সুভাষ সিংহ রায়
প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ০২:৪৪ এএম
আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ১০:৪৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যা দেখি যা শুনি

দুঃসময়ে বিএনপি

দুঃসময়ে বিএনপি

বিএনপির জন্ম কেন হয়েছিল তা বোধকরি সামান্য রাজনীতি জ্ঞানসম্পন্ন সব মানুষের জানা আছে। বাংলাদেশে রাজনীতি গভীরভাবে যারা বিশ্লেষণ করেন, তাদের আবার তিনটি ধারা আছে। একটি হচ্ছে স্বাধীনতার পক্ষের বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারা; দ্বিতীয়টি বাংলাদেশি মোড়কে পাকিস্তানপন্থি ধারা আরেকটি গত কয়েক বছরে সৃষ্ট প্রগতিবাদী মোড়কে আওয়ামীবিরোধী ধারা। শেষোক্ত ধারার মানুষ বেশ চালাক-চতুর। তাদের প্রতিনিধিদের একটা বড় অংশ সাবেক সোভিয়েতপন্থি এবং আশ্চর্যজনকভাবে সাবেক চীনাপন্থিদের সঙ্গে গভীর মিল লক্ষ করা যায়। কিন্তু সাবেক চীনাপন্থিদের অপ্রকাশ্য ধারার মানুষ এখন আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারের দেশগুলোর চলতি হাওয়ার গণতন্ত্রের সঙ্গে মিলেমিশে আছে। সত্তর দশকে এই ধারার পূর্বসূরিরা চারু মজুমদারের নকশাল বাড়ির আন্দোলনের সমর্থক ছিল; কানু সান্ন্যালদের মতো করে কথা বলতেন, বলতেন চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সেনাশাসকদের পক্ষে জনমত গঠনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছিলেন। ড. হুমায়ুন আজাদ তার প্রবচনগুচ্ছে লিখেছিলেন: ‘বাঙলার বিবেক খুবই সন্দেহজনক। বাঙলার চুয়াত্তরের বিবেক সাতাত্তরে পরিণত হয় সামরিক একনায়কের সেবাদাসে।’

বাংলাদেশে গত ১০-১৫ বছরে বেশ কয়েকজন ইয়ার লতিফের জন্ম হয়েছে। আমরা ইতিহাস পাঠ থেকে জানতে পারি, নবাব সিরাজউদ-দৌলার বিরুদ্ধে যারা যারা ষড়যন্ত্র করেছিল তাদের মধ্যে মীরজাফর, উমিচাঁদ, রায় দুর্লভ, জগৎশেঠ যেমন ছিল। তাদের মধ্যে ভয়ংকর ছিল ওই সময়ের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ইয়ার লতিফ। বাংলাদেশে গত ৫২ বছরে অনেক ইয়ার লতিফের জন্ম হয়েছে, আর ইয়ার লতিফরা সম্মিলিতভাবে বিএনপির জন্মের পেছনে ছিল। এখনো আছে সক্রিয়ভাবে। বাংলাদেশে ইয়ার লতিফরা একের পর এক ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে। এ ধারার প্রথম সূচনা করা হয়েছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাত্র ১০ মাসের মাথায় আওয়ামী ধারার থেকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে যারা বিভাজনের ধারা শুরু করেছিল তাদের দিয়ে। এটা ছিল চারু মজুমদারের নকশাল বাড়ি আন্দোলনের বাংলাদেশি সংস্করণ। কেউ যদি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ‘হক কথা’ আর জাসদের মুখপত্র ‘গণকণ্ঠ’র প্রতিটি সংখ্যা নতুন করে পড়তে পারেন, তাহলে যে কেউ বিস্মৃত হবেন। তাকে কেউ কেউ মাওবাদী মওলানা বলতেন। কিছুদিন আগে দুটি বই পড়লাম, মহিউদ্দিন আহমেদের লেখা ‘৭৩-এর নির্বাচন’ ও ‘৭৪-এর দুর্ভিক্ষ’। দুটি বইয়ের সব তথ্যই বলতে গেলে ‘গণকণ্ঠ’ থেকে উৎকলন করা। এখনকার দিনে একটা পারসেপশন তৈরি হয়েছে, বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩-এর নির্বাচনকেও বিতর্কিত করার অক্লান্ত প্রচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের সময় প্রথম বিতর্ক তৈরি করা হয় আওয়ামী লীগের ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে। জাসদের তৎকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ উচ্চ আদালতে মামলা করেন আওয়ামী লীগকে নৌকা প্রতীক দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে। সে সময়কার প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মোহাম্মদ ইদ্রিস স্পষ্ট রায় দিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক ‘নৌকা’ আগের নির্বাচনে ছিল, অতএব এটি সিদ্ধান্তহীনতার কোনো অবকাশ নেই। শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর দ্বৈত বেঞ্চ রায় দেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক ‘নৌকা’ থাকবে। আশির দশকের শুরুতে দেশবিরোধী শক্তি বুঝতে পেরেছিল তাদের বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে তারা বিচলিত হয়ে যায়। তারা রাষ্ট্র কাঠামো তো দখল করেই, সঙ্গে সঙ্গে সমাজ কাঠামোর ভেতরে ষড়যন্ত্রের কালো মাকড়সার জাল বিস্তার করতে থাকে। এবং রাষ্ট্র কাঠামো পাকিস্তানিকরণ করার বন্দোবস্ত করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই জনপদের মানুষের অনুভূতির সঙ্গে মিশে যান। সেটা আর কেউ না বুঝলেও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান বুঝেছিলেন। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মওলানা সাহেব লন্ডন থেকে ঢাকা ফিরে এসে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, যে বাজে গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধান রচিত হয়েছে, তার অধীনে কোনো নির্বাচন তিনি মানেন না। সেই সংবিধানের অধীনে নির্বাচন হলে আগে যারা ক্ষমতায় ছিল তারা আবার ক্ষমতায় আসবে। অতএব, আওয়ামী লীগের অন্তর্নিহিত শক্তি তিনি জানতেন। মওলানা ভাসানীর সবচেয়ে কাছের মানুষের একজন মশিউর রহমান যাদুমিয়া, তিনি ছিলেন সিনিয়র মিনিস্টার এবং প্রধান পরামর্শদাতা। জিয়াউর রহমানের পাকিস্তান সফরের সময় ১৯৭৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের ‘ডন’ পত্রিকায় জিয়াউর রহমান ও মশিউর রহমান যাদুমিয়ার একটি ছবি ছাপা হয়েছিল এবং প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘Era Of Pakistan’।

পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭৫ সালের ১৮ এপ্রিল কাবুলে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘১৯৭২ সালে আমি সিমলায় গিয়েছিলাম, কারণ তখন আমাদের শান্তি দরকার ছিল। কিন্তু এখন পাকিস্তানের চেয়ে ভারতেরই বেশি শান্তি দরকার। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখা এখন ভারত ও বাংলাদেশের নিজেদের স্বার্থের জন্যই দরকার।’ তিনি আরও বলেন, ‘শিগগির এ অঞ্চলে কিছু বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে।’ ভুট্টো ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশে সেনা অভ্যুত্থানের ইঙ্গিত এখানে দিয়েছিলেন ভাবলে সেটি হয়তো একটু বেশিই দূরদর্শিতা হয়ে যাবে, তবুও অনেকে এমন দাবি করেছেন। যা হোক, তিনি শুধু মোশতাক সরকারকে খুব দ্রুত স্বীকৃতি দিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং এ সরকারকে শক্তিশালী করতে তার পক্ষে যা করা সম্ভব, তার সবই করেছেন।

১৯৭৪ সালের জুন মাসে ভুট্টোর ঢাকা সফরে যে ১০৭ সদস্যবিশিষ্ট দল আসে, তার মধ্যে থাকা এক সাংবাদিক সফর শেষে করাচি ‘ডেইলি নিউজ’ পত্রিকায় বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের সম্ভাবনার কথা লিখেছিল। তার কাছে এ সম্ভাবনাকে চমৎকার মনে হয়েছিল। কেউ ভাবতে পারেন একজন পাকিস্তানির পক্ষে হয়তো সেনা অভ্যুত্থান ছাড়া ক্ষমতার পালাবদলের অন্য কোনো উপায় ভাবা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনায় যারা এক ধরনের অসুস্থ আনন্দ পেয়েছিল, এমন অনেক পাকিস্তানিই সেটি লুকিয়ে রাখতে পারেননি। পাকিস্তানিদের মধ্যে যারা তখনো ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে ঢাকায় যৌথ বাহিনীর কাছে পাকসেনার আত্মসমর্পণের অপমান ভুলতে পারেনি, তারা ভাবছিল এ রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাদের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু পাকিস্তানি সংবাদপত্র সেদিন শেখ মুজিবকে একজন ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তার মর্মান্তিক মৃত্যুকে বলে ‘পাপের শাস্তি’। জেড এ সুলেরির মতো পাকিস্তানের তখনকার শীর্ষ পর্যায়ের সবাই পাকিস্তানকে ভেঙে দুই টুকরা করার জন্য দায়ী বিশ্বাসঘাতক মুজিবের মৃত্যুতে সন্তুষ্ট ছিলেন। লাহোরের একটি দৈনিকে তিনি মতপ্রকাশ করেন যে, ‘যতক্ষণ মুজিব জীবিত থাকবেন, ততক্ষণ পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না।’ তার মতে, পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির আগেই বিনাশর্তে শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেওয়াটা ছিল একটি বড় ভুল। পাঞ্জাব শেখ মুজিবের বিনাশর্তে মুক্তি মেনে নিতে পারেনি। সুলেরির মতে, শেখ মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কোনোদিন দাঁড়াতে পারত না। অতএব, সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় জিয়াউর রহমান পাকিস্তানপ্রভুদের ক্রীড়নক হিসেবে সবসময় কাজ করেছেন। ১৯৭৮ সালে সমরপ্রভু যে সংগঠনটির জন্ম দেন তার নাম ‘জাগদল’ এবং পরে এটির নাম দেওয়া হয় ‘বিএনপি’। