সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ০২:৪৯ এএম
আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ০৯:৩১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সংলাপ হোক, ভোট হোক

সংলাপ হোক, ভোট হোক

আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে সহিংসতার যে বিশদ বিবরণ প্রতিদিনই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, তার একটা বৈশিষ্ট্য খেয়াল না করে উপায় নেই। শাসক দলের প্রতি বিরোধীদের সব ক্ষোভ গিয়ে পড়ছে দরিদ্র মানুষের ওপর। তাদের বাস পুড়ছে, তাদের মুরগির খাঁচা পুড়ছে, তাদের আয়ের পথ বন্ধ হচ্ছে এবং তারাই আগুনে পুড়ে হাসপাতালে কাতড়াচ্ছে।

তবে গোড়াতেই এ কথাটা বলে নেওয়া ভালো যে, বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং সাধারণ মানুষ এমন কোনো রাজনৈতিক দল পায়নি, যারা শুধু তাদের কথাই বলেছে বা ভেবেছে। ফলে সবসময়ই তারা ভিকটিম এবং এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। যে মানুষগুলো আজ এ সহিংস অবস্থার শিকার তারা নির্বাচন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ততখানি মাথা ঘামায় না, যতখানি চিন্তা করে চাকরি বা পরিবারের ভাত-কাপড়ের সংস্থানের নিরাপত্তা নিয়ে। আজ রাজনীতি সেটাই কেড়ে নিচ্ছে প্রতিদিন।

একটা চাপা উদ্বেগ সবখানে। সবাই শঙ্কিত কখন কী হয়? তবুও ভোট আসে, ভোট হয়। পাঁচ বছর পর আবারও ভোটের হাওয়া বইতে শুরু করেছে বাংলাদেশে। তবে এ হাওয়া মৃদুমন্দ ফাল্গুনের হাওয়া নয়, আগুনে ঝলসে দেওয়ার মতো বিধ্বংসী।

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশিদের চেয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্রের হাহাকার বেশি এবং দেশটির সরকার প্রতিনিয়তই নানা খবর সৃষ্টি করছে বাংলাদেশ নিয়ে। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার ঠিক আগমুহূর্তে সংলাপের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিঠি এসেছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টিকে লেখা সেই চিঠিতে আদেশ করা হয়েছে শর্তহীন সংলাপে বসতে। যুক্তরাষ্ট্র বারবারই তার ভিসা নীতির কথা মনে করিয়ে দিতে ভুলছে না। শর্তহীন সংলাপের কথা আওয়ামী লীগ এর আগে বলেছিল, কিন্তু সেটা বিএনপি প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল, আগে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে। অন্যদিকে শাসক দল হিসেবে আওয়ামী লীগও অনড় তার অবস্থানে যে, সংবিধান মোতাবেক বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। ঠিক এ অবস্থায় শর্তহীন সংলাপ কীভাবে হবে তাহলে সেটাই এখন আলোচনা।

সংলাপের আলোচনা চলছে, ভোটের হাওয়া বইছে। একেক সময় একেক কথা বলা জাতীয় পার্টির প্রধান জি এম কাদের এর মধ্যেই মঙ্গলবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করেছেন। দৈনিক কালবেলা জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর চিঠির পর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে এ সংলাপের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় পার্টি। পত্রিকাটি এও বলছে যে, বেশ কিছুদিন ধরে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে নানা বক্তব্য দিলেও শেষ পর্যন্ত বিদ্যমান পরিস্থিতিতেই নির্বাচনে যাচ্ছে জাতীয় পার্টি। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নাকি পৃথক অবস্থানে থেকে নির্বাচনে যাবে, সে বিষয়ে দলটির নীতিনির্ধারকরা এখনো দ্বিধাবিভক্ত।

জাতীয় পার্টি নির্বাচনে আসছে, ওদিকে তৃণমূল বিএনপি নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় হয়েছে, অনেক বিএনপি নেতা স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে আগ্রহী। মাঠের এমন বাস্তবতায় ভোট হোক, সংলাপ হোক—পরিবেশটিই সবার কাছে কাম্য হয়ে উঠেছে।

