আলম রায়হান
প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৪ জুলাই ২০২৩, ১২:১৯ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বাজারদরের ইচ্ছে ঘোড়া

আলম রায়হান।
আলম রায়হান।

দ্রব্যমূল্য যেন ছুটে চলে আকাশপানে। অকল্পনীয় উন্নয়ন, রাজনীতি টানাপোড়েন, আগামীর ভাবনা অথবা শঙ্কা—সবকিছু ছাপিয়ে বাজারদরই এখন বেশি আলোচ্য বিষয়। দ্রব্যমূল্য আজ এখানে তো কাল ওখানে। তবে নিচের দিকে নয়, কেবল ঊর্ধ্বমুখী। কোনো একটি অজুহাত পেলেই দ্রব্যমূল্য বাড়ে। রোজা-ঈদ-বাজেট থেকে শুরু করে হেন কোনো ইস্যু নেই যা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অজুহাত নয়। আবার কখনো কখনো অজুহাত তৈরি করা হয়। এটি যেন সাধারণ প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সাধারণ মানুষের জন্য এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে অসাধারণ বিড়ম্বনা।

ইচ্ছে করলেই দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন বিক্রেতারা এবং হচ্ছেও তাই। পাইকারি থেকে খুচরা সবই চলে একই প্রবণতায়। এ ধারায় প্রচলিত শব্দমালা, বাজারে আগুন, দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া—এসব কথাবার্তা শুনতে শুনতে মানুষ যেন অনেকটাই ধাতস্থ হয়ে গেছে। জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক এবং আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস—এ বচনও যেন এখন পানসে।

অনেকের বিবেচনায়, দ্রব্যমূল্যের চাপে মানুষের শ্বাস যায় যায় দশা! এর মূলে আছে, বাজারদরের ‘ইচ্ছে ঘোড়া’। ধাপের পরিবর্তন। যেমন ডিজিটাল। ইচ্ছে করলেই বাড়িয়ে দেওয়া যায় নিত্যপণ্যের দাম। ঠেকাবার কেউ নেই। অবশ্য, কে কাকে ঠেকায়! ফলে প্রতিকার নেই। দৃশ্যমান কোনো প্রতিবাদও নেই। একসময় মানুষকে প্রতিবাদী করতে আসাদের রক্তমাখা শার্টই ছিল যথেষ্ট। সময়ের পরিক্রমায় সেই অবস্থা কেটে গেছে অনেক আগে।

মানুষ যেন সবকিছুতেই মানিয়ে চলার মানসিকতায় ‘উন্নীত’। অথবা আক্রান্ত। বিশেষ করে মাননীয়দের বেলায়। রাষ্ট্র এখানে নিয়ে গেছে। ভালো-মন্দ যাই হোক, দেশের মানুষ যেন সর্বংসহা। ধরণির মতো। মানুষ প্রতিনিয়ত সহনশীলতার পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। আমজনতার এ পরীক্ষা চলছে সব ক্ষেত্রে। তবে প্রতিদিন সহনশীলতার পরীক্ষা দিতে হয় নিত্যপণ্যের বাজারে। আর আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি মানুষের সহনশীলতার চরম পরীক্ষা নেওয়ার জন্য প্রায়ই নানান বয়ান ছাড়েন। এ ধারায় ২৬ জুন সংসদে জানান দিলেন, তিনি ৫৬ বছর ধরে রাজনীতি করেন! তার ব্যবসা ৪০-৪২ বছরের। তার হিসেবে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়ই আছে। ভাবখানা এই, উদ্বেগের কিছু নেই।

অনেকেরই প্রশ্ন, টিপু মুনশি কেন বাণিজ্যমন্ত্রী? এমন তো নয়, আওয়ামী লীগ সরকার কাউকে খামোখা মন্ত্রী বানিয়েছে। আর যে গল্প জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবং হাসিনা সরকারের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ক্রুদ্ধ মজিবুল হক চুন্নু জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন জনসভায় রসিয়ে রসিয়ে লাগাতার বলে যাচ্ছেন, তা বিবেচনায় না নেওয়াই ভালো। কারণ এতটা চরম সংকটে আওয়ামী লীগের মতো বড় দল পড়ার কথা নয়। কিন্তু সংকটে পড়েছে মানুষ।

দেশের মানুষের জন্য যে বিষয়গুলো নিয়ে চরম সংকট সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে শীর্ষ রয়েছে বাজারদর। এদিক থেকে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে ‘শীর্ষ স্থানীয়’ মন্ত্রী বলা চলে। সম্ভবত মন্ত্রীও বিষয়টি জানেন। আর এ কারণেই হয়তো আলোচনায় শীর্ষ স্থানটি ধরে রাখার জন্য দ্রব্যমূল্য প্রসঙ্গে কিছুদিন পরপরই অদ্ভুত কথাবার্তা বলেই যাচ্ছেন। যা সবসময়ই আলোচনার শীর্ষে থাকে। এদিক থেকে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তুলনীয়। চাইলে তাকে কিঞ্চিৎ ওপরে স্থান দেওয়া যেতে পারে। আর জনবিরক্তি উদ্রেকের বেলায় বাণিজ্যমন্ত্রীর অবস্থান সবার শীর্ষে। এ ক্ষেত্রে তার সমকক্ষ আর কেউ আছেন বলে মনে হয় না। তিনি অতুলনীয়।