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়াকে ৫০ কোটি টাকা দিয়েছিল বলে সংস্থাটির তৎকালীন প্রধান লে. জেনারেল আসাদ দুররানি পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে ২০১২ সালে হলফনামা দিয়ে স্বীকার করেছিলেন। এই খবর বাংলাদেশের মিডিয়ায়ও প্রচারিত হয়েছিল। ২০১২ সালে ১৭ মার্চ ‘দ্য ডেইলি স্টার’ পত্রিকায় এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। মধ্যবয়সী কিছু শিক্ষিত মানুষ বিভ্রান্তিকর তত্ত্ব ও তথ্য নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে যাচ্ছে। গণমাধ্যমে তাদের কথা শুনে মনে হবে তারা সবজান্তা। কিন্তু ড. অমর্ত্য সেন তার আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘জগৎ কুটিন’ বইয়ে লিখেছেন: ‘আল বিরুনি লিখেছেন, ভারতীয় গণিত খুবই ভালো; কিন্তু এ দেশের মননজীবীরা অন্য একটি ব্যাপারে বিলক্ষণ গুণী; সেটি হলো, যে বিষয়ে কিছুই জানা নেই, তা নিয়েও অনর্গল বলে যাওয়ার ক্ষমতা।’ তাদের অধিকাংশ বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে যুক্ত হতে গিয়ে বিএনপি-জামায়াতের কুশীলব হয়ে গেছে। কিন্তু তারা এখন কালবেলায়; যেমন কালবেলায় বিএনপি।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাঙামাটিতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে দুদকের অভিযান

আর্জেন্টিনায় ম্যাচ চলাকালে সমর্থকদের তুমুল মারামারি

আশুলিয়ায় নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা জুয়েল গ্রেপ্তার

৬০০ কোটি আয় ছাড়াল রজনীকান্তের ‘কুলি’

শেখ হাসিনার বিচার চেয়ে ট্রাইব্যুনালে সাইদীর মামলার সাক্ষী সুখরঞ্জন বালি

গাজীপুরে সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

জাতিসংঘের প্রতিবেদন নিয়ে নির্দেশনা দিলেন হাইকোর্ট

ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট পেপারে প্রার্থীদের ছবি যুক্তের দাবি ছাত্র অধিকার পরিষদের

ভারতের জন্য আকাশসীমা বন্ধের মেয়াদ আরও বাড়াল পাকিস্তান

র‌্যাঙ্কিংয়ে উধাও রোহিত-কোহলির নাম, কারণ জানাল আইসিসি

১০

রাজসাক্ষী হতে চান পুলিশ সদস্য শেখ আফজালুল

১১

ভাঙন ভাঙন খেলায় দিশেহারা নদীপাড়ের মানুষ

১২

চালককে ওয়াশরুমে রেখে প্রাইভেটকার নিয়ে ছুটছিলেন তিন বন্ধু

১৩

নথি গায়েব করে ১৪৬ কোটি টাকার কর ফাঁকি / কর কমিশনার মো. মুস্তাকসহ ৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করছে দুদক

১৪

‎আশাশুনি সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের স্থায়ী ভবন নির্মাণে জরুরি আলোচনাসভা

১৫

দেবের প্রশংসায় ইধিকা

১৬

গ্যাসের ব্যথা ভেবে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ নিয়ে ঘুরছেন না তো?

১৭

ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ

১৮

বয়স ৪০ হলেও চাকরির সুযোগ, আবেদন করুন আজই

১৯

জ্বালানি তেলের দাম কমবে কবে

২০
X