যে, এ দেশের নির্বাচনী রাজনীতিকে নিজের মতো করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ ও ’১৮-এ দুটি নির্বাচন নিজের মতো করে করতে পেরে তার আস্থা অকল্পিতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে। এ বাস্তবকে অস্বীকার করে গণতান্ত্রিক প্রতিস্পর্ধা গড়ে তুলতে পারছে না বিএনপি। নিজেদের বার্তাকে মানুষের মধ্যে প্রচারের পরিসরে প্রবলভাবে হাজির করা বিরোধী রাজনীতির এক বড় কাজ। রথী-মহারথী থাকবে, বিদেশিরা আছে এবং সেটা জরুরি, কিন্তু যথেষ্ট নয়। কাজটা করতে হবে বাস্তবের কঠিন জমিতে। তাকে নির্বাচনই করতে হবে এবং বলে রাখা দরকার যে, দলের ভেতর থেকেই বাধাবিপত্তি বিস্তর। বিএনপি নিজের ভেতরে রসায়ন আছে। আছে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকরা। এরা সবাই পরস্পরের প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী। এটা অস্বীকার করা বা সরিয়ে রাখা সম্ভব নয়। লক্ষণীয়, এ বাস্তবকে স্বীকার করে নিয়েই যতদূর সম্ভব একসঙ্গে লড়াই করার কথা বলে আসছে বিএনপিসহ ৩০ দল। রাজনীতি সম্ভাব্যতার শিল্প, বিএনপিসহ বিরোধীদের সামনে এখন সেই শিল্প নির্মাণের এক বড় পরীক্ষা। অগ্নিপরীক্ষা বললে অত্যুক্তি হয় না। নিজেদের যদি বিকল্প শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হয়, তবে তার এক এবং একমাত্র ভিত্তি হতে পারে কৌশল। বিরোধীদের অহিংস গণতান্ত্রিকতার প্রমাণ দিতে হবে, কথায় নয়, কাজে এবং লড়াই করে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন