ড. জন বাটলার ওয়াটসনের একটি উক্তি দিয়ে প্রতিটি শিশুর দেশপ্রেম শিক্ষা বিষয়ে লেখাটা শুরু করতে চাই। তিনি বলেছেন, ‘মানুষের কোন সহজাত প্রবৃত্তি নাই’। সেই একই কারণে বলা চলে যে, শিশুর অভিজ্ঞতা ও নিরপেক্ষ কোনো বৈশিষ্ট্যও নেই। জন্মগতভাবে প্রতিটি শিশুর মধ্যে সমান প্রতিভা থাকে এবং প্রতিটি শিশু একরকম ভাবে জন্মগ্রহণ করে থাকে। অভিন্ন এই মেজাজ ও চিন্তা শক্তি ধীরে ধীরে বিভিন্নভাবে বেড়ে উঠার কারণ প্রসারিত হয়। শিশুর বেড়ে উঠার কারণ যাই হোক, তা যে পরিবেশ, শিক্ষা এই দুয়ের বন্ধনে আবদ্ধ—এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ আমি দেখছি না। প্রকৃতি সব শিশুর মধ্যে মানসিকভাবে একই রকমভাবে সৃষ্টি করলেও, এই দুটি কারণে মানুষ নানাভাবে, নানা মতের চিন্তা নিয়ে বেড়ে ওঠে। আমাদের পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার পরিবেশ, পারিবারিক প্রভাব ইত্যাদি এই অভিন্ন চিন্তার ক্ষেত্রে দায়ী।
শিক্ষা ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে, প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত কিছু আকাঙ্ক্ষা থাকে, এর অধিকাংশ ব্যক্তিগত আর বাকিগুলো সমষ্টিগত আকাঙ্ক্ষা বটে। তবে লোভ, অতি উচ্চবিত্ত হওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা, তা অধিকাংশ মানুষকে প্রভাবিত করে। ধরা যাক, একজন ব্যবসায়ীর কথা, তিনি তার অপর ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু সংরক্ষণমূলক রাজস্বের ক্ষেত্রে তিনি অবশ্যই আবার একজোট। এর কারণ কী ? কারণ একটাই—তা হলো ব্যক্তিগতভাবে সে বিত্তশালী হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ব্যক্তিগত চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করতে গিয়ে মানুষ দেশের চাহিদার কথা ভুলে যায়। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে এবং পারিবারিক চাহিদা নির্ধারণে যদি শিশুকে সেভাবে দেশপ্রেমে জাগ্রত করা হয়, তাহলে শিশু তার সমগ্র চিন্তা ও চিন্তার জগৎকে দেশের স্বার্থে জাগ্রত করতে পারবে। এখানেই আমাদের চিন্তাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে, আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা যদি আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর শিক্ষা, পরিবার, কিংবা সমাজের দিকে তাকাই, দেখতে পাব গোটা পশ্চিমা জগতের শাসক ও মানুষগুলো বালক-বালিকাদের শেখায় তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ হলো রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকা—অন্তত যে রাষ্ট্রের তারা নাগরিক। আর রাষ্ট্রীয় সরকারের অনুগত থাকা একান্ত কর্তব্য, যে রাষ্ট্রে সে বড় হবে। কিন্তু পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের দেশে কিছু হলেই রাষ্ট্রীয় বিআরটিস বাস ভাঙার মধ্য দিয়ে জ্বালাওপোড়াও শুরু হয়। এই শিক্ষা সে তরুণটি কোথায় পেল? রাষ্ট্র বা সমাজ বা পরিবার এখানেই ব্যর্থ। আমাদের শিক্ষা বলেন, আর পরিবার বলেন, এ বিষয়টি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ না করাতে সামাজিক জীবনে এ ভয়াবহ অধ্যায় সৃষ্টি হতে লাগল। পচিশ্চমা রাষ্ট্রগুলো কারও সঙ্গে যুদ্ধ বাজলে তার তরুণ ও রাষ্ট্রের মানুষদের বোঝাবার চেষ্টা করেন যে, এটি ছিল আত্মরক্ষামূলক আর বৈদেশিক রাষ্ট্রের হলে বলেন আক্রমণাত্মক। এ ধারণায় তাদের উজ্জীবিত করে রাখে। যার ফলে সে দেশগুলোর নাগরিকদের মধ্যে প্রাথমিক অবস্থা থেকে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়, তারা প্রচলিত অর্থে সেভাবে বেড়ে উঠেন।
এসব রাষ্ট্র শুধু তাদের চাহিদা বা কল্যাণ সর্ম্পকে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেয় না, অন্যদিকে অপরাপর রাষ্ট্র সর্ম্পকেও নাগরিকদের দেয় বিরূপ ধারণা। দেশ দখলকেও তারা নাগরিকদের কাছে তুলে ধরে, সভ্যতা বিকাশের প্রশ্নে এই কাজটি আমাদের করতে হয়েছে। নাগরিকরাও তা মেনে নেন অকপটে। যারা আন্তর্জাতিক বিশ্ব সর্ম্পকে খোঁজ-খবর রাখেন, তারা ভালো করে জানেন, এসব বিষয়ে তাদের মূলত দৃষ্টিভঙিটা কী? কিছুদিন আগে ঢাকায় একটি সেমিনার হয়, যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘ব্যবসায় নৈতিকতা’। এক ব্যবসায়ী তার বক্তব্যে বলেন, পুরো ব্যবসায়ী সমাজে ১০ জন সৎ ব্যবসায়ী খুঁজে বের করা যাবে না। এটি শুধু ব্যবসা কেন আমাদের সব সেক্টরে সমান সমস্যা। ডাকাতির জন্য, হত্যাকাণ্ডের জন্য, এমনকি দেশের সমগ্র সমস্যার জন্য দায়ী আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা। যেখানে দেশপ্রেমে আগ্রহী হওয়ার কোনো বাস্তবভিত্তিক শিক্ষার গন্ধও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই পশ্চিমা বিশ্বের আদলে একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে মূল বিষয় থাকবে আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, স্বাধীনতা ও দেশপ্রেম। তাহলে ব্যবসায়ী কেন—সব ক্ষেত্রে সৎ মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে।
একজন মানুষের ১০টি বাড়ি আছে, ১০টি গাড়ি আছে আর ১০টি প্রতিষ্ঠানের তিনি প্রধান। আমি অত্যন্ত সাদামাটা ভাবে যদি আপনাকে প্রশ্ন করি ১০টি বাড়ি থাকলেও ১০টি কক্ষে কী একজন মানুষ একত্রে ঘুমতে পারবেন? আপনি বলবেন, না। তাহলে তার কেন চিন্তায় এটুকু আসবে না যে, সেই যা করছে তা ভুল, যেখানে আরও ১০ জন সাধারণের অংশীদারত্ব রয়েছে। শিক্ষাকে এমনভাবে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে, যেখানে শিশুকাল থেকে একজন মানুষ তার রাষ্ট্রীয় আনুগত্য নিয়ে বড় হবে। তাহলে খুঁজতে হবে ভালো মানুষের। এমনিতেই পথে ঘাটে যারা থাকবে তারা সবাই ভালো হবে। সপ্তাহ খানেক আগে একটি চ্যানেলের সংবাদের প্রতিবেদনে দেখলাম, এক চাকরিজীবী অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলছেন যে, ‘আমি দুর্নীতি করি, ঘুষ খাই এবং অন্যকেও তাতে উদ্বুদ্ধ করি। একই কারণে আমি জেলও খেটেছি, আবার টাকা দিয়ে বেরও হয়েছি। আমার ধারণা, জেল হবে; কিন্তু আমাকে তো ফাঁসিতে ঝোলাবে না।’ এই যে ধারণা—কোথায় সে পেল? আমি অবাক হয়ে ভাবলাম কোন দেশে আছি।
