জাকির হোসেন
প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৭:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের বিজয় ছিল কিসিঞ্জারের বড় পরাজয়

বাংলাদেশের বিজয় ছিল কিসিঞ্জারের বড় পরাজয়

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্ষীয়ান কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার মারা গেছেন। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় ছিল এই হেনরি কিসিঞ্জারের পররাষ্ট্রনীতির একটি বড় পরাজয়। এ কারণে নিক্সন প্রশাসনে কিসিঞ্জারের অবস্থা একসময় নড়বড়ে হয়ে যায়। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ছিল কিসিঞ্জারের গভীর বিদ্বেষের মনোভাব। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশকে কোনো দিনই মেনে নিতে পারেননি। তাই বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেস’ বলে বিদ্রূপ করেছিলেন। গবেষকদের মতে, আসলে এই ‘বাস্কেট কেস’ কথাটা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন তৎকালীন মার্কিন কূটনীতিক ইউ অ্যালেক্সি জনসন। তিনিই প্রথম বাংলাদেশ প্রসঙ্গে শব্দটা ব্যবহার করেন, সেখান থেকে তা লুফে নেন হেনরি কিসিঞ্জার।

সত্তরের দশকে কিসিঞ্জারের বিদেশি শত্রুর তালিকায় ছিল তিনটি নাম। তাদের অন্যতম হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অন্য দুজন হলেন চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দে ও ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট উয়েন ভান থিউ। যে কোনো উপায়ে এ তিনজনকে উৎখাত করাই ছিল কিসিঞ্জারের লক্ষ্য। কারণ এ তিনজন বারবারই কিসিঞ্জারের পরিকল্পনা বানচাল করে দিচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে আবার বঙ্গবন্ধুর ওপর কিসিঞ্জারের রাগটা ছিল একটু বেশি। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে চীন-মার্কিন সুসম্পর্কের সম্ভাবনাকে প্রায় অনিশ্চিত করে তুলেছিলেন। ওই সময় চীনের সঙ্গে মার্কিনদের সম্পর্কের দূতিয়ালির ভূমিকায় ছিল পাকিস্তান। সেই পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় এ দূতিয়ালির কাজে ভাটা পড়ে। তাই প্রতিশোধপরায়ণ কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে উৎখাত করার নীলনকশা তৈরি করেন। একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধুর হত্যার ‘ব্লু-প্রিন্ট’ ছিল অত্যন্ত পাকা হাতের তৈরি। অতিশয় কূটকৌশল ও ঘটনার আগে-পরে সবকিছু নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ হত্যা চক্রান্তের ব্ল‍ু-প্রিন্ট তৈরি করা হয়। এটা যে শুধু খন্দকার মোশতাক, জেনারেল জিয়া, মেজর ফারুক, রশিদ, ডালিমদের মতো কতিপয়ের মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্ত‍ার সমষ্টি বা ফল নয়, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। আর এটাও বোঝা যায় যে, এর পেছনে ছিল অনুরূপ রাজনৈতিক হত্যার অভিজ্ঞ পেশাদার আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারী গোষ্ঠী, যারা কি না এর আগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের বহু পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা তৈরি করে হাত পাকিয়েছে। সেইসঙ্গে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ ধরনের অনেক ‘নীলনকশা’ অত্যন্ত সফলভাবে বাস্তবায়িত করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রাজনীতির কৌশলগত দিকগুলো বিশেষভাবে মাথায় রেখে।

১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে হেনরি কিসিঞ্জার দক্ষিণ এশিয়া সফরের অংশ হিসেবে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় তিনি ছিলেন সর্বসাকল্যে মাত্র আট ঘণ্টা। এর আগে ওই বছরের আগস্ট মাসে ফিলিপ চেরিকে সিআইএর প্রধান হিসেবে বাংলাদেশে নিয়োগ করা হয়। এটা ছিল ফিলিপ চেরির দ্বিতীয় অ্যাসাইনমেন্ট। এর আগে একাত্তরে আমাদের মুক্তিসংগ্রামকে ব্যর্থ করতে মার্কিনরা যখন দিল্লি ও কলকাতায় সিআইএর নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছিল, তখন এই ফিলিপ চেরিকে দিল্লিতে নিয়োগ করা হয়েছিল। ওই অ্যাসাইনমেন্টে চেরি ব্যর্থ হয়েছিল। প্রধানত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কঠোর নজরদারির কারণে তখন সিআইএ তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। চেরির এ ব্যর্থতা পাকিস্তান-মার্কিন গোয়েন্দাদের বেপরোয়া করে তুলেছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল, স্বাধীনতার পর সেই ষড়যন্ত্রের হেডকোয়ার্টার সরিয়ে আনা হয় ঢাকায়। তবে কুশীলব অপরিবর্তিত। রিং মাস্টার আগের মতোই সেই হেনরি কিসিঞ্জার আর সহযোগী সেই জুলফিকার আলি ভুট্টো, ফিলিপ চেরি, হ্যারল্ড স্যান্ডার্স, হাবর্টি গর্ডন, জর্জ গ্রিফিন, ডেভিড ইউজিন বোস্টার প্রমুখ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কিসিঞ্জারের বিশেষ আস্থাভাজন ছিলেন হ্যারল স্যান্ডার্স। স্যান্ডার্স তখন মার্কিন ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের ডেপুটি ছিলেন। হেনরি কিসিঞ্জার স্টেট ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করলে হ্যারল্ড স্যান্ডার্সকেও স্টেট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যুক্ত করেন। কিসিঞ্জার তাকে স্টেট ডিপার্টমেন্টের গোয়েন্দা ও গবেষণা বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব অর্পণ করেন। এই স্যান্ডার্স কলকাতায় মোশতাক গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে স্যান্ডার্সের এ যোগাযোগের বিষয়টি কলকাতার মার্কিন কনসাল জেনারেল হাবর্টি গর্ডন এবং নয়াদিল্লিতে অবস্থিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিটিঙ্কের কাছে গোপন রাখা হয়। যদিও কলকাতার মার্কিন কনসাল জেনারেল হাবর্টি গর্ডন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মার্কিন ছক বাস্তবায়নে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। কলকাতা কনসালের জর্জ গ্রিফিনকেও মোশতাক গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। গ্রিফিন ছিলেন স্যান্ডার্সের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তাই পঁচাত্তরে স্যান্ডার্স তাকে স্টেট ডিপার্টমেন্টের গোয়েন্দা ও গবেষণা বিভাগে প্রধান হিসেবে নিয়োগ করেন।

কিসিঞ্জার চক্র ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হয়। পেন্টাগন, কলকাতা ও বাংলাদেশে স্যান্ডার্স, গ্রিফিন, ফিলিপ চেরির অবস্থান তখন সুদৃঢ়। সিআইএর নেটওয়ার্ক তখন পুরোদমে সক্রিয়। চুয়াত্তরের নভেম্বরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার লক্ষ্যে নতুন করে গঠন করা হয় প্ল্যানিং সেল। তৈরি করা হয় ব্লু-প্রিন্ট।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ২৫ বছর পর ২০০১ সালে প্রকাশিত হয় ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত মার্কিন সাংবাদিক ক্রিস্টোফার এরিক হিচেন্সের ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’ শিরোনামের বই। এতে তিনি কিসিঞ্জারকে অসাধারণ স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন এক বিচিত্র মিথ্যাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। উল্লেখ করেছেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সিআইএর সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও। বইটিতে তিনি কিসিঞ্জারকে একজন যুদ্ধাপরাধী হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন। আর কিসিঞ্জারের বিচারের জন্য নুরেমবার্গসহ অন্যান্য ট্রাইব্যুনালের আদলে একটি আন্তর্জাতিক আদালত গঠনের দাবিও করেছেন।

হেনরি কিসিঞ্জার সম্পর্কে হিচেন্স লিখেছেন, “বিভিন্ন ঘটনা থেকে আমরা দেখতে পাই যে, কিসিঞ্জার রাজনীতির বিষয়টা একটি নিতান্ত ‘ব্যক্তিগত’ ব্যাপার হিসেবে গ্রহণের প্রবণতা দেখিয়েছেন। তার কারণে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে। তার জন্য অসুবিধাজনক কতিপয় ব্যক্তির কথাও আমরা জানি। যাদের মধ্যে ছিল সালভাদর আলেন্দে, আর্চ বিশপ ম্যাকারিওস ও শেখ মুজিবুর রহমান।”

