নতুন কারিকুলাম যেহেতু পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে, সেহেতু এ বিষয়ে মানুষের মতামত, গঠনমূলক আলোচনা বিবেচনা করার অবকাশ রয়েছে।
কারিকুলাম প্রণয়ন: কারিকুলামের পরিবর্তন-পরিবর্ধন সংযোজন-বিয়োজন একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। তবে তারও একটি নিয়ম আছে। একবারেই আমূল পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জনমনে প্রশ্ন জাগে। বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথা বলা, কারিকুলামের শ্রেণিভিত্তিক ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কারিকুলাম পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, পরিবর্তনের সঙ্গে উন্নয়নের পথে চলার মতো, দক্ষ জনশক্তি তৈরির ভাবনাকে সামনে রেখে এ কাজটি করা হয়েছে। জীবন-জীবিকার পরিবর্তন প্রযুক্তির উন্নয়ন, বিশ্বায়ন ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অভিঘাত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশের কারণে কর্মসংস্থান ও দেশের উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য, জ্ঞান দক্ষতা মূল্যবোধ ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানবিক, বৈশ্বিক ও দেশপ্রেমিক নাগরিক গড়ার জন্য অভিজ্ঞতাভিত্তিক নতুন এ কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা গেলে প্রাইভেট, কোচিং ও গাইড বইয়ের দৌরাত্ম্য কমবে।
নতুন কারিকুলামের প্রধান তিনটি বিষয়—১. কনটেন্ট/কারিকুলামের বিষয়বস্তু; ২. শিখন প্রক্রিয়া/ পাঠদান কার্যক্রম; ৩. মূল্যায়ন/ফলাফল নির্ধারণ।
কনটেন্ট/কারিকুলামের বিষয়বস্তু: বিষয়গুলোর মধ্যে জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, এটি জানা, বোঝা ও শেখার জন্য শিখন পদ্ধতিটিও হচ্ছে আলাদা। যে পদ্ধতিতে থাকবে না অতিরিক্ত নম্বরের জন্য অসম প্রতিযোগিতা, শিক্ষার্থী শুধুই পরীক্ষার্থী হবে না। পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য কতগুলো প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করা, পরীক্ষায় অসৎ পথ অনুসরণ, প্রাইভেট, কোচিং আর গাইড বইয়ের নির্ভরতা কমবে, সাশ্রয় হবে অভিভাবকের শিক্ষা খরচের, তবে হাতেকলমে এবং ব্যবহারিক ও গবেষণা কাজের জন্য অর্থের চাপ প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়বে। উপকরণের ব্যবহার বাড়বে। শিক্ষা হবে আনন্দময় যাত্রা বা পথচলা। এই শিখন প্রক্রিয়ায় প্রথমেই প্রয়োজন হবে বুদ্ধির, শিক্ষার্থীদেরই সেই বুদ্ধি খাটাতে হবে। মাধ্যমিকে বইয়ের সংখ্যা কমে ১০টি হয়েছে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আবশ্যিক বিষয় হবে তিনটি এবং নৈর্বাচনিক বিষয় হবে তিনটি।
শিখন প্রক্রিয়া/পাঠদান কার্যক্রম: এ কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার্থীর পরিবর্তে শিক্ষার্থী করার ভাবনা থেকে কনটেন্ট প্রণয়ন এবং শিক্ষকদের শিক্ষক থেকে ফ্যাসিলিটেটর করা হয়েছে। বছরব্যাপী মূল্যায়নের চিন্তা থেকে শিখন কার্যক্রমের নির্দেশনা প্রস্তুত করা হয়েছে। শিখন কার্যক্রমে শ্রেণি পাঠদান সময় বৃদ্ধি করে এক ঘণ্টা (টিফিনের আগে) ৫০ ও ৪৫ মিনিট (টিফিনের পরে) করা হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা আগের ৬০ জনের স্থলে ৫৫ জন করা হয়েছে। শিক্ষকদের প্রথমে মুক্তপাঠে অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইন প্রশিক্ষণ পরে পাঁচ দিনের স্থলে সাত দিনের প্রশিক্ষণ করা হয়েছে। ২০২৩ সালে ক্লাস শুরুর পর জানুয়ারি