শিক্ষাব্যবস্থা নানাদেশে, নানা সময়ে একের পর এক পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংশোধন করা হয়েছে। ধারাবাহিক নতুন আবিষ্কার ও নতুন পদ্ধতি চালু হচ্ছে। আমরা কখনো আবিষ্কার ও নতুনের সঙ্গে খুব কাছ থেকে পরিচিত হয়েছি, আবার কখনো আবিষ্কারের খুব দূরে সরে গেছি। আধুনিক, বৈজ্ঞানিক ও কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতির সার্বিক পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কালে কালে আমরা শিক্ষাব্যবস্থা বা পদ্ধতি আবিষ্কারের কথা চিন্তা করলেও বস্তুত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে অনেক দূরে সরে আছি। অথচ বহিঃবিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা আজ অনেক উন্নত। এক জরিপে দেখা গেছে, যে জাতি সার্বিকভাবে উন্নতি লাভ করেছে, সে জাতির উন্নতির মূলে রয়েছে আধুনিক ও সময়োপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা ও পদ্ধতি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় চলছে এক অশনিসংকেত। সামগ্রিকভাবে জাতীয় শিক্ষার এই দুঃসহ অবস্থা চিন্তাশীল মানুষকে বাধ্য করছে শিক্ষার বিভিন্ন দিক সর্ম্পকে বিশ্লেষণ করতে, আর তার প্রতিকারের পথ বের করতে। আজকাল দেশপ্রেম সর্ম্পকে যে শিক্ষা দেওয়া হয়, তা প্রায়ই বুদ্ধিগত দিক থেকে বিপথগামী, কিন্তু নৈতিক বিচারে নির্দোষ। দেশপ্রেমের শিক্ষা যিনি দেন, তিনিও আজ ভুল শিক্ষার প্রতি আনুগত্যশীল এক দায়িত্ববান মানুষ। শিক্ষকদের স্বভাব এই যে, তারা জানে যতটুকু, ঠিক ততটুকু শেখাতে পারেন। ইতিহাসের শিক্ষক ইতিহাস পড়াবেন, তাকে দিয়ে অর্থনীতির ক্লাস বিপর্যয় ডেকে আনবে। সেই একই অর্থে মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষার সুদূরপ্রসারী দিক থাকবে এখানে কল্যাণ-অকল্যাণ থেকেও মানব মুক্তি অত্যন্ত বেশি সংবেদনশীল হবে এটাই স্বাভাবিক।
শিক্ষার গতি আনতে হবে সময়ের প্রয়োজনকে স্বীকার করে। অতীতের ভালোকে ধরে রেখে নতুন ও আধুনিক চিন্তার সমন্বয়ে তৈরি করতে হবে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা। আজকের প্রয়োজন, বিশ্বের প্রয়োজন, উন্নতির প্রয়োজনে ভবিষ্যতের ভাবনাকে প্রাধান্য দিতে হবে। একটি যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা সুস্থ, সমৃদ্ধ ও আধুনিক প্রগতিশীল জাতি উপহার দিতে সক্ষম। শিক্ষার এ সমস্যা পরিত্রাণের কি কোনো ব্যবস্থা নেই? সমাজের সব শ্রেণির মানুষ আজ অনুধাবন করতে পেরেছে মুক্ত চিন্তাসম্পন্ন সুনাগরিকের আজ বড় অভাব, যার মধ্যে দেশপ্রেম থাকবে। আর মুক্ত চিন্তার নাগরিক তৈরির সর্বাজ্ঞে প্রয়োজন একটি উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষাকে দেশ কাল ও সমাজের সব স্তরের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে—এ কথা এখন আর কথার মালা নয়, বাস্তবতা। আমাদের দেশ বছরের পর বছর ক্রমাগত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে আমার মনে হয়। আমি মাঝেমধ্যে চোখের সামনে যেন নরক দেখতে পাই। আমার মতো যারা নেশাগ্রস্ত নন, তারা তো দেশের এই বিপর্যয় অত্যন্ত পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই। আমাদের সন্তানরা আজ যেখানে সভ্যতাকে ছুঁয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে তারা কোথায় যাচ্ছে? তাই শিশুকালকে জীবনের মৌলিক সময় হিসেবে চিহ্নিত করে এখানে সব চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে জাতি মুক্তি পাবে। আগামী প্রজন্ম সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে বেড়ে উঠুক একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এ শুধু প্রত্যাশা থাকল।
লেখক: শিক্ষাবিদ-নজরুল গবেষক