ঢাকায় হয়ে গেল বিদেশি বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) ৬০ বছরপূর্তি উদযাপন ও দুদিনব্যাপী বিনিয়োগ মেলা। ফরেন চেম্বারের এই অনুষ্ঠানে রথী-মহারথীরা অর্থনীতি, বিনিয়োগসহ সামগ্রিক অর্থনীতি যত উচ্চমার্গীয় কথাই বলেন না কেন, একজন সাধারণ ব্যবসায়ীর এক সাধারণ বাক্যই ব্যবসার বড় আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
আমরা এলসি খুলতে পারছি না—এই একটি বাক্য বদলে দিয়েছিল অনুষ্ঠানের মুড। যদিও প্রধান অতিথি, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া তার মতো করে জবাব দিয়েছেন এ প্রশ্নের। বলেছেন, প্রথমে কভিড-১৯ ও পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কয়েক বছরে বৈশ্বিক অর্থনীতি নানা চড়াই-উতরাই পার করছে। যুদ্ধের কারণে সাত থেকে আটটি পণ্যে অন্তত ১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার বেশি ব্যয় করতে হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সারের দাম বাড়া, জ্বালানি তেল ও গ্যাসে ভর্তুকির দৃষ্টান্তও দেন তিনি।
সরকারের জায়গা থেকে মুখ্য সচিব জবাব দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ব্যবসায়ীরা কঠিন সময় পার করছেন। ব্যবসা জগতে কান পাতলেই এখন এ কথা শোনা যায় যে—এলসি খোলা যাচ্ছে না, কারণ ডলার সংকট। বলতে গেলে চিত্রটা পুরোই বদলে গেছে। কিছুদিন আগেও যেখানে ব্যাংক কর্মকর্তারা বিভিন্ন করপোরেট হাউসে ছুটতেন এলসি খোলার অফার নিয়ে, সেখানে এখন ব্যবসা চালু রাখতে ব্যাংক নির্বাহীদের পেছনে ছুটছেন উদ্যোক্তারা।
এলসি বিড়ম্বনা এখন শুধু ছোট বা মাঝারি উদ্যোক্তাদের সমস্যা নয়, বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানেরও। শতভাগ মার্জিন বা বাইরে থেকে ডলার কিনে আমদানি ঠিক রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা। বহুদিন ধরে চলা ডলার সংকট সাম্প্রতিককালে আরও তীব্র হয়েছে। একটার সঙ্গে একটা সমস্যা সৃষ্টি হয়ে পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে। প্রথমে ডলার সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করা শুরু করে। এতে আবার রিজার্ভে টান পড়ে। তা সামাল দিতে গত অর্থবছরের শুরু থেকে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে সরকার। বিভিন্ন পণ্যের এলসি খোলা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এতে আমদানিতে প্রভাব দেখা দেয়। একপর্যায়ে গত বছরের অক্টোবর থেকে আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে পড়ে। এর পর থেকে ক্রমাগতভাবে কমছে এলসি খোলার প্রবৃদ্ধি। ফলে শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ নিত্যপণ্য আমদানি হ্রাস পায়, যার কারণে দেশে নিত্যপণ্যের দাম হুহু করে বাড়তে থাকে এবং এই মূল্যস্ফীতি দীর্ঘ সময় ধরে অব্যাহত। এ ছাড়া এলসি খুলতে না পারায় দেশের বিভিন্ন বন্দর দিয়েও আমদানি-বাণিজ্য কমে গেছে। আমদানি কম হওয়ায় বিভিন্ন কাস্টম হাউসে রাজস্ব আদায়ে ধস নেমেছে।
গত অর্থবছরের শেষ দিক থেকে ডলারের সংকট তীব্র হতে থাকে। তখন থেকেই এলসি খোলার আবেদন প্রত্যাখ্যান হতে থাকে একটু একটু করে। এর মধ্যে দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও ডলার সংকট নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক, যার প্রভাবে চলতি অর্থবছরের আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ধারায় রয়েছে। চাহিদামতো এলসি খুলতে না পেরে এখন শিল্প কাঁচামাল, নিত্যপণ্য ও মূলধনি যন্ত্রপাতির মতো অত্যাবশ্যকীয় আমদানিও কমিয়ে দিয়েছেন অনেক উদ্যোক্তা। অনেক প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে বা কোনো রকমে চলছে।
মূলধনি যন্ত্র ও কাঁচামাল দুটিরই আমদানি কমে গেছে। আবার উৎপাদনের যে সক্ষমতা আছে, গ্যাস-সংকটের কারণে তা-ও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। তাহলে বলতেই হচ্ছে যে, অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশেষ করে সাম্প্রতিককালের হরতাল, অবরোধ আর সহিংসতায় অর্থনীতির আরও ক্ষতি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড—কোনো জায়গা থেকেই সেভাবে কোনো কথা বলা হচ্ছে না, কখন বা কবে এই ডলার সংকটের অবসান হবে বা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। একদম শুরুতে নীতিনির্ধারকরা হয়তো মনে করেছিলেন, ডলারের সংকট এবং এর দাম বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা সাময়িক। তাই তারা বলে আসছিলেন, অচিরেই এর সমাধান হবে। এখন সেটিও বলছেন না। ডলার সংকট ও অস্বাভাবিক দর বাড়ার কারণে উৎপাদন, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এর ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি ব্যয় মেটাতে মানুষের কষ্ট হচ্ছে। সব মিলিয়ে এ পরিস্থিতি অর্থনীতিকে বিপদে ফেলছে। এর মধ্যে চলছে নির্বাচনী আয়োজন। আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। মানুষের মনে প্রশ্ন সরকার নির্বাচন করে ফেলবে, জনগণকে কি অর্থনৈতিক স্বস্তি দিতে পারবে?