মাসে এবং প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের জুন মাসে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তবে প্রশিক্ষণে মূল্যায়ন-সংক্রান্ত বিষয়ে তেমন ধারণা দেওয়া হয়নি, পরে চিঠির মাধ্যমে নির্দেশনা দেওয়া হলেও শিক্ষকদের বোধগম্য হয়নি। দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাব রয়েছে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সংখ্যাও বাড়ানোর প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক শিক্ষার্থীদের কাজ বাড়বে, বাড়বে সময় ঘণ্টা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ের জন্যই। শিক্ষকদের (ওয়ান ওয়ে) লেকচার মেথডের বিপরীতে ফ্যাসিলেটেটরের দায়িত্ব পালন করতে হবে। শিক্ষার্থীরা গ্রুপ ডিসকাশন/দলীয় কাজ, কাজের প্রক্রিয়া ও ফলাফলের উপস্থাপন অ্যাসাইনমেন্ট, তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করবে, ক্লাসরুমের বাইরে ল্যাব এবং বিষয়বস্তুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান/স্থলে গিয়ে বিষয়টি জানার চেষ্টা করবে এবং অর্জিত জ্ঞানের আলোকে বাস্তবে কোনো কাজ করার চেষ্টা করবে। প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে কার্যসম্পাদনের মাধ্যমে সে তার যোগ্যতা তৈরি করবে। এ কাজে শিক্ষর্থীরা আনন্দিত, কারণ আগে শিক্ষর্থীরা ভয়ে বা লজ্জায় ক্লাসে যতটা ফ্রি হতে পারত না, এখন মুক্তভাবে সে কাজগুলো করতে পারে। আনন্দের সঙ্গে শেখার পরিবেশ পাচ্ছে, মুখস্থ করার ভীতি দূর হয়েছে। পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের জন্য টিজি/টিচার গাইড রয়েছে, যে বিষয়ভিত্তিক পারদর্শিতার আলোকে পিআই/ পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর রয়েছে, সেসব ইন্ডিকেটর বাস্তবায়নের জন্য শিখন কার্যক্রম পরিচালনা করবে। নতুন নতুন তথ্যের প্রয়োজনে ইন্টারনেট ব্যবহারে ল্যাপটপ, ট্যাব ও মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রয়োজন। তবে এটা ব্যবহারে সতর্ক হতে পরিবার ও সরকারের ভূমিকা বাড়ানোর প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বয়স ও বোঝার ক্ষমতা বিবেচনা করে কিছু অ্যাপ পরিবার এবং সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
মূল্যায়ন/ফলাফল নির্ধারণ: নতুন কারিকুলামে এসএসসি পরীক্ষার আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা থাকছে না। তবে অনেকেই মনে করেন, প্রাথমিক স্তরে শিক্ষা (প্রথম-অষ্টম শ্রেণি) সমাপ্তিতে একটি পরীক্ষা রাখা উচিত, আর্থসামাজিক বিবেচনায় ঝরে পড়ার কারণে একটি স্বীকৃতি থাকবে। প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে বছরে মূল্যায়ন (পরীক্ষা) হবে দুই ষাণ্মাসিক (ছয় মাস) ও বার্ষিক সামষ্টিক (বছরে) মূল্যায়ন হবে। প্রাথমিক স্তরে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে বছরব্যাপী ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতেও আপাতত একইভাবে সম্পাদন করা হবে। দশম শ্রেণির পাঠ্য বিষয়ের ওপর এসএসসি পরীক্ষা হবে। নবম ও দশম শ্রেণিতে জীবন-জীবিকা বিষয়ে বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে কৃষিশিল্প বা সেবা খাতের একটি বিষয় পড়তে হবে, যেটি শেখার মাধ্যমে ভবিষ্যতে যাতে কাজ করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।