এই অবস্থায় তিনি ছক্কা মারলেন ২৬ জুন, মহান জাতীয় সংসদে। কেবল জাতীয় সংসদে নয়, আগাগোড়াই বাণিজ্যমন্ত্রী অন্যমাত্রায় কথা বলে আসছেন। সংসদের বাজেট পাসের ১০ দিন আগে ১৬ জুন বাণিজ্যমন্ত্রী রংপুরে বলেছেন, ‘চাইলেই ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়া যায় না। তারা (ব্যবসায়ী) যদি সবকিছু বন্ধ করে দেয় তাহলে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে পড়বে। তাই আমাদের ব্যালান্স করে চলতে হচ্ছে। এর মধ্যে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। তবে আমরা চেষ্টা করছি যেন তারা সুযোগটা না নিতে পারে।’

প্রশ্ন হচ্ছে, মন্ত্রীকে ব্যালান্স করে চলতে হবে কেন? তার তো বিধিবিধান অনুসারে চলার কথা। কিন্তু তিনি বলছেন, ব্যালান্স করে চলার কথা। এ ঘটনায় অনেকেই বাণিজ্যমন্ত্রীকে ‘ব্যালান্স মন্ত্রী’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী সবচেয়ে মজার কথা বলেছেন ১২ জুন জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে। তিনি বলেন, ‘মূল্য নিয়ন্ত্রণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

বাণিজ্যমন্ত্রী কি ভিন্ন কোনো দেশে আছেন? না ভিন্ন গ্রহে তার অবস্থান? তার তো জানার কথা, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের কী হাল। আরও জানার কথা, বহুজাতিক কোম্পানি থেকে গ্যাস-এলএনজি কিনে নির্ধারিত সময়ে মূল্য পরিশোধ করতে পারছে না পেট্রোবাংলা। বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে বর্তমানে অন্তত ৪৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ৯ কোটি টাকা দেনা আছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি। একজন মন্ত্রী হিসেবে টিপু মুনশির তো এ তথ্য জানা থাকার কথা। অবশ্য তার জানার সীমা নিয়ে এক ধরনের জনসংশয় সৃষ্টি হয়েছে। ধোঁয়াশা আছে। উল্লেখ্য, তিনি সংসদে বলেছেন, ‘আমি ডিমের খবর জানি না।’

জাতীয় সংসদে বাজেট পাসের দিন দ্রব্যমূল্য নিয়ে শুধু নয়, বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে তার রাজনীতির ভিত্তি খোলাসা করতে গিয়ে মেয়াদও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘বারবার একটা কথা উঠে আসছে যে, আমি ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ীরা আমার জন্য সুবিধা পাচ্ছেন। যারা এ কথাগুলো বলছেন, তাদের উদ্দেশে একটা কথা বলি। তাদের রাজনীতির কত বছরের অভিজ্ঞতা আমি জানি না। আমি কিন্তু ৫৬ বছর ধরে রাজনীতি করি। আমি ব্যবসা করি ৪০-৪২ বছর। একজন তো বললেন আমাকে পদত্যাগ করতে। খুব ভালো কথা বলেছেন। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলব, আমাকে ছেড়ে তাকে দায়িত্বটা দিতে পারেন।’

জাতীয় সংসদে দ্রব্যমূল্য প্রশ্নে তোপের মুখে পড়ে মাননীয় মন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সংকট তৈরি হবে। একটা জিনিস মনে রাখা দরকার, জেলে ভরলাম, জরিমানা করলাম, সেটা হয়তো করা সম্ভব। কিন্তু তাতে যে সংকটটা হঠাৎ করে তৈরি হয়, আমাদের তো সেটা সইতে কষ্ট হয়। আমরা চেষ্টা করি আলোচনার মাধ্যমে, নিয়মের মধ্যে থেকে কিছু করতে।’

আমরা সাধারণ মানুষ কি অভাগা! দ্রব্যমূলের ‘ইচ্ছে ঘোড়া’ নিয়ন্ত্রণে সরকারের করণীয় প্রসঙ্গ ও পরিকল্পনার কথা অথবা আশ্বাসবাণীর বদলে জাতিকে শুনতে হয় বাণিজ্যমন্ত্রীর ৫৬ বছরের রাজনৈতিক মেয়াদের অহমের বার্তা। তিনি আরও যা বলেছেন তাতে ভাবখানা এই, প্রধানমন্ত্রী তাকে ধরে রেখেছেন! কিন্তু কে প্রশ্ন করবে, ব্যবসায়ীদের জেলে ভরতে কে বলেছে মাননীয় মন্ত্রী? রাষ্ট্র কি কেবল জেলে ভরার এখতিয়ার ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে? তা তো নয়। নিয়ন্ত্রণের অনেক পথ ও পদ্ধতি তো আছে। সেগুলো করছেন না কেন?

হয়তো বাণিজ্যমন্ত্রী অনেক কিছুই করছেন। কিন্তু জাতি জানে না। অন্তত বাজারে প্রতিফলন নেই। বরং অন্য বাস্তবতায় ভুগছে ১৮ কোটি মানুষ। সবাই বাজারদরের ইচ্ছে ঘোড়ার খুরের নিচে আছে। এ অবস্থায় যেখানে বাণিজ্যমন্ত্রীর লজ্জিত হওয়া উচিত, সেখানে তিনি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে দম্ভোক্তি করে জানান দেন, তার রাজনৈতিক জীবন ৫৬ বছরের। তাকে বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন, আপনার এই মেয়াদের বিনিময়ে বাজারে কি এক ছটাক আলু-পটোল ন্যায্যমূল্যে পাওয়া যাবে? যাবে না।

আর সবাই জানেন, লম্বা মেয়াদ দিয়ে আসলে তেমন কিছুই অর্জিত হয় না। স্বীকৃত বাস্তবতা, যা হয় তা অল্প মেয়াদেই হয়। প্রবচনই তো আছে, নয়তে না হলে নব্বইতেও হয় না। এর উদাহরণ বিশ্বে অনেক আছে। আমাদের দেশেও আছে। এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতম হয়ে রয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবশ্য তার সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। তবুও বাণিজ্যমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায়, ১৯২০ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সময় মাত্র ৫৫ বছর।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, রাজনীতিতে মেয়াদ একমাত্র বিবেচ্য নয়। এ দিয়ে কোনো কিছু নির্ধারণ করা বাস্তবসম্মত নয়। বরং উল্টোটাও হতে পারে। বাস্তবে অনেক উদাহরণ আছে। এর প্রকাশ আছে আমাদের সাহিত্যেও। বাণিজ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন, আদু ভাই এক ক্লাসে কত বছর পড়েছেন, কিন্তু পরের ক্লাসে তার আর উত্তরণ হয়নি। আবুল মনসুর রচিত অসাধারণ গল্পের শেষ অনুচ্ছেদ হচ্ছে, ‘ছেলে আমাকে গোরস্তানে নিয়ে গেল। দেখলাম, আদু ভাইর কবরে খোদাই করা মার্বেল পাথরে ট্যাবলেটে লেখা রয়েছে, Here sleeps Adu mia Who was promoted from class VII to VIII. ছেলে বলল, বাবার শেষ ইচ্ছা মতো ও-ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ আমজনতার প্রশ্ন, দ্রব্যমূল্য নিয়ে মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির শেষ ইচ্ছাটা কী?

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এরদোয়ানের বিরাট সাফল্য, কুর্দিস্থানের যোদ্ধাদের নতুন অধ্যায়ের সূচনা

একে স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৯৪ শতাংশ পাস

জামায়াতের সঙ্গে জোট নয়, এনসিপির সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা উন্মুক্ত : সালাহউদ্দিন

কর্ণফুলী ইপিজেডে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৮ ইউনিট

সাতক্ষীরায় যাবেন এনসিপি নেতারা, তড়িঘড়ি করে সড়ক সংস্কার

দুই ওভারে দুই হ্যাটট্রিক! ক্রিকেটারের অবিশ্বাস্য কীর্তি

জেসিআই বাংলাদেশের উদ্যোগে ‘জেসিআই ব্লাড বন্ড’ স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি অনুষ্ঠিত

পাক অভিনেত্রীর ময়নাতদন্তের রিপোর্টে চাঞ্চল্যকর তথ্য

ক্লাস নেওয়ার সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক

খুলনায় সাবেক যুবদল নেতাকে গুলি করে হত্যা

১০

পরিত্যক্ত রেলপথ ব্যবহার করে অভিনব রাস্তা তৈরি (ভিডিও)

১১

ইসরায়েলকে বিমানঘাঁটি বানিয়ে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

১২

শেরপুর সীমান্তে শিশুসহ ১০ জনকে পুশইন

১৩

নিখোঁজের ৫ দিন পর পাটক্ষেতে মিলল শিশুর মরদেহ

১৪

কফি আসলেই ত্বকের উপকারে আসে, নাকি ক্ষতি করে?

১৫

জিপিএ-৫ পেল বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী তানিশা

১৬

গানের মঞ্চ থেকে রুপালি পর্দায় কারিনা

১৭

ছাত্রদলের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা

১৮

‘সবাই বিবাহিত হওয়ায় পরীক্ষায় ফেল করেছে’

১৯

রংপুর ক্যাডেট কলেজে শতভাগ জিপিএ ৫

২০
X