হিচেন্স তার বইয়ে কিসিঞ্জার ও ইয়াহিয়ার মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড শুধু নয়, একাত্তরের গণহত্যার জন্যও কিসিঞ্জারকে অভিযুক্ত করেছেন হিচেন্স। তার দ্ব্যর্থহীন মন্তব্য, ভারতবিদ্বেষী নিক্সনকে খুশি করাই ছিল কিসিঞ্জারের ব্যক্তিস্বার্থ। আর এটা চরিতার্থ করতেই তিনি তার বাংলাদেশ নীতি নির্ধারণ করেন। কিসিঞ্জার পণ করেছিলেন, কিছুতেই তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় মানবেন না। এমনকি কিসিঞ্জারের তৎকালীন সহকারী রজার মরিসের মতে, কিসিঞ্জার আলেন্দের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে তুলনা করেছিলেন।

হিচেন্স তারই বইয়ে কিসিঞ্জারকে যে অসাধারণ স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন এক বিচিত্র মিথ্যাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তা যথার্থ। যে কিসিঞ্জার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই তিনি ২০০৭ সালের ১ এপ্রিল এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘...বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নয়, ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের পলিসি ছিল, যাতে ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে না পড়ে।’ (তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ ইন ব্লাড অ্যান্ড টিয়ারস—জ্যোতি সেনগুপ্ত; বাংলাদেশ : ষড়যন্ত্রের রাজনীতি—পরেশ সাহা; বাংলাদেশ : দ্য আনফিনিশড রেভল্যুশন— লরেন্স লিফশুলজ, দ্য লিগ্যাসি অব ব্লাড—অ্যান্টনি ম্যাসকারেনহাস)

লেখক : সহকারী সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কোরআন অবমাননাকারীকে আইনের আওতায় আনতে হবে : মাওলানা রাব্বানী

নির্ধারিত সময়ে গাজায় পৌঁছাতে পারেননি শহিদুল আলম, জানালেন সর্বশেষ পরিস্থিতি 

ডেঙ্গুতে আরও ৯ জনের মৃত্যু

জানুয়ারি থেকে সচিবালয় সম্পূর্ণরূপে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকমুক্ত হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা

মোবাইলে যেভাবে দেখবেন আফগানিস্তান-বাংলাদেশ ম্যাচ

মুখের ব্রণ চেপে ফাটাচ্ছেন? হতে পারে যে ভয়াবহ রোগ

ওয়াশিংটন পোস্টের জরিপ / গাজা যুদ্ধ নিয়ে ইসরায়েলের সমালোচনায় অধিকাংশ মার্কিন ইহুদি

স্ত্রী-শাশুড়িকে কুপিয়ে জখম, ধানক্ষেতে পড়ে ছিল যুবকের নিথর দেহ

এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য নতুন নিয়ম চালু করল এনসিটিবি

ভাইকে বাঁচাতে ঝাঁপ দেয় বোন, ভেসে উঠল দুজনের নিথর দেহ

১০

ইলিশ রক্ষায় অভিযান, প্রথমদিনেই ২২০ টন জব্দ

১১

কখন এবং কতটা শক্তিতে আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’?

১২

কুমিল্লায় বজ্রপাতে ৩ জনের মৃত্যু

১৩

মতবিনিময় সভায় বক্তারা / মহাসড়কে নিরাপত্তা ও অপরাধ দমনে জনগণের সহযোগিতা অপরিহার্য

১৪

৩ বিভাগে অতি ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস

১৫

নারায়ণগঞ্জে শান্তিপূর্ণ দুর্গাপূজা উদযাপন

১৬

কারখানায় কাজ বন্ধ, মহাসড়কে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিক্ষোভ

১৭

বিশ্বকাপের ম্যাচেও হাত মেলাননি ভারত ও পাকিস্তান অধিনায়ক

১৮

আ.লীগের সাবেক এমপি মোজাম্মেল হক গ্রেপ্তার

১৯

স্ত্রীকে হত্যা করে লাশ গুম, স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

২০
X