সমাপনী মূল্যায়নে দলীয় আলোচনা, মৌখিক পরীক্ষা ও ডেমনেস্ট্রেশন (উপস্থাপন) অ্যাসাইনমেন্ট, প্রজেক্ট ও তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। প্রত্যেকটি বিষয়র জন্য দুই-তিন পাতার মূল্যায়ন শিট করা হয়েছিল। শিক্ষার্থীদের নৈপুণ্য অ্যাপে ১৫টি তথ্যে এবং পাঠদানকারী শিক্ষকদের ১৫টি তথ্যের আলোকে আইডি ও পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকরা তাদের আইডি এবং পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের চ্যাপ্টার শেষে শিক্ষার্থীদের প্রারম্ভিক যোগ্যতার জন্য চতুর্ভুজ, বিকাশমান যোগ্যতার জন্য বৃত্ত আর দক্ষতার জন্য ত্রিভুজ নৈপুণ্য অ্যাপের মাধ্যমে প্রদান করবেন। ষাণ্মাসিক ও বার্ষিক মূলায়নের সংকেতগুলো (চতুর্ভুজ, বৃত্ত ও ত্রিভুজ) আপলোড দিলে মাউশি থেকে মূল্যায়ন শিট তৈরি করে দেবে সেখান থেকে ডাউনলোড করে নিতে হবে। ছয় মাসে হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন পিআই বা পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটরের মাধ্যমে আর বার্ষিক মূল্যায়ন হবে পিআই এবং বিআই/বিহেবিয়ারের ভিত্তিতে।
সমস্যাসমূহ: রান্না-বাড়া, বয়ঃসন্ধিকাল বাড়িতে না পড়া এবং মোবাইল ফোন ব্যবহার সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগ উঠেছে। মূল্যায়নে শিক্ষকদের পক্ষ থেকে স্বজনপ্রীতি ঘটতে পারে এমন অভিযোগ আছে। তবে নৈপুণ্য অ্যাপে প্রেরিত তথ্যের আলোকে মাউশি থেকে মূল্যায়ন শিট হলে স্বজনপ্রীতির সুযোগ থাকবে না। শিক্ষকদের কর্মঘণ্টা ও কাজের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা হয়নি। প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের উপকরণগত খরচ বেড়েছে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের অনুপাত ৫৫:১ করা হয়েছে। এই অনুপাতে শিখন প্রক্রিয়া কার্যকর করা কঠিন। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের অনুপাত ৩০:১ হলে ভালো হয়, ক্লাসরুমের সাইজ ও বর্তমান উপকরণের পরিবর্তন করা লাগবে। মূল্যায়ন-সংক্রান্ত বিষয়ে ধারণা এখনো পরিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। বৈশ্বিক পর্যায়ে মূল্যায়নের সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য এটাকে আপডেট করার প্রয়োজন। জাতীয় বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্যের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
সুপারিশ: নতুন বিশ্বব্যবস্থা কর্মসংস্থান ও উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কনটেন্টগুলো অনেকটাই ইতিবাচক। তবে তার প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে বিশেষ করে শিখন কার্যক্রমে বড় ধরনের দুর্বলতা আছে। আর এ কাজ করতে মূল চালিকাশক্তি শিক্ষক। এ শিক্ষকদের মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার জন্য আর্থিক মোটিভেশন যেমন প্রয়োজন। সেইসঙ্গে যোগ্য শিক্ষকের জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দলবাজি, স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক লেনদেনমুক্ত করা জরুরি। অবসরের দোরগোড়ায় থাকা এবং অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যে অনীহার কারণে শিখন কার্যক্রমে দুর্বলতা আছে। এ সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক মানে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ফলাফল মূল্যায়নে আন্তর্জাতিক সূচকের সঙ্গে সমন্বয় এবং সহজতর করা প্রয়োজন। অভিভাবকদের মধ্যে বিষয়টি প্রচারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
লেখক: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস)