মানুষ সামাজিক জীবন, সমাজবদ্ধ জীবনে একে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে বাঁচতে হয়, প্রয়োজনে লেনদেনও করতে হয়। এজন্য মানুষের সততা ও স্বচ্ছতার অন্যতম একটি মাপকাঠি লেনদেন। যার লেনদেন স্বচ্ছ, মানুষ হিসেবে তিনি সৎ ও সততার অধিকারী। পক্ষান্তরে যার লেনদেন ও আয়-উপার্জন স্বচ্ছ নয়, মানুষ হিসেবে তিনি নির্ভেজাল নন। ইসলামেও লেনদেনকে ধরা হয়েছে ধার্মিকতার মাপকাঠি হিসেবে। একজন মানুষের মধ্যে কতটুকু ধার্মিকতা আছে, তা জানা যায় এর মাধ্যমে। নামাজ পড়া, রোজা রাখা, হজ করা, সর্বদা তাসবিহ পাঠ, তেলাওয়াত-জিকির ইত্যাদি অনেক আমল-ইবাদত থাকলেও যদি তার মধ্যে হারাম উপার্জন, আমানতের খেয়ানত, ঋণ পরিশোধে গড়িমসি ইত্যাদি থাকে, তাহলে তাকে প্রকৃত মুমিন বলা যায় না। বাহ্যিক বেশভূষা ও ইবাদত-বন্দেগি দেখে কাউকে প্রকৃত দ্বীনদার ভাবার সুযোগ নেই। এক ব্যক্তি খলিফা ওমর (রা.)-এর কাছে একজনের ব্যাপারে খুব প্রশংসা করে বলল, ‘ওই ব্যক্তি অনেক সত্যবাদী।’ ওমর (রা.) বললেন, ‘আচ্ছা, তুমি কি তার সঙ্গে কখনো সফর করেছ?’ লোকটি উত্তর দিল, ‘না।’ ওমর (রা.) আবার প্রশ্ন করলেন, ‘তাহলে কি তোমার ও তার মধ্যে কখনো কোনো লেনদেন হয়েছে?’ লোকটি একই উত্তর দিল, ‘না।’ ওমর (রা.) তৃতীয়বার প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, তাহলে কি তুমি কখনো তার কাছে কোনো আমানত রেখেছ?’ এবারও লোকটি না-বাচক উত্তর দিল। ওমর (রা.) বললেন, ‘তাহলে তার ব্যাপারে তোমার কোনো ধারণাই নেই। মনে হয়, তুমি তাকে মসজিদে রুকু-সেজদা করতে দেখেছ! অর্থাৎ শুধু মসজিদের গণ্ডিতে দেখেই যে তাকে ধার্মিক ও সত্যবাদী মনে করছ এবং তার গুণের তারিফ করছ, এটা ঠিক নয়। প্রকৃত পরিচয় তো জানবে লেনদেনের পর।’ (কানজুল উম্মাল : ২৫৫৭০)। আমাদের যাপিত জীবনে প্রতি পদক্ষেপে লেনদেন ও মুয়ামালাতের প্রয়োজন হয়। লেনদেনের মাধ্যমে জীবনযাপন করা ছাড়া কারও পক্ষে ঠিকমতো ইবাদত-বন্দেগি পালনও সম্ভব নয়। তাই ইসলামে মুয়ামালাত ও লেনদেনের গুরুত্ব অনেক বেশি। ইসলামে হক অর্থাৎ অধিকার ও দায়-দায়িত্ব দুই ভাগে বিভক্ত—১. আল্লাহর হক; ২. বান্দার হক। আল্লাহর হকের ক্ষেত্রে যদি বান্দার কোনো ত্রুটি হয়ে যায় আর সে তওবা করে নেয় অথবা ক্ষেত্রবিশেষে তওবা ছাড়াও যদি আল্লাহর মর্জি হয়; তবে সে ক্ষমা পেতে পারে। কিন্তু বান্দার হকের ব্যাপারে কেউ ত্রুটি করলে সেটা আল্লাহ ক্ষমা করেন না; যতক্ষণ না অপরাধী নিজেই হকদারের সঙ্গে লেনদেন সাফ করে নেয়। বান্দার হক অনাদায় ও অপরিচ্ছন্ন লেনদেনের ব্যাপারে নবীজি (সা.) কঠিন সতর্কবাণী শুনিয়েছেন। সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার কোনো ভাইয়ের সম্মানহানির মাধ্যমে বা অন্য কোনো প্রকারে তার ওপর জুলুম করেছে, সে যেন আজই তার সঙ্গে লেনাদেনা সাফ করে নেয়, ওই দিন আসার পূর্বেই, যেদিন তার কাছে কোনো দিনার-দিরহাম (টাকা-পয়সা) থাকবে না। সেদিন যদি তার কাছে কোনো নেক আমল থাকে তবে তার জুলুম পরিমাণ সেখান থেকে নিয়ে নেওয়া হবে এবং পাওনাদারকে আদায় করে দেওয়া হবে। আর যদি কোনো নেক আমল না থাকে তাহলে যার ওপর জুলুম করেছে তার পাপের বোঝা জুলুম অনুযায়ী তার ঘাড়ে চাপানো হবে।’ (বুখারি : ২৪৪৯) পবিত্র কোরআন-হাদিসে অতি গুরুত্বের সঙ্গে লেনদেনে পরিচ্ছন্ন ও স্বচ্ছ থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্নভাবে ও নানা আঙ্গিকে এ ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা মাপে কম দেয়। যারা মানুষের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, পূর্ণমাত্রায় নেয়। আর যখন অন্যকে মেপে বা ওজন করে দেয় তখন কমিয়ে দেয়। তারা কি চিন্তা করে না, তাদের এক মহাদিবসে জীবিত করে ওঠানো হবে? যেদিন সব মানুষ রাব্বুল আলামিনের সামনে দাঁড়াবে।’ (সুরা মুতাফফিফিন : ১-৬)। আরেক আয়াতে পরস্পর সন্তুষ্টির ভিত্তিতে বেচাকেনাকে বৈধতা দিয়ে সম্পদ উপার্জনের অন্য সব অন্যায় পদ্ধতি হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা পরস্পরে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না। তবে পারস্পরিক সম্মতিক্রমে কোনো ব্যবসা করা হলে তা জায়েজ।’ (সুরা নিসা : ২৯)। কোনো সম্পদ শুধু বিচারকের কাছ থেকে নিজের নামে ফয়সালা করে নিলেই তা বৈধ হয়ে যায় না; বরং পন্থাও বৈধ হতে হয় এবং বাস্তবেই নিজে ওই সম্পদের হকদার হতে হয়। এ বিষয়ে কোরআনের এক আয়াতে নির্দেশনা রয়েছে। বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা পরস্পর একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ কোরো না এবং বিচারকের কাছে সে সম্পর্কে এই উদ্দেশ্যে মামলা রুজু কোরো না যে, মানুষের সম্পদ থেকে কোনো অংশ জেনেশুনে পাপের পথে গ্রাস করবে।’ (সুরা বাকারা : ১৮৮)।
লেনদেনে অস্বচ্ছতার কারণে দোয়া-ইবাদত ইত্যাদি আমলও কবুল হয় না। আমরা নামাজ-রোজাসহ অন্যান্য ইবাদত পালন করি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আর তিনি সেই আমলের দ্বারাই সন্তুষ্ট হন, যে আমল তার কাছে গ্রহণযোগ্য। যে ব্যক্তি অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ থেকে তার প্রয়োজন পূরণ করে; আল্লাহতায়ালা তার ইবাদত-বন্দেগি ও দোয়া-মোনাজাত কবুল করেন না। রাসুল (সা.) বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র (আমল) ছাড়া গ্রহণ করেন না। তিনি রাসুলদের যে আদেশ করেছেন; একই আদেশ করেছেন মুমিনদের। তিনি বলেছেন, হে রাসুলগণ! আপনারা উত্তম (হালাল) রিজিক থেকে আহার করুন এবং নেক আমল করুন। তিনি মুমিনদেরও বলেছেন, হে ইমানদারগণ! তোমরা আমার প্রদত্ত হালাল রিজিক থেকে আহার করো। অতঃপর নবীজি একজন লোকের বর্ণনা দিলেন, যে দীর্ঘ সফর করেছে। চুলগুলো এলোমেলো, শরীর ধূলি-ধূসরিত। আসমানের দিকে হাত উত্তোলন করে দোয়া করছে—হে আমার রব! হে আমার রব! অথচ তার খাদ্য-পানীয় হারাম, পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম; তাহলে কীভাবে তার দোয়া কবুল হবে? (তিরমিজি : ২৯৮৯)। হাদিসের ব্যাখ্যাকার আলেমরা বলেছেন, এ হাদিসে উদাহরণস্বরূপ শুধু দোয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। নতুবা হারাম দ্বারা প্রতিপালিত হলে তার কোনো আমলই আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। (জামিউল উলুমি ওয়াল হিকাম : পৃ. ১৮৫)
ইসলামে হারাম ও অবৈধ উপার্জন কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। হারাম সম্পদের তুচ্ছতায় তা মাটির সঙ্গেও তুলনা করা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার প্রাণ যার হাতে তার কসম, তোমাদের কেউ মানুষের কাছে হাত পাতার চেয়ে উত্তম হলো সে তার রশি নিয়ে পাহাড়ে যাবে এবং কাঠ সংগ্রহ করবে। অতঃপর তা পিঠে বহন করে এনে বিক্রি করবে এবং আহারের ব্যবস্থা করবে। আর তোমাদের কেউ হারাম খাওয়ার চেয়ে উত্তম হলো নিজের মুখের মধ্যে মাটি ভরা।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৭৪৯০)। অবৈধ পথে সম্পদ উপার্জন করলে কেয়ামতের কঠিন জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের ময়দানে কোনো বান্দা তার এক পাও নড়াতে পারবে না; যতক্ষণ না তাকে পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে—১. সে তার জীবন কোন পথে শেষ করেছে; ২. যতটুকু ইলম শিখেছে তার ওপর কতটুকু আমল করেছে; ৩. সম্পদ কোন পথে আয় করেছে; ৪. এবং কোন পথে ব্যয় করেছে। ৫. নিজের যৌবনকে কোন পথে শেষ করেছে।’ (তিরমিজি : ২৪১৭)। সুতরাং আমরা যখন সম্পদের আয়-ব্যয়ের হিসাব করি, তখন কোন পথে আয় করছি এবং কোন পথে ব্যয় করছি সেটারও হিসাব নিতে হবে।
লেনদেনে স্বচ্ছতা ও পরিচ্ছন্নতা ইমান-আমলেরও হেফাজতে সহায়ক। কারণ লেনদেন অস্বচ্ছ ও অপরিচ্ছন্ন হলে এবং অন্যের হক অনাদায় থেকে গেলে আমলের বিরাট সঞ্চয়ও শেষ হয়ে যাবে। অনেক বড় ইবাদতগুজার হয়েও নিক্ষিপ্ত হতে হবে জাহান্নামের অতল গহ্বরে। একদিন রাসুল (সা.) সাহাবিদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কি জানো, নিঃস্ব কে?’ সবাই উত্তর দিলেন, ‘আমাদের মধ্যে নিঃস্ব সেই ব্যক্তি, যার কাছে টাকা-পয়সা, ধনসম্পদ কিছুই নেই।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘না, আমার উম্মতের মধ্যে প্রকৃত নিঃস্ব ওই ব্যক্তি, যে কেয়ামতের দিন নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদি আমল নিয়ে আসবে; কিন্তু দুনিয়াতে সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারও সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কারও রক্তপাত ঘটিয়েছে, কাউকে প্রহার করেছে। তাই তার নেক আমল থেকে একে একে হকদারকে দেওয়া হবে। আর যদি হক পরিশোধের আগেই আমল শেষ হয়ে যায়, তাহলে হকদারদের পাপ তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (মুসলিম : ২৫২১)। আল্লাহতায়ালা আমাদের লেনদেনে পরিচ্ছন্ন হওয়ার এবং বান্দার হকের বিষয়ে সচেতন হওয়ার তাওফিক দান করুন। হালাল উপার্জনে বরকত দান করুন, হারাম থেকে রক্ষা করুন।
লেখক : মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ
মন্তব্য করুন