গত ২৮ অক্টোবর সরকার পতনের আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণার দিনটি সহিংসতায় পণ্ড হওয়ার পর বিএনপি এবং তার কিছু মিত্র প্রথম হরতাল করেছে এক দিন এবং এখন এক বা দুদিন বিরতি দিয়ে দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। চোরাগোপ্তা হামলা করে গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত গাড়িতে আগুন লাগানো ছাড়া আর কিছু করতে পারছে না দলটি। সরকার চরম হার্ডলাইনে গিয়ে কেন্দ্রীয় ও প্রান্তিক সব পর্যায়ের নেতাদের গ্রেপ্তার করছে, মামলা দিচ্ছে এবং কর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

আন্দোলনের বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বোঝা যাচ্ছে যে, বিএনপি নেতারা পরিস্থিতি অনুযায়ী আন্দোলনে মানুষকে সম্পৃক্ত করতে না পেরে পুরোনো চেনা ছকে হাঁটছে। সেই অবরোধ, সেই পেট্রোল বোমা, সেই আগুন—এর বাইরে আর কিছু নয়। একটা প্রশ্ন এখন সবখানে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিএনপি নেতৃত্ব কি কোনো কারণে বিভ্রান্ত হয়েছে? ক্ষমতায় যেতে মরিয়া বিএনপি নেতাকর্মীরা অনেক বেশি প্রভাবিত হয়েছে দেশের বাইরে থাকা কিছু ফেসবুকার আর ইউটিউবার দ্বারা। এরা প্রায় প্রতিদিন স্বপ্ন দেখিয়ে এসেছে যে, শেখ হাসিনা আজকে নেই, কালকে নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শেখ হাসিনার সরকার নিজের অবস্থান আরও সংহত করেছে। বিএনপি দ্বিতীয়বার বিভ্রান্ত হয়েছে বিদেশিদের তৎপরতায়। ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের তৎপরতা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নানা বিবৃতি, ব্রিটিশ হাইকমিশনারের তৎপরতা, জাতিসংঘ থেকেও কিছু পর্যবেক্ষণ এবং অতি অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ভিসা নীতি বিএনপির ভেতর একটা আস্থা সৃষ্টি করেছিল যে, সরকার নির্বাচন করতে পারবে না, তাকে চলে যেতে হবে।

এ দুটি বিষয় অতি বেশি আত্মবিশ্বাসী করে ফেলেছিল বিএনপিকে, বিশেষ করে দলের কিছু নেতাকে। কিছু কিছু নেতা-নেত্রী নিজেরাও রাজনীতির মাঠের চাইতে হঠাৎ করে ভিউতে আসক্ত হয়ে অতিমাত্রায় সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দূরে বসে সামাজিক মাধ্যমের কনটেন্ট আর রাজনীতির বাস্তবতা এক নয়। এ কথা ঠিক যে, এ মানুষগুলো বিএনপির পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়তে সহায়তা করেছেন এবং বিএনপিপন্থি সাংবাদিক মুশফিক ফজল আনসারি নিয়মিতভাবে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি তুলে যুক্তরাষ্ট্রকে জড়িতও করতে পেরেছেন সফলভাবে।

কিন্তু বাংলাদেশের গণআন্দোলনের দীর্ঘদিনের ইতিহাস বলে, আন্দোলন শুধু করলেই হয় না, বড় বড় সমাবেশও সবকিছু নয়। মাঠে সক্রিয় নেতা লাগে এবং সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করতে হয়। সেটা না করে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়, কারণ সরকার তখন মরিয়া হয়ে ওঠে। হয়েছেও তাই। এবার বিএনপি সরকারের কঠোর অবস্থানের সামনে কোণঠাসা হয়েছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমা শক্তি। তাদের অর্থনৈতিক এজেন্ডা আর রাজনৈতিক বক্তব্য সবসময় এক পথে চলে না। যুক্তরাষ্ট্র অনেক কথা বলছে, যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে সরকারের বিরুদ্ধেই যাচ্ছে। কিন্তু নিজের স্বার্থ আদায়ের পথ সৃষ্টি হলে যুক্তরাষ্ট্র রাজনীতির পথটা বড় করে দেখতে নাও চাইতে পারে।

মনে রাখা দরকার যে, কূটনৈতিক সক্ষমতা আওয়ামী লীগেরও আছে। যুক্তরাষ্ট্র সারা পৃথিবীতে শক্তিশালী দেশ। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তার মতো করে সবকিছু দেখতে চায়। বাংলাদেশের বেলায়ও বিষয়টি তেমনি। সম্প্রতি ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে আলোচনায় উঠেছিল বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গ। ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ নিয়ে নিজের চিন্তাভাবনার কথা আরেকবার যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দিয়েছে ভারত। কেউ কেউ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত দুই দেশই বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে সমর্থন করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের বিকাশকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইস্যু বানাতে চায় আর এ বিষয়টি নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের মতপার্থক্য। ভারত বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে শুধু একটি নির্বাচন হিসেবে দেখে না, দেখে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জায়গা থেকে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চাপে রেখেছে। গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা দেওয়া বাংলাদেশিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার নীতি নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে ভারত পরিষ্কার করেছে যে, বাংলাদেশে অন্য কোনো দেশের হস্তক্ষেপ চায় না। বলতে হয় যে, কূটনীতির মাধ্যমে অবস্থা কিছুটা হলেও পাল্টে দিতে পেরেছে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির সঙ্গে গত কয়েক বছরে অনেক জোরালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। মোদি সরকার সেটা ধরে রাখতে চায়।

বাস্তবতা অনেক কঠিন। রাজনৈতিকভাবে ধীর ধীরে আওয়ামী লীগকে দুর্বল করতে পারেনি বিরোধী দলগুলো। দাবি না মানলে নির্বাচন শুধু বর্জনই নয়, প্রতিহত করার ডাক দিয়ে রেখেছে বিএনপি। কিন্তু এখন সংলাপের তাড়া এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আমরাও মনে করি সংলাপ হোক। সবকিছু চেনা কাঠামোয় চলে না। সরকার নির্বাচন করছে এবং বোঝা যাচ্ছে নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনটা কতটা অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ করা যায়, সেটাই সব অংশীজনের ভাবনা।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জাতিসংঘের প্রতিবেদন নিয়ে নির্দেশনা দিলেন হাইকোর্ট

ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট পেপারে প্রার্থীদের ছবি যুক্তের দাবি ছাত্র অধিকার পরিষদের

ভারতের জন্য আকাশসীমা বন্ধের মেয়াদ আরও বাড়াল পাকিস্তান

র‌্যাঙ্কিংয়ে উধাও রোহিত-কোহলির নাম, কারণ জানাল আইসিসি

রাজসাক্ষী হতে চান পুলিশ সদস্য শেখ আফজালুল

ভাঙন ভাঙন খেলায় দিশেহারা নদীপাড়ের মানুষ

চালককে ওয়াশরুমে রেখে প্রাইভেটকার নিয়ে ছুটছিলেন তিন বন্ধু

নথি গায়েব করে ১৪৬ কোটি টাকার কর ফাঁকি / কর কমিশনার মো. মুস্তাকসহ ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করছে দুদক

‎আশাশুনি সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের স্থায়ী ভবন নির্মাণে জরুরি আলোচনাসভা

দেবের প্রশংসায় ইধিকা

১০

গ্যাসের ব্যথা ভেবে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ নিয়ে ঘুরছেন না তো?

১১

ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ

১২

বয়স ৪০ হলেও চাকরির সুযোগ, আবেদন করুন আজই

১৩

জ্বালানি তেলের দাম কমবে কবে

১৪

ভুল করে বাসের ভাড়া না দিলে কী করবেন? যা বলছেন আলেমরা

১৫

যেসব এলাকায় বেশি সক্রিয় বৃষ্টিবলয় স্পিড

১৬

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা : আপিলের রায় ৪ সেপ্টেম্বর

১৭

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ

১৮

ভিসা ইস্যু করা নিয়ে যে তথ্য জানাল যুক্তরাষ্ট্র

১৯

খাগড়াছড়িতে মা ও মেয়েকে গলা কেটে হত্যা

২০
X