মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৪, ০৪:৪৬ এএম
আপডেট : ০১ মার্চ ২০২৪, ০৭:৪২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সংযমের মাসে সংযত থাকুক বাজারদর

সংযমের মাসে সংযত থাকুক বাজারদর

কয়েক দিন বাদেই শুরু হবে পবিত্র মাহে রমজান। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন পবিত্র মাহে রমজানের। কিন্তু দুঃখজনকভাবে প্রায় প্রতি বছরই রমজান ঘনিয়ে এলে বাজারদরে অস্থিরতা দেখা দেয়। এবারও রোজার অনেক আগেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। দেশের খুচরা বাজারে চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তেল, তরিতরকারিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আগের তুলনায় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এবার ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুরের দামও ঊর্ধ্বমুখী। দিনভর রোজা রাখার পর সন্ধ্যায় ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুর। খেজুর ছাড়া ইফতারের কথা ভাবা যায় না। প্রায় সব রোজাদার খেজুর দিয়ে শুরু করেন ইফতার। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে রমজানে খেজুরের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। ফলে প্রতি বছরই এ সময়টায় খেজুরের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

বরাবরের মতো রোজা ও শবেবরাতের আগেই তেতে উঠেছে ভোগ্যপণ্যের বাজার। ব্যবসায়ীরা খুব কৌশলে কয়েক ধাপে এরই মধ্যে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। নিত্যদ্রব্যগুলোর দাম আকাশচুম্বী। এসব কারণে সেহরি ও ইফতারে বিশেষ বিড়ম্বনায় পড়তে হয় রোজাদারদের। কষ্ট ও দুর্ভোগ চরমভাবে বেড়ে যায় সাধারণ মানুষের। অথচ রমজান মাসে সবকিছু স্বাভাবিক থাকা উচিত। যেন মানুষ সহজে ইবাদত পালন করতে পারে। এ মাসে ইবাদতের বিশেষ ফজিলত রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রমজান মাসে যে ব্যক্তি একটি নফল আদায় করল, সে যেন অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করল। আর যে এ মাসে একটি ফরজ আদায় করল, সে যেন অন্য মাসের ৭০টি ফরজ আদায় করল। (শুআবুল ইমান : ৩/৩০৫-৩০৬)। এ মাসে তাই এমন পরিবেশ তৈরি করা উচিত, যেন মানুষ সব ঝামেলা থেকে মুক্ত থেকে বেশি বেশি ইবাদত করতে পারে। কিন্তু বর্তমানে রোজা এলেই মানুষকে ভাবনায় পড়তে হয় দ্রব্যমূল্যের বাড়তি দাম নিয়ে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৃথিবীতে আরবের পর সর্বাধিকসংখ্যক মুসলমানের বসবাস বাংলাদেশে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গর্বভরে বলতেন, ‘আমি মুসলমানের সন্তান মুসলমান। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র।’ অথচ আক্ষেপের বিষয় হচ্ছে, সুজলা-সুফলা এই দেশে, ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সমাজে রমজান এলেই অস্থির হয়ে ওঠে বাজার ও বাজারদর। অধিকাংশ মানুষ নামাজ আদায় করলেও জানে না ইসলামের চমৎকার ‘ব্যবসানীতি’, যা অনুসরণ করলে বাজারে ফিরে আসবে স্থিতিশীলতা; দূর হবে সব নৈরাজ্য ও প্রতারণা।

পার্থিব জীবন পরিচালনার জন্য অর্থ-সম্পদের প্রয়োজন পড়ে। আর অর্থ উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম ব্যবসা। ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল ব্যবসার গুরুত্ব অনেক। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৭৫)। রাসুলুল্লাহ (সা.) ব্যবসায়ীদের অনুপ্রাণিত করে বলেছেন, ‘তোমরা ব্যবসা করো, ব্যবসায় দশ ভাগের নয় ভাগ রিজিকের ব্যবস্থা আছে।’ (আল মুগনি : ১/৪১৯)। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছু নীতি-নৈতিকতার বিষয় রয়েছে। ব্যবসায় ধোঁকা, প্রতারণা, মজুতদারি, খাদ্যে ভেজাল মেশানো, মাপে কম দেওয়া, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি করা ইত্যাদি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এভাবে ব্যবসা করে উপার্জিত অর্থ হারাম বলে গণ্য হয়। ইসলামের ব্যবসা ও নৈতিকতা পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। ব্যবসায়ীকে অবশ্যই সৎ ও নীতিবান হতে হবে। ইসলাম ন্যায়-অন্যায়ের ব্যবধান নির্দেশ করে দিয়েছে এবং অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জনকে নিষিদ্ধ করেছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা একে অন্যের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কিন্তু তোমাদের পরস্পরের সম্মতিতে ব্যবসা করা বৈধ।’ (সুরা নিসা : আয়াত ২৯)

বাজারে কিছু পণ্যের দাম হুট করে চড়ে যায়। হঠাৎ ৩০ টাকার পণ্য ৩০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এর পেছনের কারণ সিন্ডিকেট। ব্যবসায়ী কুচক্রী মহল অনেক সময় পণ্য রপ্তানি করা বন্ধ করে দিয়ে গুদামজাত করে। পরবর্তীকালে যখন বাজারে পণ্যের সংকট দেখা দেয় তখন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করে তা তারা বাজারজাত করে। ফল দাঁড়ায়—পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী, যা ক্রয় করা সাধারণ জনগণের সাধ্যের বাইরে চলে যায়। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হয় নিম্ন, নিম্নমধ্য ও মধ্যবিত্ত জনগণ। তারা না পারে চড়া দামে কিনে নিতে আর না পারে কিনে জমা করে রাখতে। অথচ ইসলামে এমনটি করা সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও হারাম বলেছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘শুধু পাপী ব্যক্তিই মজুতদারি বা সিন্ডিকেট করে থাকে।’ (মুসলিম : ১৬০৫)

সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করে যারা টাকা উপার্জন করে, তারা দুনিয়াতে যেমন মানুষের অভিশাপ পায়, পরকালেও তেমনি জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। হজরত মাকিল বিন ইয়াসার (রা.) বর্ণনা করেছেন, তিনি যখন রোগাক্রান্ত হলেন তখন উমাইয়া গভর্নর উবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ তাকে দেখতে এলেন। তিনি তাকে বললেন, হে মাকিল! আপনার জানামতে, আমি কি কোনো হারাম রক্তপাত করেছি? তিনি বললেন, আমি জানি না। উবায়দুল্লাহ পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি জানেন আমি মুসলমানদের পণ্যের মূল্যে নির্ধারণে কোনো হস্তক্ষেপ করেছি? তিনি বললেন, আমি জানি না। অতঃপর মাকিল লোকদের বললেন, তোমরা আমাকে বসিয়ে দাও। লোকেরা তাকে বসিয়ে দিল। তিনি বর্ণনা করলেন, হে উবায়দুল্লাহ! শুনুন, আমি আপনাকে একটি হাদিস শোনাচ্ছি, যা রাসুল (সা.)-এর কাছ থেকে আমি মাত্র এক-দুবার শুনিনি বরং বহুবার শুনেছি। তিনি বলেছেন, মুসলিম জনগণের জন্য পণ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যদি কেউ কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করে, তাহলে আল্লাহতায়ালার অধিকার হলো তিনি কেয়ামতের দিন তাকে জাহান্নামের একটি বড় আগুনের কুণ্ডের ওপর বসাবেন। (মুসনাদে আহমাদ : ১৯৪২৬)।

অনেক সময় তাড়াহুড়োর কারণে বা নিজে ভালোমন্দ পার্থক্য করতে না পারার কারণে ক্রেতা প্রতারিত হয়। কখনো বিক্রেতাও লোকসানের শিকার হয়। তাই ইসলামী শরিয়তে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়কে কেনাবেচার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার সুযোগ দিয়েছে। ক্রেতা ও বিক্রেতা প্রাথমিক আলোচনার পর তিন দিন পর্যন্ত বিবেচনা করার সুযোগ লাভ করবে। এ সময়ের মধ্যে তারা ভালোভাবে চিন্তা করে অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে হয়তো ক্রয়-বিক্রয় চূড়ান্ত করবে, নতুবা বাতিল করবে। তবে এই সময়ে ক্রেতা পণ্যের মালিক হবে না। কিন্তু যদি তার হাতে পণ্য নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে হবে। আনসারি সাহাবি হজরত হিব্বান ইবনে মুনকিজ ইবনে আমর (রা.) কেনাবেচায় ঠকতেন। নবীজি (সা.) তাকে বললেন, ‘যখন তুমি কেনাবেচা করবে তখন বলবে, কোনো প্রতারণা চলবে না, আমার জন্য তিন দিনের অধিকার রয়েছে। (হেদায়া : ৪/২৯)

অতএব রমজান মাস কেন্দ্র করে দ্রব্যসামগ্রীর দাম বাড়ানো খুবই ঘৃণিত কাজ। এ সময় বাজারদর নাগালে রাখা ও সুষ্ঠু তদারকিতে ইসলামী বিধান অনুসরণ ফলদায়ক হতে পারে। দূর হতে পারে সাধারণ জনগণের রমজানের খাবারের চরম ভোগান্তি। সুতরাং ব্যবসা হোক মানুষের কল্যাণের অভিপ্রায়ে। ব্যবসায়ীরা জানুক মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা জঘন্যতম অপরাধ। এতে ব্যবসায়ীদের প্রতি মানুষের অভিশাপ বর্ষিত হয়ে থাকে। আল্লাহতায়ালা সবাইকে সঠিকভাবে ইসলামের নিয়ম মেনে ব্যবসা করার তাওফিক দান করুন।

লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ফর্মহীন লিটন কেন বিশ্বকাপ দলে?

দেশব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালা করবে শ্রমিক দল

চাকরির সুযোগ দিচ্ছে যমুনা ফিউচার পার্ক, আবেদন করুন দ্রুত

৭ জানুয়ারির নির্বাচনকেও হার মানিয়েছে উপজেলা নির্বাচন : গয়েশ্বর

হজযাত্রীর মাধ্যমে জর্দা পাঠাচ্ছে এজেন্সি, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সতর্কতা

এমভি আবদুল্লাহ / জিম্মিদশা থেকে ফেরা নাবিক বাবার জন্য ২ মেয়েরা অপেক্ষা

‘নিহত হয়েছে দেড় হাজার ইসরায়েলি সেনা’

মোটরসাইকেল চালানোর সময় ফোনে কথা, ট্রাকের নিচে কলেজছাত্র

আজ পর্দা উঠছে কান চলচ্চিত্র উৎসবের

‘আইএলওকে যে সহযোগিতা করার দরকার, আমরা সেটা চালিয়ে যাচ্ছি’

১০

গরু চুরি করতে এসে মোটরসাইকেল রেখে গেল চোর

১১

নিরাপদ পানি নিশ্চিতে ইপিআরসির সভা

১২

ভাঙা প্রেমের কথা প্রকাশ করলেন মিঠুন

১৩

বিবেচনায় থাকার পরও কেন বাদ সাইফউদ্দিন?

১৪

এক মণ ধানেও মেলে না এক কেজি মাংস

১৫

স্বামী পাশে নেই, ফাইভ স্টারে অভিনেত্রীর জন্মদিন উদযাপন

১৬

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নাইকো মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ ১১ জুন

১৭

সেলফি তোলাই তার পেশা, লাখের ওপরে উপার্জন

১৮

কাদের মির্জাকে হত্যার হুমকি

১৯

‘অভিবাসন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে গঠিত হচ্ছে উপজেলা মাইগ্রেশন কো-অর্ডিনেশন কমিটি’

২০
X