ফ্রাঞ্জ কাফকার একটি বিখ্যাত উদ্ধৃতি: ‘আপনি যা-ই ভালোবাসবেন, তা হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল, তবে শেষাবধি অন্য যে কোনোভাবে সেই ভালোবাসা ফিরে পাবেন।’ আমি বিশ্বাস করি বিদ্বেষ, ঘৃণা, রোষ, এমনকি হিংস্রতাসহ অন্য যে কোনো কর্তৃত্বমূলক আচরণ ও অনুভূতির ক্ষেত্রেও এ নীতিটিই প্রযোজ্য।
মার্কিন কর্মকর্তাদের এটা স্মরণে রাখা উচিত যে, তারা গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি গণহত্যা অব্যাহত রাখতে সব রকমের সহায়তা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে কাজটি তারা করছেন—তা হচ্ছে, ইসরায়েলকে মার্কিনিদের বিলিয়ন ডলারের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা। গাজায় মানুষের রক্তগঙ্গার প্রবাহকে আরও তীব্রতর ও সহজতর করতে আমেরিকার এ প্রত্যক্ষ ভূমিকা সারা বিশ্ব দেখছে, শুনছে, অনুভব করছে আর তারা দিন দিন ক্ষুব্ধ হচ্ছে।
গত ডিসেম্বরে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস স্যাটেলাইট ডাটা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে একটা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, গাজায় ইসরায়েলের যে সামরিক অভিযান চলছে, তা ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সিরিয়ার আলেপ্পো ধ্বংসের চেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক ও মারাত্মক। এ আগ্রাসন ইউক্রেনের মারিওপোল অথবা আনুপাতিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিতে মিত্রবাহিনীর বোমাবর্ষণকে হার মানিয়েছে। এমনকি ‘এখন সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক আগ্রাসনের মধ্যে রয়েছে’।
ফিলিস্তিনি ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে হাজার হাজার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজ অসংখ্য মানুষ। তার চেয়ে অধিকসংখ্যক মানুষকে আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। এদের মধ্যে হাজার হাজার শিশুও রয়েছে। ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে, অগণিত শিশু ‘কারও একটি হাত, কারওবা একটি পা হারানোর যুদ্ধ করছে’।
গাজার আর্তনাদ টেলিভিশনসহ সম্ভাব্য প্রতিটি যোগাযোগমাধ্যমে দেখতে পারছে পুরো বিশ্ব। গাজার শিশুদের পাশাপাশি পুরো বিশ্ব যেন সেই আর্তনাদ উপলব্ধি করতে পারছে। কারণ তারা কেউই এ গণহত্যা থামাতে অথবা এ নিপীড়নের কিছুটা স্তিমিতও করতে পারছে না। তারপরও অল্প কিছু দেশ ছাড়া যখন সব ইউরোপীয় দেশ এ যুদ্ধ বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে বিশ্বের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে এবং একটি কার্যকর যুদ্ধবিরতির দাবিতে সোচ্চার হয়েছে, তখনো ওয়াশিংটন এ আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করে চলেছে।
গত ১৮ অক্টোবর একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নেওয়া প্রথম গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ বা প্রচেষ্টাকে তারা সরাসরি প্রত্যাহার করেছে। সে সময় জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড তার দেশের ভেটো ব্যবহারকে ন্যায্যতা দেন এই বলে যে, ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার জন্মগত অধিকার রয়েছে, যা সংরক্ষিত আছে জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদে।’ একই যুক্তি মার্কিন কর্মকর্তারা পুনরাবৃত্তি করেছেন বহুবার। যখন গাজা ট্র্যাজেডির ব্যাপ্তি খোদ মার্কিনিরাসহ বিশ্বের সবার কাছেই পরিষ্কার ছিল, তখনো মার্কিনিদের একই অবস্থান ছিল।
তাদের এই স্বপক্ষের বা পক্ষপাতদুষ্ট যুক্তি পরিষ্কারভাবে আন্তর্জাতিক এবং মানবাধিকার আইনের বিরুদ্ধে। মার্কিনিদের এ অবস্থান যুদ্ধ ও সংঘাতের সময় বেসামরিক লোকদের লক্ষ্যবস্তু করা এবং যুদ্ধের শিকার বেসামরিক ব্যক্তিদের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোকেও কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করার শামিল। প্রকৃতপক্ষে গাজা যুদ্ধের শিকার বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক এবং নিহতদের ৭০ শতাংশের বেশি নারী ও শিশু। এ ছাড়া ইসরায়েলি নির্মমতায় গাজার বেঁচে থাকা ব্যক্তিরা এই মুহূর্তে লড়াই করছে একটি প্রকৃত দুর্ভিক্ষের সঙ্গে। এটি ফিলিস্তিনের আধুনিক ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা।
এমন অবস্থায় ইসরায়েল অমানবিকভাবে খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি ও অন্যান্য জরুরি সরবরাহের প্রবেশাধিকার রোধ করে চলেছে নানাভাবে। তারা এ বিষয়ে ওয়াশিংটনের নিজস্ব আইনও লঙ্ঘন করছে। মার্কিন ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাক্ট (ধারা ৬২০আই) এ বিষয়ে বলছে, ‘এমন কোনো দেশকে কোনো সহায়তা প্রদান করা হবে না যদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট অবগত থাকেন যে, সেই দেশের সরকার মার্কিন কোনো মানবিক সহায়তার পরিবহন বা বিতরণ ব্যবস্থাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাধা দিয়েছে বা অন্যভাবে বিধিনিষেধের আওতায় এনেছে।’
