রুস্তম আলী খোকন
প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৪:২৮ এএম
আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৫১ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কমরেড মণি সিংহ

গণতান্ত্রিক সংগ্রামের উজ্জ্বল নক্ষত্র

গণতান্ত্রিক সংগ্রামের উজ্জ্বল নক্ষত্র

দু-দুবার স্বাধীনতা লাভ করা বাংলাদেশে কমরেড মণি সিংহ লড়াই করেছেন দীপ্ত পায়ে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এই মহান বিপ্লবী একটি সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসর্গ করেছেন। ছিলেন জনগণের মাঝে, গরিব মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। কমরেড মণি সিংহ এই ভূখণ্ডের সেই রাজনীতিক, যিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন, বাংলাদেশ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ছিল তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। স্বাধীন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কমরেড মণি সিংহ ছিলেন আদর্শের প্রেরণা হয়ে মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার মধ্যে। কমরেড মণি সিংহ একটি ইতিহাস, কমরেড মণি সিংহ একটি প্রেরণা, কমরেড মণি সিংহ আদর্শের রাজনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র।

এই বিপ্লবী রাজনীতিকের জীবন আলেখ্য আজও সমাজ বিপ্লবের পবিত্র লক্ষ্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগামী দিনের সৈনিকদের কাছে শিক্ষা হয়ে আছে। টঙ্ক, তেভাগা, নানকার আন্দোলনের মতো কৃষক বিদ্রোহের অগ্নিমশাল প্রজ্বলিত হয়েছে মণি সিংহের হাতে। ৯০ বছর বেঁচে থাকা দীর্ঘ জীবনে ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত লড়েছেন বিরামহীন গতিতে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসান করে যখন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম নেয় ঠিক তখনই কমরেড মণি সিংহ পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করে সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। মহান ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রচনা এবং সেই আন্দোলনে বাঙালি ছাত্র-শিক্ষক বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে তাতে মুসলিম লীগের পরাজয় নিশ্চিত করতে কমরেড মণি সিংহের ভূমিকা আজও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শুরু থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছিল। তা সত্ত্বেও পার্টির বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি অগ্রসর হতে থাকে। ভীত হয়ে ১৯৫৪ সালের ৪ জুন পাকিস্তানি শাসকচক্র কমিউনিস্ট পার্টিকেই নিষিদ্ধ করে দেয়। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় কমরেড মণি সিংহ গণতান্ত্রিক সংগ্রামে ভূমিকা রাখেন। ১৯৬১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি চিন্তা করেন, তখন কমরেড মণি সিংহ, কমরেড খোকা রায়, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। মূলত এই বৈঠক থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য রাজনৈতিক সংগ্রামের সূচনা ঘটে। প্রাথমিক পর্যায়ে আলোচনায় তাড়াহুড়ো না করে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন অবসানের রাজনৈতিক সংগ্রাম গড়ে তুলতে পরামর্শ দেন কমরেড মণি সিংহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেই লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের ঐক্যের ওপর জোর দেন। দুই ছাত্র সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করে আইয়ুব খানের প্রণীত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রস্তাবনা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান মেনে নেন। তারই পথ পরিক্রমায় রচিত হয় ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন। এই শিক্ষা আন্দোলনে পার্টির তরুণ নেতা মোহাম্মদ ফরহাদ অসাধারণ ভূমিকা রাখেন। ’৬৬-এর ৬ দফা প্রণীত হওয়ার পর এই আন্দোলনের সঙ্গে ’৬৯-এর সালে ছাত্রদের ১১ দফা যুক্ত হলে জেনারেল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ লাভ করে। অনুষ্ঠিত হয় পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস। কমরেড মণি সিংহ এই কংগ্রেসে সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালের তৃতীয় কংগ্রেসেও মণি সিংহ পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান তার দীর্ঘদিনের সহচর খন্দকার মোশতাক আহমেদের ষড়যন্ত্রে কতিপয় সেনা কর্মকর্তাদের দ্বারা সপরিবারে নিহত হন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য ব্যতীত আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় প্রায় সব নেতৃত্ব খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়। সিপিবি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করলে খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ও পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার কমিউনিস্ট পার্টির ওপর পাকিস্তানি মডেলের নির্যাতন-নিপীড়ন ফের শুরু করে। নিষিদ্ধ করে দেয় কমিউনিস্ট পার্টিকে। কমরেড মণি সিংহকে গ্রেপ্তার করা হয় ১৯৭৭ সালে। ছয় মাস আটকে রাখার পর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের জনগণের কাছে আদর্শ ত্যাগ আর সংগ্রামের দৃষ্টান্ত হয়ে আজও বেঁচে আছেন কমরেড মণি সিংহ। এই আদর্শবাদী বিপ্লবীর জীবনকাহিনি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শিশু-কিশোরদের পাঠ্য হওয়া জরুরি। তার জীবনী পাঠ্যপুস্তকে সংযোজিত করার দাবি তার অনুসারীদের বহুদিনের। দেশের যে গণতান্ত্রিক সংকট, সেই সংকটে কমরেড মণি সিংহের রাজনৈতিক জীবন সব গণতান্ত্রিক শক্তির কাছে শিক্ষণীয় হতে পারে। ১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর এই মহামানবের মহাপ্রয়াণ ঘটে। প্রয়াণ দিবসে তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

লেখক: সদস্য সচিব, জাতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতি আন্দোলন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিচারককে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে জামায়াত নেতাকে অব্যাহতি

২০১৮ সালের নির্বাচনের বদনাম ঘোচাতে চায় পুলিশ : ডিএমপি কমিশনার

ওয়েস্ট হ্যামের বিরুদ্ধে চেলসির বড় জয়

নরসিংদী জেলা সাংবাদিক সমিতি, ঢাকা’র নতুন কমিটিকে সংবর্ধনা

কেইনের হ্যাটট্রিকে লেইপজিগকে উড়িয়ে দিল বায়ার্ন

নিখোঁজের একদিন পর যুবকের মরদেহ মিলল পুকুরে

বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ড্রয়ের তারিখ ঘোষণা করলেন ট্রাম্প

এশিয়া কাপ দলে জায়গা পেয়ে সোহানের কৃতজ্ঞতার বার্তা

ঘুষ কেলেঙ্কারিতে পুলিশ কর্মকর্তা প্রত্যাহার

প্রবীণদের বিশেষ যত্ন নিয়ে বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিন: স্বাস্থ্য সচিব

১০

বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত: রাষ্ট্রদূত আনসারী

১১

লা লিগার কাছে যে অনুরোধ করতে চায় বার্সা

১২

‘নির্বাচনে আমলাদেরকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে’

১৩

সাবেক এডিসি শচীন মৌলিক কারাগারে

১৪

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা আসছেন শনিবার, যেসব বিষয়ে আলোচনা

১৫

সিদ্ধিরগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের শানে রিসালাত সম্মেলন

১৬

শেষ দিনেও ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে মতামত দেয়নি ৭ রাজনৈতিক দল

১৭

ইউরোপের লিগগুলোতে দল কমানোর প্রস্তাব ব্রাজিল কোচ আনচেলত্তির

১৮

নেপালে মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের প্রচার, তাসনিম জারার ব্যাখ্যা

১৯

মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে মৃত্যুর মিছিল, তিন বছরে প্রাণ হারান ১৮৩ জন

২০
X