আর কে চৌধুরী
প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৪, ০৩:৪৭ এএম
আপডেট : ০২ মার্চ ২০২৪, ০৭:৩৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

স্মৃতিতে একাত্তরের মার্চ

স্মৃতিতে একাত্তরের মার্চ

১৯৭১ সালের ১ মার্চ হঠাৎ এক হটকারী সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার আপামর জনতা। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর ২৫ মার্চ পর্যন্ত নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন রূপ নেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে। ১৯৭১ সালের ‘মার্চ’ মাস বাঙালির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ মাস। এ মাস স্বাধীনতার মাস। মার্চ মাসটি বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অবিচ্ছেদ্য অংশ।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে এক কঠিন সংকটময় পরিস্থিতিতে ৭ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্সে তার ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষকে চারটি শর্ত দিয়ে ভাষণের শেষাংশে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

একাত্তরের ৭ মার্চের বিকেলটা ছিল অন্যরকম। এই দিনটির জন্য অপেক্ষায় ছিল সমগ্র জাতি। এক পাতাঝরা বসন্তের বিকেল এভাবে বদলে দিতে পারে ইতিহাসের মোড়, বিশ্বের ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। সেদিন বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে দেওয়া মাত্র ১৮ মিনিটের একটি ভাষণ একটি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে যেভাবে উজ্জীবিত করেছিল, তার তুলনা আর কোনো কিছুর সঙ্গে হতে পারে না।

তখন আমি নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। গাজী গোলাম মোস্তফা সভাপতি, মোহাম্মদ সুলতান সেক্রেটারি আর সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন মনসুর ভাই। সাধারণত ঢাকার কর্মসূচিগুলো পালনের দায়িত্ব থাকত আমাদের ওপর। সেই ধারাবাহিকতায় ৭ মার্চ সকালে আমরা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি বাড়ির চারপাশে লোকে লোকারণ্য। আমরা নগর আওয়ামী লীগের নেতারাই বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় নিয়ে আসি। বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দেন তখন আমরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেই ঐতিহাসিক দিনে উপস্থিত থাকতে পেরে নিজেকে সর্বদা ধন্য মনে করি।

বঙ্গবন্ধু যখন রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত হন, তখন লাখো মানুষের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পূর্ণ ময়দান। মুহুর্মুহু স্লোগানে প্রকম্পিত চারদিক, পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা। সেদিন বঙ্গবন্ধু আমাদের যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশও দিয়েছিলেন।

বিশ্ব রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার ওই ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল সে সময়ের বজ্রকঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। তাই এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিটি বাংলাদেশির স্মরণ করা উচিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যার অনন্যসাধারণ নেতৃত্বে বাঙালি জাতি একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছে।

৭ মার্চের ভাষণের ভেতর দিয়ে ফুটে ওঠে এক দৃঢ়চেতা রাজনৈতিক নেতার পরিচয়। স্পষ্ট করেই তিনি বলেছিলেন, শহীদের রক্তের ওপর দিয়ে, পাড়া দিয়ে, আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেমব্লি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে প্রথম। সামরিক আইন মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব আমরা অ্যাসেমব্লিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে অ্যাসেমব্লিতে বসতে আমরা পারি না। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। সেই অধিকার তিনি এনে দিয়েছিলেন এ দেশের মানুষকে।

মূলত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যেই পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যে ক্ষমতা ছাড়তে চায়নি, সেটা তিনি বুঝে গিয়েছিলেন আগেই। বুঝে গিয়েছিলেন যে, জাতির মুক্তির জন্য যুদ্ধ আসন্ন। আর সে যুদ্ধে তিনি উপস্থিত না-ও থাকতে পারেন, আবার গ্রেপ্তার করা হতে পারে তাকে, এটাও যেন তার কাছে স্পষ্ট ছিল। বোধহয় সে কারণেই তিনি স্পষ্ট করে বলে দেন—আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব। আমরা পানিতে মারব।

৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে যেমন মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি, তেমনি আসন্ন সে যুদ্ধের জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহ্বানও জানিয়েছিলেন। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা—রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই অজেয় বজ্রকণ্ঠ আজও কাঁপন ধরায় বাঙালির রক্তে। আলোড়ন তোলা সেই আহ্বানের জন্যই যেন বাঙালি জাতি অধীর অপেক্ষায় ছিল। বিদ্যুৎবেগে সেই আহ্বান সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ স্লোগানে স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ জাতি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের লক্ষ্যই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাঙালিদের যে করতে হবে তাও তার দূরদৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল বহু আগে। ৭ মার্চের ভাষণে সেই দিকনির্দেশনাও স্পষ্ট। ভাষণে তিনি বললেন, আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতির পিতা। আজও তিনি আমাদের প্রেরণার উৎস। আমাদের সত্তায় মিশে আছেন তিনি, থাকবেন।

লেখক: রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান ও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের উপদেষ্টা

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভয়েস অব আমেরিকার কর্মীদের ছাঁটাই স্থগিত

দাড়ি রাখা, অগোছালো পোশাক আর মেনে নেওয়া হবে না : মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী

গাজামুখী নৌবহর থেকে সরে দাঁড়াল ইতালি

অবশেষে নেপালের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়

বিশ্বকাপে ভারতের শুভসূচনা

বিশ্বকাপ শুরুর আগে বাংলাদেশ দলে দুঃসংবাদ

এমবাপ্পের হ্যাটট্রিকে রিয়ালের বড় জয়

খালেদা জিয়ার সঙ্গে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ

পূজায় কোনো নিরাপত্তার ঝুঁকি নেই : ডিএমপি কমিশনার

হাসপাতালের বিছানায় সাবেক মন্ত্রীর বিতর্কিত ছবি নিয়ে যা বলছে কারা কর্তৃপক্ষ

১০

বিএনপির পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে নর্থ আমেরিকা পররাষ্ট্র কমিটির বৈঠক

১১

বিএনপি ক্ষমতায় এলে সকলে মিলে দেশ গড়বো : ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ

১২

বকেয়া বিল আদায়ের ঘটনায় পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের বিরুদ্ধে অপপ্রচার

১৩

ঐক্যবদ্ধভাবে অপশক্তিকে প্রতিহত করতে হবে : সেলিমুজ্জামান 

১৪

ধেয়ে আসছে শক্তিশালী বৃষ্টিবলয় ‘প্রবাহ’

১৫

চবির ফারসি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম অভিযোগ গেল দুদকে

১৬

একজন চিকিৎসক দিয়েই চলছে হাসপাতাল

১৭

চারদিন পর খাগড়াছড়িতে অবরোধ স্থগিত

১৮

চলতি অর্থবছর কেমন হবে, জানাল এডিবি

১৯

বিএনপি ক্ষমতায় এলে সবাই মিলে দেশ গড়ব : ড. ফরিদুজ্জামান

২০
X