অত্যন্ত দুঃখজনক, মার্কিনিরা মৌলিক মানবিক আইন মেনে চলতে ইসরায়েলকে চাপ দেওয়া দূরের কথা, এ বিষয়ে ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি। সবচেয়ে খারাপ কাজ যেটা তা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলকে এ ধ্বংসাত্মক যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করার জন্য প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম সরবরাহ করে চলেছেন।
ইসরায়েলের একটি গণমাধ্যম ‘চ্যানেল ১২’-এর ২৫ ডিসেম্বরের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ২০টি জাহাজ এবং ২৪৪টি মার্কিন বিমান ইসরায়েলকে ১০ হাজার টনেরও বেশি অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। এ সামরিক সরবরাহের মধ্যে রয়েছে কমপক্ষে ১০ লাখ ২ হাজার পাউন্ডের বাঙ্কার বাস্টার বোমা। এসব বোমা ইসরায়েলি যুদ্ধের পুরোটা সময় বারবার ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলোর সাহায্যে প্রতিবার শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আহত করা হয়েছে অগণিত।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র যে একমাত্র দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিয়েছে—তা হচ্ছে, ‘অপারেশন প্রোস্পারিটি গার্ডিয়ান’ নামে একটি কোয়ালিশন গঠন করা। সেখানেও মার্কিনিদের একমাত্র স্বার্থ বা উদ্দেশ্য রয়েছে—তা হচ্ছে, ইসরায়েলে যাতায়াত করা জাহাজসহ লোহিত সাগরে চলাচলকারী সব জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।
যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য অতীত থেকে কোনো শিক্ষা নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তারা শিক্ষা নিতে পারেনি ইরাকের বিরুদ্ধে তাদের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ থেকে, তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ তত্ত্ব থেকে; এমনকি ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন এবং ফিলিস্তিনি, আরব ও মুসলিমদের প্রতি শ্রদ্ধার মধ্যে ভারসাম্য তৈরিতে ব্যর্থতা থেকেও মার্কিনিরা শিক্ষা নিতে পারেনি। বিপরীতে কিছু মার্কিন কর্মকর্তা এসব বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
গত মাসে হোয়াইট হাউস এক সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি ঘোষণা করেন: ‘আমাকে বলুন, আমাকে আরেকটি জাতির নাম বলুন, যারা গাজার মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা দূর করতে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে। আপনারা তা পারবেন না। কোনোভাবেই পারবেন না।’ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তথাকথিত বোবা বোমা, স্মার্ট বোমা, বাঙ্কার বাস্টার এবং হাজার হাজার টন বিস্ফোরক কীভাবে গাজা এবং তার সন্তানদের ‘দুঃখ ও যন্ত্রণা দূর করছে’?
কিরবি যদি গাজায় গণহত্যায় তার দেশের ভূমিকা সম্পর্কে অবগত না থাকেন, তাহলে ধরে নিতে হবে আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতির সংকট আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি শোচনীয়। যদি তিনি সত্যিই জানেন, (তার প্রকৃতই জানা হওয়া উচিত) তবে এটা নিশ্চিতভাবেই জানতে পারবেন যে, তার দেশের নৈতিক সংকট আধুনিক ইতিহাসে তর্কাতিতভাবে নজিরবিহীন।
মার্কিন রাজনীতিতে সমস্যা হচ্ছে, বিশেষ করে প্রশাসনিক বাস্তবতায় একটি বিভাজিত দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান। খেয়াল করলে দেখবেন, তারা গভীরভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে যে কীভাবে তাদের সক্রিয়তা ও নিষ্ক্রিয়তা ভবিষ্যৎ নির্বাচনে তাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রভাবিত করবে। কিন্তু আমেরিকানদের মধ্যে যারা তাদের দেশ ও বিরাট পরিবর্তনশীল মধ্যপ্রাচ্য এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে তাদের অবস্থান সম্পর্কে চিন্তা করেন, তাদের মনে রাখা উচিত যে, ইতিহাস প্রতি চার বছরে একবার নভেম্বরের একটি নির্দিষ্ট তারিখে (মার্কিন নির্বাচন) শুরুও হয় না আবার শেষও হয় না।
কাফকা যথার্থই লিখেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত, ভালোবাসা অন্যভাবে ফিরে আসবে।’ তবে এটিও স্মরণে রাখা উচিত যে, সহস্র উপায়ে ঘৃণাও ফিরে আসতে থাকে। অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে এই উপলব্ধিটি বেশি করে যুক্তরাষ্ট্রের নিজে থেকেই হওয়া উচিত।
লেখক: আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেটেড কলামিস্ট, মিডিয়া পরামর্শদাতা, বেশ কয়েকটি বইয়ের লেখক এবং PalestineChronicle.com এর প্রতিষ্ঠাতা। ২০ বছরেরও অধিক সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে লিখছেন। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন সঞ্জয় হালদার