ঠিক এ কথাটিই বলেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)। গত মঙ্গলবার অর্থনীতি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, নির্বাচনের পরও যে শান্তিতে থাকব, সে কথাও বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেছেন, এবারই প্রথমবারের মতো রাজনীতি ও অর্থনীতি—দুই বিষয়ে একই সঙ্গে অনিশ্চয়তা আছে। দেশের রাজনীতি ঠিক না থাকলে অর্থনীতি ঠিক থাকবে না। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অর্থনীতির অনিশ্চয়তাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, রিজার্ভ কমে যাওয়া, বিনিময় হার—এসব নিয়ে চাপে আছে অর্থনীতি। মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বহুদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত যার ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠে গেছে। মানুষ কম খেয়ে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে মানুষ স্বভাবতই কম দামি খাদ্যপণ্যের দিকে ঝুঁকেন। খাদ্যাভ্যাসে প্রোটিন, ভিটামিন ও বিবিধ পুষ্টিগুণসম্পন্ন অনুখাদ্যের মাত্রা কমতে থাকলে—তার প্রভাব পড়ে পরিবারের সদস্যদের ওপরে। পৌষ্টিক আহারের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পরিলক্ষিত হয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর। এই ভাবনাটা জাতীয় স্তরে আছে বলে মনে হচ্ছে না।
খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বিষয়ে অর্থশাস্ত্রের পরিসরে, বা নীতিনির্ধারকদের দুনিয়ায় যত আলোচনা হয়ে থাকে, তার সিংহভাগজুড়ে থাকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা। তা স্বাভাবিকও বটে, কারণ এ বিপত্তির আঁচ সর্বাধিক পড়ে তাদেরই ওপর। কিন্তু সমাজের অন্য স্তরের মানুষের জীবনেও খাদ্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যস্ফীতি যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, তার ফল গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি।
অর্থনীতির সংকট অনেক বেশি ঘনীভূত হয়েছে; কিন্তু তা সমাধানে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ লক্ষণীয় নয়। এখন সংকট সমাধানে সরকারের সক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। পিআরআই বলছে, সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গত এক বছরে যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, তা গত ৫০ বছরেও নেওয়া হয়নি। ফলে ব্যাংক খাতে এখন পর্যাপ্ত অর্থ নেই। তাতে সরকারের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমে এসেছে।
আমাদের জাতীয় অর্থনীতির প্রধান সমস্যা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। প্রতিবারই এটি ঘটছে। বাজেটে এক বিশাল অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জন্য এবং শেষ পর্যন্ত সেটি আদায় হয় না। এবং এজন্য এনবিআরকে জবাবদিহিও করতে হয় না। বর্তমান সময়ে এনবিআর আরও চাপে রয়েছে। শুল্ক-কর আদায় নিয়ে বড় বিপাকে পড়েছে সংস্থাটি। একদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত—চলতি অর্থবছরে স্বাভাবিকের চেয়ে জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ শুল্ক-কর আদায় বাড়াতে হবে। অন্যদিকে আমদানি নিরুৎসাহিত হওয়ায় সামগ্রিকভাবে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রভাব পড়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দ্বন্দ্ব সংঘাতের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে শ্লথগতি। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রাজস্ব আদায়ে ৮ হাজার ২০৮ কোটি টাকা ঘাটতি হয়েছে। এ সময়ে সব মিলিয়ে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৭৬ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। যদিও আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৮৪ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা। অর্থবছরের শুরু থেকেই শুল্ক-কর আদায়ে পিছিয়ে থাকে এনবিআর, তাহলে সামনে কী দিন অপেক্ষা করছে, সেটি বোঝা যাচ্ছে।
সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক। প্রথম কাজ রাজস্ব ঘাটতি কমিয়ে আনার জন্য জোর প্রচেষ্টা নিতে হবে এবং সেজন্য সরকারের ব্যয় সংকোচন করতে হবে। ডলারের সংকট কাটাতে বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহারের সীমা তুলে দিতে হবে। সরকার রাজনীতিতে জয়ী হবে নিশ্চয়ই, তবে অর্থনীতির মুখেও চওড়া হাসি ফোটালে সেটিই হবে মানুষের জন্য বড় পাওয়া।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন