সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:৫২ এএম
আপডেট : ০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০৮:০৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভোটের পরে

ভোটের পরে

দৈনিক কালবেলায় মঙ্গলবারের সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল ‘বেপরোয়াদের থামান’। এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় বনাম দলীয় স্বতন্ত্রদের কার্যকলাপ নিয়ে এ শিরোনাম। নৌকার প্রার্থী তার দলেরই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে অশ্রাব্য সব গালি দিচ্ছেন, তার লোকেরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর সদস্যদের ওপর হামলে পড়ছেন, নির্বাচনী ক্যাম্পে আগুন দিচ্ছেন, ভাঙচুর করছেন—এমনকি হত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে। উল্টোটাও ঘটছে অনেক জায়গায়। স্বতন্ত্র প্রার্থী তার পেশিশক্তি প্রদর্শন করছেন দলীয় নৌকার প্রার্থীকে।

কেউ বিশ্বাস করবেন না যে, এরা একই আদর্শের অনুসারী, একই দল করে, জেলা ও উপজেলা বা পৌর বা ইউনিয়ন পর্যায়ে একই দলীয় অফিসে বসেন। এরা সবাই জয় বাংলা স্লোগান দেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী ও দলীয়প্রধান শেখ হাসিনা একাধিকবার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। সাধারণ সম্পাদকও বলেছেন সংযত আচরণ করতে। কিন্তু তারা থামছেন না।

থামার কথাও নয়। তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা এক আওয়ামী লীগের ভেতরে এখন অনেক অনেক লীগ। সবাই ক্ষমতা চায় এবং যার যার জায়গায় ক্ষমতা চর্চাই করেছে এ সময়টায়। আধিপত্য আর অর্থ-বিত্তের সবচেয়ে সহজ উপায় এমপি হতে পারা এবং এমন এক নির্বাচনে যেখানে বিরোধী দল বলে কিছু নেই। সব নিজেদের মধ্যে। তাই মরিয়া হয়ে মাঠ দখলের প্রতিযোগিতা।

টক শোতে গেলে একটা কমন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, আওয়ামী লীগ নেতাদের এই সংঘাত, সহিংসতা এবং একে অন্যের বিরুদ্ধে যে বিষোদ্গার চলছে, সেটা কি তবে দলের ভিতের স্থায়ী বিরোধের সৃষ্টি করছে? এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে গৃহবিবাদ কোনো কোনো স্থানে এমন পর্যায়ে গেছে যে, একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অবশ্যই থাকবে এ বিদ্বেষ চর্চার।

ভোটের পর কী হয় সেটাই ভাবনার। অনেক স্থানেই পরাজিত প্রার্থীরা প্রতিশোধ নিতে চাইবেন। অনেক বিজয়ীরা অতীতের কোনো ঘটনার ঝাল মেটাবেন। কর্মীরা যে বিভক্ত হয়েছেন, তার একটা সহিংস প্রভাবও অনেক জনপদে দৃশ্যমান হবে। এমন শঙ্কাও আছে যে, অনেক মানুষ ভোটের পরে হয়তো বাড়িও ফিরতে পারবে না।

আমাদের দলীয় রাজনীতি যেহেতু সন্ত্রাসের শিক্ষাকেই অস্ত্র বানিয়েছে, তাই এর ফল ভোগ করতে হবে দলকেই। কিন্তু কেন এত সহিংসতা? তাও নিজেদের মধ্যেই? কারণ হলো পাওয়া না পাওয়ার বিরোধ, বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ। সরকারি দল করা মানেই মুফতে অর্থবিত্ত আর আধিপত্যের মালিক হওয়া। এই ১৫ বছরে শাসক দলের সবাই পেয়েছে। কিন্তু কে কতটা পেয়েছে, কে বেশি পেয়েছে, কে কম পেয়েছে, কে বেশি পেয়েছে সেই দ্বন্দ্বটাই ভোটের মাঠে এসে প্রকাশিত হয়েছে।

২০১৪ ও ২০১৮-তে মানুষের ভোটেরও প্রয়োজন হয়নি অনেক এমপির। তাই উন্নত সমাজ, নীতি, আদর্শের কথা এসব প্রার্থীর কাছে কোনো বিষয় নয়। বহুদিনের বিরোধ যেটা শত্রুতায় পরিণত হয়েছে। দল যখন দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতার অনুমোদন দিয়েছে, তখন আর কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছে না কেউ। সর্বশক্তি নিয়ে একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

বিএনপিবিহীন যে নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক করার উদ্দেশ্য ছিল, বিদ্রোহের এই অনুমোদন সেটা এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। নিজেদের মধ্যেই একটি নির্বাচন, কিন্তু তবুও শান্তি নেই। এতে নির্বাচনী ব্যবস্থাই প্রশ্নের মধ্যে পড়ছে। শুধু গণতন্ত্র নয়, এই বোমা-বন্দুকের শক্তির সামনে আওয়ামী লীগের নিজস্ব অস্তিত্বের প্রশ্নটিও সরিয়ে রাখা যাচ্ছে না। এসব প্রার্থী নির্বাচনের মাঠে নেমে মানুষের উদ্দেশে কিছু বলছে না। মানুষকে কোনো নতুন কথা, নতুন স্বপ্ন এরা জানাতে পারছে না। শুধুই একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার ছড়াচ্ছে। তীব্র বিরোধ আর কদর্য ভাষার প্রয়োগে নিজেদের রাজনীতির কথা তো ভুলেছেনই, হারিয়ে গিয়েছে উন্নয়নের গল্পও।

আওয়ামী লীগের মূল কথা উন্নয়ন। শেখ হাসিনার সরকার অবকাঠামো খাতে এত উন্নয়ন করেছে যে, তার এক লম্বা ফিরিস্তি মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু মাঠে নিজেদের সংঘাতে আড়ালেই থাকছে উন্নয়নের কথা। ভোটের ফলাফল জানাই। আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় আসছে। কারণ শেখ হাসিনার এ নির্বাচনী রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সবাই শাসক দলের। দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নিজস্ব দলের স্বতন্ত্র, ১৪ দলের শরিক দলের প্রার্থী, অনুগত বিরোধী দলের প্রার্থী, নতুন সৃষ্ট দল ও আন্দোলনের মাঠ থেকে সরাসরি নির্বাচনের নৌকায় উঠে পড়া সবাই নিজেদেরই লোক। এখন দেখার পালা, এই নিজেদের মধ্যকার নির্বাচনটাও সুষ্ঠুভাবে হতে পারে কি না।

বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ, সমালোচকরা এতদিন দুর্নীতি, অনিয়ম আর সন্ত্রাসের অভিযোগ করেছে। এখন নিজেরাই নিজেদের দুর্নীতিবাজ বলছেন, দখলবাজ বলছেন, সন্ত্রাসী বলছেন এবং বিএনপি-জামায়াত বলে তো গালি দিচ্ছেনই। অসাধারণ এক রাজনীতি। এ এক নতুন ধরনের দলীয় গণতন্ত্র। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু মানুষকে উন্নয়ন বোঝাতে যে শান্তি এবং পরিবেশ লাগে, সেটা দলের লোকেরাই নষ্ট করছেন। যদি এ ভোট রাজনীতি আওয়ামী লীগ মডেলের রাজনীতি হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে জনপদে জনপদে অশান্তির মডেলটাও দাঁড়িয়ে যাবে।

গত ১৫ বছরের স্থানীয় সরকারের যত নির্বাচন হয়েছে, সবগুলোতে আওয়ামী লীগের কোন্দল আর সহিংসতায় দলীয় কর্মীদের রক্ত ঝরেছে। সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে চলে এলো সংসদ নির্বাচনে। তাই ভোট উৎসবের মেজাজ নিয়ে শঙ্কা আছে। বলা হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ভোট পড়েছে এমনটা দেখাতে হবে। কিন্তু দলীয় কর্মী-সমর্থকরাই যখন বিভ্রান্ত আর চিন্তিত নিরাপত্তা নিয়ে, ভোটের পরিবেশ নিয়ে, তখন সাধারণ মানুষ কি ঝুঁকি নেবে ভোট দেওয়ার?

নিশ্চিত বোঝা যাচ্ছে যে, নির্বাচন নিয়ে বিএনপি তার মিত্ররা যেসব অভিযোগ করত, নির্বাচনের পর তার চেয়েও বেশি অভিযোগ করবে পরাজিত দলীয় প্রার্থীরা। দলের একপক্ষ, সরকারি মহল যখন বলবে ভোট হয়েছে নির্বিঘ্নে, তখন আরেকপক্ষ অভিযোগের পর্বত হাজির করবে। আশঙ্কা এই যে, নির্বাচনটা শেষ পর্যন্ত কাঠগড়ায় তুলবে শাসক দলকেই। তবে হুমকি, মারধর, গুলি, বোমার সামনে দাঁড়িয়েও সংঘাতময় এলাকা থেকে যারা জিতে আসবেন তারা দল ও নেতা আর মানবেন কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট ভাবনা আছে। আর কত কর্মী-সমর্থক যে চূড়ান্ত অবসাদে চলে যাবেন না, সেটাই বা কে জানেন।

