

খুব বেশি সময় আগের নয়। এইতো সেদিন বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ফ্যাসিবাদী অপশাসনের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল সম্মিলিত প্রতিরোধ-ঐক্য। সাকুল্যে অতিক্রম হয়েছে ১৫ মাস। একটি ন্যায় ও সাম্যভিত্তিক দেশ গড়তে কাঁধে কাঁধ বুকে বুক মিলিয়ে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ঘটিয়েছিল সশস্ত্র বাহিনী-ছাত্র-জনতার সুদৃঢ় ঐক্য।
আন্দোলনকারীদের বুকে গুলি না চালানোর জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতীক সামরিক বাহিনীর ঐতিহাসিক এক সিদ্ধান্তই ঘুরিয়ে দিয়েছিল ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মোড়। জনতার কাতারে এসে ত্বরান্বিত করেছিল জনগণের চূড়ান্ত বিজয়কে। ইতিহাসের ঐশ্বর্যে অনিন্দ্য অনন্য স্মৃতির মণিকাঞ্চন এখনো ঔজ্জ্বল্য ছড়ায়। আপ্লুত করে কপালে লাল-সবুজের পতাকা বাঁধা সেদিনের তরুণ-যুবা, মসজিদের ইমাম, পাড়ার সবজি বিক্রেতা বা সাধারণ চায়ের দোকানিকেও। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাসে এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য; আদিগন্ত সূর্যের মতোই অতিশয় দীপ্তিমান। সামরিক বাহিনী-ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় ঐক্যের স্বর্ণযুগের ওই মুহূর্ত আজও শাশ্বত আলোকাভাসে জাগিয়ে তুলে সত্যান্বেষী সাধারণের অপরাজেয় বোধ-বিশ্বাসকে।
যে কেউ স্বীকার করতে বাধ্য দেশপ্রেমী সশস্ত্র বাহিনী ও ছাত্র-জনতার মধ্যকার মৈত্রীর এই দৃঢ় বন্ধনই সার্থক উপসংহারে পৌঁছে দিয়েছিল চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানকে। কিন্তু প্রায় সময়েই দেখা যাচ্ছে সবকিছু ভুলে যাওয়ার অস্বাভাবিকতা থেকে অভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন সামরিক বাহিনীকে নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে থেকে কুৎসিত, হিংস্র, ভয়ংকর, সর্বৈব ও আগ্রাসী মিথ্যাচার। অপতথ্যের তাণ্ডবের মধ্যেও স্মৃতির আকাশপ্রদীপ জ্বেলে রেখে মানবিক ও দায়িত্বশীলতার ছন্দে টেকসই গণতন্ত্রের কার্যকর শক্তির প্রতীক হিসেবে নিজেদের প্রতিভাত করে চলেছেন ভূখণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষার এই কারিগররা। ১৫ মাস আগেও তারা যেমন প্রমাণ করেছিল তাদের দেশপ্রেম কোনো রাজনৈতিক শক্তির প্রতি অন্ধ আনুগত্য নয়। তেমনি পটপরিবর্তনের পরেও একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতির সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঢাল হয়েই নিরঙ্কুশ সমর্থনের মাধ্যমে সরকারের পাশে থেকেছেন।
একটি দেশের স্থিতিশীলতার প্রশ্নে সামরিক বাহিনী কতটুকু বলীয়ান সেই উদাহরণও স্থাপন করেছে প্রতিক্ষণ। সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বের সততা আর দেশপ্রেম আক্ষরিক অর্থেই এমন সব দুঃসাধ্য কাজ বাস্তবায়নে বড় টোটকা হিসেবে সফলতা এনে দিয়েছে। নির্বাচনমুখী যাত্রায় তারা ঠেকিয়ে দিয়েছে, দিচ্ছে স্বার্থলোভী গোষ্ঠীর গণতন্ত্রের অভিযাত্রা বানচালের দুরভিসন্ধিও। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়েও সশস্ত্র বাহিনী মেরুদণ্ড সোজা করে দায়িত্ব পালন না করলে পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হতে পারত। এই সময়টিতে নিজেদের উচ্চকিত মানবিক মূল্যবোধে সহানুভূতিশীলতাপূর্ণ সামাজিক সম্প্রীতি গড়তে সহমর্মিতার মাধ্যমে দায়িত্ব-কর্তব্যের মেলবন্ধনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছেন তারা।
দুনিয়া কাঁপানো চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশকে বদলে দেওয়ার এক অভূতপূর্ব সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল। ভবিষ্যতের রাজনীতির বাঁকবদলের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের অংশীজনদের মধ্যে এখন বিরোধ-অনৈক্য মাথাচাড়া দিচ্ছে। ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত ও দলীয় ক্ষমতা এবং অন্যান্য স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্য থেকে এই বিভেদচর্চা প্রকট আকার নিয়েছে। নিত্যদিন ব্যাপক কূটক্যাচাল চলছে রাজনীতির সদরে-অন্দরে। অভ্যুত্থানের পর নতুন শত্রু, গুপ্ত শত্রু ও নতুন মিত্রের সন্ধান চলছে। পরিণামে তৈরি হচ্ছে গণকলহ ও অস্থিরতা। গণভোটসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দলগুলো মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি। ছাত্র-জনতার রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই অভ্যুত্থানের পক্ষের জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বরবাদ হচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর কাদা-ছোড়াছুড়িতে ‘বিরক্ত’ ও ‘দুর্বিষহ’ অবস্থায় ক্ষোভ থেকেই সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রায় ৯ মাস আগে ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ উপলক্ষে মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সব পক্ষকে আগাম সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘নিজেরা কাদা-ছোড়াছুড়ি, মারামারি ও কাটাকাটি করলে দেশ ও জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। এই দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে অক্ষুণ্ন রাখতে হলে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
সময় গড়াতেই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে অপরিহার্য জাতীয় ঐক্যের বদলে নানা ঘটনা-ঘনঘটায় পারস্পরিক বাগ্যুদ্ধ ও বিভাজন আরও বিস্তৃত হয় সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের তকমার রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রতত্ত্বের মধ্য দিয়ে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের বদলে ব্যাটল ফিল্ড তৈরির সব রকমের কূটকৌশল এখন দৃশ্যমান। যদিও ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দেশের সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়লেও উচ্চ পেশাদারিত্ব, দেশপ্রেম, সততা ও অটুট মনোবল নিয়ে স্বমহিমায় টিকে রয়েছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে অলীক স্বপ্নে বিভোর ইউটোবিয়ান ও সো কলড রাজনীতিকরা তাদের টার্গেট করে অটল মনোবলে চিড় ধরাতে বাহিনীপ্রধানদের চরিত্রহননের অপপ্রয়াস অব্যাহত রেখেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই অসীম ধৈর্য ও পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে বিচক্ষণতার সঙ্গেই দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন।
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে গুজববাজরা স্পর্শকাতর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই ও এনএসআইকেও নানা কূটকৌশলে লক্ষ্যবস্তু করেছে। কিন্তু ‘সবার আগে দেশ’ এই নীতিতে বিশ্বাসী গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি গোয়েন্দা সংস্থা কোনো ফাঁদে পা না দিয়ে জনআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। দেশপ্রেমী সশস্ত্র বাহিনী কয়েক দফায় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে সংকটময় সময়টিতেও অন্তরাত্মার ডাকে সাড়া দিয়েই কাজ করে চলেছে অহর্নিশ। সম্প্রতি সেনা সদরে এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের (আর্টডক) জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাইনুর রহমান বলেছেন, ‘সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য সেনাপ্রধান এবং সেনাবাহিনীর সিনিয়র লিডারশিপের প্রতি শতভাগ অনুগত ও বিশ্বস্ত রয়েছে।’
রাজনীতির মাঠে বিভেদ অনৈক্যের সুর চরমে। এরই মধ্যে ভোটের রাজনীতির সব রকমের হিসাব-নিকাশও চলছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘোষিত আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসছে দেশের জনগণও ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছে। পুরোপুরি নির্বাচনী হাওয়া বইছে দেশে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে নির্বাচনী বিশাল ময়দান। এখনো পুলিশ পুরোদমে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। তারা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছে নিজেদের সক্ষমতার দৃষ্টান্ত স্থাপনে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভীষণ গোলমেলে। প্রতিকূলতা বাড়াচ্ছে উৎকণ্ঠা।
