সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৪, ০২:৫৬ এএম
আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২৪, ০৭:২৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে

যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে

‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজন যদিও হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব’—বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের এ অংশটুকু আমার খুব প্রিয়। বঙ্গবন্ধু সাহসী ছিলেন, মানুষের জন্য তার দরদ ছিল, কিন্তু একই সঙ্গে তিনি যে ন্যায়ের প্রতি অবিচল ছিলেন, সেটা প্রমাণ হয় এই একটি বাক্যে।

বাংলাদেশের জন্ম মাস মার্চ মাস। সেই মার্চের সবচেয়ে বড় দিন ১৯৭১-এর ৭ মার্চ; যে দিনটিতে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ঐতিহাসিক ভাষণে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন—‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই বজ্রনিনাদ ঘোষণার পরই এ দেশের মানুষের বুঝতে বাকি রইল না যে, স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে আর দেরি নেই। তাই এই ৭ মার্চের ভাষণই ছিল প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা।

যারা নেতা হন, তাদের পক্ষে পরিবর্তনের বাস্তবতা অবহেলা করা শক্ত। বড় রাজনীতিতে যাদের চলাচল তারা ক্ষুদ্রের সন্ধান করেন না। আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চে ইতিহাসের দিকে তাকালে এই সত্য আরও বেশি করে উপলব্ধি হয়। কঠিন বাস্তবতায়, বৈরী সময়ে, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কখন মানুষকে সম্পূর্ণ জাগিয়ে তুলতে হয়, সেটা বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোনো বাঙালি নেতার মধ্যে দেখা যায়নি।

বলা হয় বাঙালি ইতিহাসবিমুখ। কিন্তু ১৯৭৫-পরবর্তী বাঙালি তার চেয়েও বেশি কিছু। সে ইতিহাস বিকৃতিকারী। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর যারা ক্ষমতায় এসেছিলেন, তাদের একটা পরিকল্পনা ছিল। তারা ভেবেছিলেন তথ্যকে বড় করে ভুল করে উপস্থাপন করতে পারলে, অসত্যকে সামনে আনলে ইতিহাস বিকৃত হয়ে বাঁক নেবে, মানুষের মুখে মুখে তার কদর্য চেহারাটা সামনে এলে আসল ইতিহাসটা একসময়ে ফিকে হয়ে যাবে।

সেই পরিকল্পনামাফিক ৭ মার্চকে ভুলিয়ে দিতে ২৬ মার্চ এক ঘোষণা দিবস আবিষ্কৃত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। আর সে কারণেই স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। অনেক আগেই বিশ্বের জনগণ বেসরকারিভাবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে ২০১৭ সালে ইউনেসকোর দেওয়া স্বীকৃতির মাধ্যমে এ ভাষণ বিশ্ব ইতিহাসে স্বীকৃতি পেয়েছে।

১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে মুক্তির বাণী শুনিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭ মার্চের সেই ভাষণেরই সফল পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশ। ৫৩ বছরেও ১৮ মিনিটের সেই ভাষণের আবেদন এতটুকু কমেনি।

বঙ্গবন্ধু এ ভাষণের মাধ্যমে একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, অন্যদিকে পাকিস্তান ভাঙারও দায়িত্ব নেননি। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিছুই করার ছিল না। বঙ্গবন্ধুর কৌশল ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী না হয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা। সেদিন তিনি সফল হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু দূরদর্শী ছিলেন, ভাষণে তিনি একদিকে স্বাধীনতার ডাক দিলেন, অন্যদিকে সুকৌশলে চারটি শর্তের বেড়াজালে শাসকের চক্রান্তকে আটকে দিলেন এবং সামরিক শাসকদের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করার পাতানো ফাঁদেও পা দিলেন না। একদিকে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ যেমন বললেন; তেমনি নানা শর্তের জালে ফেললেন শাসকদের ষড়যন্ত্রের দাবার ঘুঁটি।

তিনি বললেন, সামরিক শাসন তুলে নিতে হবে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে এবং আন্দোলনে নিহতদের বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এ ভাষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল যখন তিনি বলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকবেলা করো।’ বঙ্গবন্ধুর সতর্ক করেছিলেন, ‘শোনেন, মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে।’ এই কথাগুলো আজকের প্রেক্ষাপটেও অনেক প্রাসঙ্গিক।

এ ভাষণটি সার্বজনীন ও মানবিক। যে কোনো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য এ ভাষণ সবসময়ই আবেদন সৃষ্টিকারী। এ ভাষণে গণতন্ত্র, আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাধিকার, মানবতা এবং সব মানুষের কথা বলা হয়েছে। তাই এ ভাষণ দেশ-কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে সার্বজনীন হয়েছে।

বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে একটি অলিখিত বক্তৃতা এমন হতে পারে সেটা ভাবাই যায় না। পুরো ভাষণেই ছিল বাঙালি জাতির স্বপ্ন, সংগ্রামের কথা এবং একই সঙ্গে ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা। সহজ-সরল সাধারণ মানুষের ভাষায় তিনি কথা বলেছেন। তিনি হরতালের কথাও বলেন আবার গরিব মানুষ যেন কষ্ট না পায় সে কথাও বলেন। বলেন ব্যাংক ১ তারিখ খোলা থাকবে বেতন নিয়ে আমার জন্য। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়াগুলো বুঝতেন। আর এ কারণেই ভাষণটি পুরো জাতিকে একটি প্রত্যাশার আলোয় মুক্তির পথে নিয়ে গেছে।

এ ভাষণে বাঙালির সংগ্রাম ঐহিত্য এবং বঞ্চনার ইতিহাস, গণতান্ত্রিক চেতনা, আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, শান্তির বাণী, মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং আক্রান্ত হলে প্রতিরোধের কথা আছে বলেই এখনো মানুষ তন্ময় হয়ে সেই ভাষণ শোনে।

যারা ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় বসে এ ভাষণ প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, যারা ইতিহাস থেকে এ ভাষণ মুছে দিতে চেয়েছিল, তারা জানে এ ভাষণই বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছে। এ ভাষণে সংগ্রামের কথা আছে, প্রতিরোধের কথা আছে, কিন্তু তবুও এ ভাষণ সহিংস ছিল না। বঙ্গবন্ধু শান্তির আহ্বানই রেখেছেন বেশি। একটি ভাষণেই একটি লড়াকু জাতির জন্য পুরো দিকনির্দেশনা ছিল বলেই আজ তা বিশ্ব ইতিহাসের অংশ।

ফিরে আসি শুরুর কথায়। আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার সারা বিশ্বের সব মানুষের অধিকার। সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কথা, স্বাধীনতাবঞ্চিত মানুষের কথা যেন উঠে এসেছিল এ ভাষণে। বঙ্গবন্ধু যখন বলেন, ‘আমরা সংখ্যায় মেজরিটি, কিন্তু একজন মানুষও যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেব’—এর চেয়ে আর বড় কোনো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু জীবনের দীর্ঘ সময় গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। কিন্তু জনগণের ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে কখনো আপস করেননি। তাদের ওপর বিশ্বাস হারাননি। সে কারণেই সামরিক শাসনের মধ্যেও, ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে ভোটের অধিকার আদায় করতে সক্ষম হন।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের এ অংশটুকুর মধ্যে রয়েছে গভীর গণতান্ত্রিক উদার মূল্যবোধ। হিত যা গভীরভাবে উপলব্ধির বিষয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ন্যায্য মুক্তিসংগ্রামী। তার এ শক্তির উৎস জনগণের প্রতি অবিচল আস্থা আর ন্যায়ের পক্ষে অনড় অবস্থান। এজন্যই ন্যায্য কথা বলা ব্যক্তি তিনি যত দুর্বলই হোন, তার প্রতি বঙ্গবন্ধুর আস্থা ছিল অবিচল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী একজন নেতা। যুক্তিসঙ্গ কথায় তার বিশ্বাস ছিল সবসময়।

ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে অনেক দিক আছে। তবে সেই ভাষণের মধ্যে দুটি দিক খুবই গুরুত্ব বহন করে। একটি হলো জাতির পিতার সাহস এবং আরেকটি হলো এ ন্যায্যতার ভাবনা। জীবনের কঠিন সময়ে দাঁড়িয়েও তিনি ন্যায়নীতি থেকে সরে আসতে চাননি। বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণ আজও প্রাসঙ্গিক এবং প্রাসঙ্গিক থাকবে আজীবন। কারণ আমাদের সব লড়াই ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করার জন্যই।

বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে ৭ মার্চ এক অবিস্মরণীয় দিন। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতে, স্বাধীনতা, মুক্তির কাঙ্ক্ষিত স্বাদ পেতে এ ভাষণই উদ্বুদ্ধ করেছে বাঙালিকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে। আজ চারদিকে অনেক চ্যালেঞ্জ, অনেক প্রতিবন্ধকতা। সবকিছু মোকাবিলায় এই ঐতিহাসিক দিনে নেতার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আইএফআইসি ব্যাংকের নতুন এএমডি মো. নুরুল হাসনাত

নারী, মাদক ও অস্ত্রসহ যুবলীগ নেতা আটক

চোট-শঙ্কায় থাকা তাসকিনের কাঁধে সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব

ডোনাল্ড লুর সফরে বিএনপি উৎসাহী নয় : ফারুক

স্যামসাংয়ের নামে নকল পণ্য বিক্রি করছে রায়ানস

ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট নিয়ে অপরাজনীতি করছে বিএনপি : পররাষ্ট্রমন্ত্রী 

আল আকসায় তাণ্ডব চালিয়ে ইসরায়েলি পতাকা প্রদর্শন

রাঙামাটিতে পাহাড়ি দুই সংগঠনের মধ্যে গোলাগুলি

আশাশুনিতে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সংঘাতের শঙ্কা

ছয় পদে ৮২ জনকে নিয়োগ দিচ্ছে কর অঞ্চল-২৫ ঢাকা

১০

চিকিৎসার জন্য সস্ত্রীক সিঙ্গাপুর গেলেন মির্জা আব্বাস

১১

গাজার কেউ সুরক্ষিত নয় : জাতিসংঘ

১২

স্বাস্থ্যকর খাবার নিশ্চিত করতে নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগ

১৩

ই-স্বাক্ষরযুক্ত স্মার্ট অ্যাকাডেমিক ক্রেডেনশিয়ালকে স্বাগত জানাই

১৪

বিদ্যুৎ বিল নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে ইবি শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ

১৫

আন্তর্জাতিক ধারাভাষ্যে রোজেল আহমেদের অভিষেক

১৬

দেড় লাখ টাকা বেতনে ওজোপাডিকোতে চাকরির সুযোগ

১৭

ছাত্রলীগের ওপরে কোনো সন্ত্রাস নেই, ছাত্রলীগ নেতার বক্তব্য ভাইরাল

১৮

টাইগারদের বিশ্বকাপ দল ঘোষণা

১৯

মার্কিন কোনো ইস্যুকেই কেয়ার করি না : ওবায়দুল কাদের

২০
X