ভোটের পর অর্থনীতির অবস্থাও বড় বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। রোজগারহীন বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির জন্য, যার কথা সরকার নিজেও অস্বীকার করছে না। অস্বীকার করছে না ব্যাংক খাতে চলা অনিয়ম আর দুরবস্থার কথা, টাকা পাচারের কথা, দুর্নীতির কথা। তবে এসবের সমাধানে দাওয়াইটা কী, সেটা পরিষ্কার করেনি ইশতেহারে। শেয়ারবাজার নিয়ে তো আলোচনাই হয় না, কারণ ২০১০ সালে এটি ধ্বংসের পর আর উঠে দাঁড়ায়নি।

উন্নয়নের বিশাল সব যজ্ঞের মধ্যে মানুষের চিন্তা বেশি খাদ্য নিয়েই। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, দেশের ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় থাকেন। তার অর্থ হলো ১৭ কোটি জনসংখ্যার এ দেশে প্রায় পৌনে ৪ কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় ভোগে। একই বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্যের বাড়তে থাকা দাম বাংলাদেশের ৭১ শতাংশ পরিবারের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা শুরু হয়েছিল করোনাকালের শুরুতে এবং সেটা এখনো চলছে। অথচ এর মধ্যে সাধারণ মানুষের আয় সেভাবে বাড়েনি।

অর্থাৎ সব মিলিয়ে অর্থনীতির ছবিটা মোটেই ভালো নয়। এটি ভোটের পর সরকারের চিন্তা বাড়াবে বলেই ধারণা। বেহাল অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পথ হলো সুশাসন, যা এক বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতিতে প্রাণ ফেরাতে জোর দেওয়া হতে পারে কৃষি, পরিকাঠামো ও কর্মসংস্থান তৈরিতে। কিন্তু ডলার সংকটের এমন বাজারে বিনিয়োগ না হলে, ব্যবসা না হলে কর্মসংস্থান হবে কোথা থেকে?

রাজনীতিবিদরা কথার পাহাড় গড়ে কত কিছু চাপা দিয়ে রাখেন। তাতে কিঞ্চিৎ শ্রুতিসুখ মিললেও কোনো সমাধানসূত্র মেলে না। কিন্তু অনেক কিছু চেপে রাখা যায় না, যেমন যায়নি অর্থনীতির অবস্থা। জোর করে বিরোধী কণ্ঠ চেপে রাখা যায়, কিন্তু জোর করে ডলার বাড়ানো যায় না। মন্দাক্রান্ত অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটাবে কী করে, সেটাই দেখার অপেক্ষায় জাতি।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার ‘নিখোঁজ’ 

নির্মাণাধীন সেতুর দড়ি ছিঁড়ে নিহত ৭, নিখোঁজ ৯

ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে দেশ ছাড়ার মতো অবস্থায় তারকা খেলোয়াড়

নির্বাচন বিলম্বিত হলে পতিত স্বৈরাচার লাভবান হবে : ডা. জাহিদ 

থানা হাজতে যুবকের মৃত্যু, পুলিশ বলছে ‘আত্মহত্যা’

সাড়ে ১০ কেজি হরিণের মাংসসহ শিকারি আটক

বাড়িভাড়ার কথা বলে ঘরে প্রবেশ, হাত-পা বেঁধে লুটের পর বৃদ্ধাকে হত্যা

লরি উল্টে প্রাইভেটকারের ওপর, নিহত ৪

‘২৪ ঘণ্টা সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকবে সাদা পাথর এলাকা’

তোপের মুখে স্বাধীন খসরু

১০

দুটির বদলে একটি মিষ্টি পেয়ে মন্ত্রীকে ফোন, অতঃপর...

১১

টানা ১০ দিন ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস

১২

জাহান্নামের দরজা শিগগির খুলবে : ইসরায়েল

১৩

আ.লীগ কর্মীর বাড়িতে মিলল যুবকের অর্ধগলিত মরদেহ 

১৪

ক্রিকেট ইতিহাসে এই রেকর্ড করতে পারেনি আগে কেউ

১৫

সিনেমা বানিয়ে তাক লাগাতে চান জয়

১৬

জাতীয় দলেও নেই, ক্লাবেও নেই—গারনাচোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার

১৭

বৈরী আবহাওয়াও আটকাতে পারেনি তাদের

১৮

দেয়াল টপকে সংসদে ঢোকার চেষ্টা, অভিযুক্ত আটক

১৯

উদ্বোধনের পরদিনই ৯২৫ কোটি টাকার সেতু থেকে ল্যাম্পপোস্টের তার চুরি

২০
X