নির্বাচনকালীন সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক অবস্থায় রাখতে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে আইনের জালে সশস্ত্র বাহিনীকে সুকৌশলে ভোটের মাঠে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল পতিত সরকার। কিন্তু এবার নির্বাচন কমিশন নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থা’র সংজ্ঞায় ‘সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনী’ যুক্ত করার প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে। আইনে এটি যুক্ত হলে তিন বাহিনীকে নির্বাচনী দায়িত্ব দিতে আলাদা কোনো আদেশের প্রয়োজন হবে না। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিচারিক বা ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ দায়িত্ব পালন করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে সশস্ত্র বাহিনীও।
প্রধান উপদেষ্টা তার সর্বশেষ জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা ব্যক্ত করেছেন। সেই মোতাবেক ডিসেম্বরের প্রথমদিকে তপশিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। সেই লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রচারণা বিভিন্ন জায়গায় শুরু করেছে। নির্বাচনে প্রায় এক লাখ সেনাবাহিনীর সদস্যসহ বিভিন্ন সংস্থার আরও কয়েক লাখ নিরাপত্তা কর্মী নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করার জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। সরকার, সশস্ত্র বাহিনী এবং জনতার একটাই লক্ষ্য অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।
চলতি বছরের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে সশস্ত্র বাহিনী থেকে এমন প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে। এর সপক্ষে সশস্ত্র বাহিনীর যুক্তি হচ্ছে- বিচারিক ক্ষমতাসহ মাঠে থাকলে যে কোনো পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব। এতে সহজেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রয়োজনে সামরিক বাহিনীকে ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ডাকলে যাতে সাড়া দিতে পারেন; এজন্য আইন, বিধিমালা ও পরিপত্রে সেই বিধান যুক্তের প্রস্তাবও করেছেন তারা।
এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হলেও দেশের সাধারণ মানুষ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে এমন ভূমিকাতেই দেখতে চায়। তারা বিশ্বাস করেন সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষেই একটি রক্তপাতমুক্ত ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। আর্টডক জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাইনুর রহমান ইতোমধ্যেই বলেছেন, ‘সরকার যেভাবে নির্বাচনের রূপরেখা প্রণয়ন করেছে সেই রূপরেখা অনুযায়ী একটি অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। সেই রূপরেখার মধ্যে সময়সীমা দেওয়া আছে। আমরা আশা করি, নির্বাচন হলে দেশের স্থিতিশীলতা আরও ভালো হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। তখন সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যেতে পারবে। আমরা সেই দিকে তাকিয়ে আছি।’
দেশপ্রেমী বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক অনন্তকালের, চিরায়ত ভ্রাতৃত্বের। কঠিন সব বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে জনগণের ভালোবাসা ও একাত্মতায় অনির্বাণ বাংলায় সামরিক বাহিনী-জনতা গেঁথেছেন সেই মর্মস্পর্শী সুর- ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি’। দেশের আপামর জনসাধারণের মধ্যে তাদের ঐক্য, মৈত্রী, সামাজিক সংহতি ও শান্তি-সম্প্রীতির দীপ্তিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন পরতে পরতে। দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস আর হৃদয়ানুভূতিতে উচ্চারিত ‘সবার আগে দেশ।’ সুন্দর আগামীর পথ নকশা প্রস্তুতে অটল-অবিচল ও শক্তিশালী থাকুক সশস্ত্র বাহিনী ও জনতার ঐক্যের ভিত।
মন্তব্য করুন