মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৪, ০৩:২৯ এএম
আপডেট : ২২ মার্চ ২০২৪, ০৮:১১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভোগ নয়, ত্যাগের শিক্ষা দেয় রমজান

ভোগ নয়, ত্যাগের শিক্ষা দেয় রমজান

জীবনের যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতা থেকে নিজেকে পবিত্র করা ও পরকালীন জীবনের পাথেয় পুণ্য অর্জনের অফুরন্ত সুযোগের মাস পবিত্র মাহে রমজান। রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের পয়গাম নিয়ে উপস্থিত ইবাদতের বসন্তকাল। পুণ্যময় এ মাসে মহান রবের ইবাদত উপাসনায় আলোকিত হয় মুমিনের জীবন। ভোগ ও বিলাসিতার অভ্যাস ছেড়ে ত্যাগ ও কর্মোদীপ্ত জীবনের শিক্ষা দেওয়া রমজান। ইসলামের কিছু ইবাদত আর্থিক, কিছু মানসিক ও কিছু শারীরিক। রোজা একটি শারীরিক ইবাদত। একজন বিত্তশালীর ওপর যেমন রোজা ফরজ, একজন খেটে খাওয়া মানুষের ওপরও রোজা ফরজ। ঘরে খাবার থাকার পরও বিত্তশালীকে রোজা রাখতে হয়। ক্ষুধার যন্ত্রণা কী জিনিস তা বাস্তবে অনুধাবনের সুযোগ করে দেয় রমজান। রোজার অন্তর্নিহিত সারমর্মের একটি অংশ হলো অভাবী মানুষের ক্ষুধার কষ্ট অনুধাবন করা। এ কষ্ট অনুধাবন করে শ্রমজীবী মানুষের প্রতি যেন সদয় হই, সে নির্দেশ দিয়েছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। রমজানে শ্রমিকের কাজের বোঝা হালকা করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, রমজানে শ্রমিকের বোঝা হালকা করে দেওয়াকে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্তির অসিলা হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘এ মাসে (রমজানে) যারা শ্রমজীবী মানুষের প্রতি সদয় ব্যবহার করে তাদের কাজের বোঝা হালকা করে দেয়, আল্লাহ দয়াপরবশ হয়ে তাদের গুনাহ ক্ষমা করে দিয়ে তাদের জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করেন।’ (ইবনে খুজাইমা)।

মানুষের পক্ষে দীর্ঘদিনের কু-অভ্যাস ছাড়া অনেকটা কঠিন ব্যাপার। এগারো মাস পাপ ও ভোগের সমুদ্রে নিমজ্জিত থাকার ফলে এ মাসেও লাগামহীনভাবে পাপনিদ্রায় বিভোর থাকে। বড় আক্ষেপের বিষয়, এ পবিত্র মাসেও ভেসে আসে গান-বাজনার আওয়াজ। অনেকে আবার রোজাদারের সামনে প্রকাশ্যে পানাহার করে বেড়ায়। নামাজ-রোজার কথা ভুলে গিয়ে চলে খেলাধুলার প্রতিযোগিতা। অবসরতা কাটাতে কোথাও জমে ওঠে জুয়া ও আড্ডার আসর। এসব রমজানের পবিত্রতা ও মহত্ত্বকে ধ্বংস করে। অনেকে দিনভর রোজা রাখে, আবার গিবত, পরনিন্দা ও মিথ্যা কথাসহ নানা পাপ কাজেও লিপ্ত থাকে—এমন ব্যক্তির ভাগ্যে শুধু ক্ষুধাই জোটে। এজন্যই রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কত রোজাদার আছে, যাদের রোজার বিনিময়ে ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই জোটে না। কত সালাত আদায়কারী আছে যাদের রাত জাগরণ ছাড়া আর কিছুই জোটে না।’ (ইবনে মাজা : ১৬৯০)।

পবিত্র মাহে রমজান আল্লাহর সঙ্গে বান্দার একাত্মতা ও প্রেম বিনিময়ের সর্বোত্তম সময়। পবিত্র কোরআনের শব্দ হচ্ছে ‘রামাজান’। আরবি ‘রামজুন’ শব্দ হতে রমাদান বা রমজান শব্দের উৎপত্তি। রামজুন শব্দের অর্থ জ্বালিয়ে দেওয়া বা পুড়িয়ে দেওয়া। সর্বপ্রথম যখন এ মাসের নাম রাখা হয়েছিল তখন প্রচণ্ড গরম ছিল। এজন্য লোকেরা এর নাম রেখেছে রমজান, অর্থ ঝলসে দেওয়া। তবে গবেষক আলেমরা বলেন, এ মাসকে রমজান এ উদ্দেশ্যে বলা হয় যে, পবিত্র রমজান মাসে আল্লাহতায়ালা নিজ মেহেরবানিতে মুমিনদের গুনাহসমূহকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেন। মানুষ যেন এক নবজীবন লাভ করে।

রোজার বিধান ফরজ হওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সংযমী বানানো। খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, কথাবার্তা, কর্মতৎপরতাসহ ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে সংযমী হওয়ার মহান বার্তা নিয়ে মুসলিম পরিবারে রমজানের আগমন ঘটে। কিন্তু এই মাস এলে প্রকৃত অর্থে কি আমরা সংযমী হতে পারি? মানুষের প্রথম জৈবিক চাহিদা হলো ক্ষুধা বা খাবারের প্রয়োজন এবং দ্বিতীয় প্রধান চাহিদা হলো যৌনপিপাসা। এ দুটি চাহিদাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ত্যাগ করার নামই রোজা। রোজা পালন উপলক্ষে সংযমী হওয়ার নেপথ্যে এ দুটি চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক। কিন্তু এ নিয়ন্ত্রণ কি আমাদের মধ্যে লক্ষ করা যায়? উল্টো দেখা যায়, অন্য মাসের তুলনায় রমজানে খাওয়ার বাজেট বৃদ্ধি পায়। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, রমজানে গ্যাস্ট্রিকসহ পেটের সমস্যার ওষুধ তুলনামূলক বেশি বিক্রি হয়। কারণ কী? কারণ হলো, এ মাসে মানুষের ভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত খাবারের মাত্রা অন্য এগারো মাসের তুলনায় তিনগুণ বৃদ্ধি পায়। নিশ্চয়ই এটা কোনো সংযমের চিত্র নয়।

সেহরি ও ইফতারে পরিমিত পানাহার করা উচিত। কারণ মাত্রাতিরিক্ত খাবার আহারের ফলে ইবাদতে অলসতা তৈরি হয় এবং গোনাহের প্রবৃত্তি জাগ্রত হয়। আমরা যদি ভোজনবিলাসী না হয়ে মহানবীর (সা.) প্রকৃত সুন্নত এবং সাহাবিদের রোজা রাখার পদ্ধতি অনুসরণ করে ভোজনে সংযমী হয়ে সীমিতভাবে সেহরি ও ইফতার করি, তাহলে এর মধ্য দিয়ে আমাদের কুপ্রবৃত্তি দুর্বল হবে এবং সুকুমারবৃত্তিগুলো বিকশিত হবে। রমজান সংযমের মাস, সাধনার মাস, ত্যাগের মাস। কিন্তু আমরা রমজানের এই বার্তাকে ভুলে গিয়ে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবিদের অনুসৃত পথ পরিহার করে সেহরি ও ইফতারে এতটাই ভোজনবিলাসী, খাদ্যভোগী হয়ে উঠি, যা রমজানের সংযম, সাধনা ও ত্যাগের বার্তাকে ভুলিয়ে দেয়। ফলে আমাদের কুপ্রবৃত্তি দুর্বল না হয়ে আরও হিংস্র ও পাশবিক হয়ে ওঠে। কাম, লিপ্সা, রাগ, মোহ আরও বেড়ে যায়। আমাদের সুকুমারবৃত্তিগুলো বিকশিত না হয়ে আরও নিস্তেজ হয়ে যায়। সেহরিতে অধিক খাবার গ্রহণ বান্দাকে রোজার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করে দেয়। ফলে ইবাদতমুখী হতে পারে না, জৈবিক চাহিদা বৃদ্ধি পায়, অনাহারী মানুষের কষ্ট অনুভব করা যায় না। আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেছেন, মানুষ স্বাভাবিক ক্ষুধায় যতটুকু খাবার গ্রহণ করে, সেহরিতে সেই পরিমাণ খাওয়া মোস্তাহাব। অর্থাৎ খুব বেশি বা কম নয়; বরং মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা। মাজমাউল উলুমি ওয়াল হিকাম খেয়েই সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়া, এটা সুন্নতের পরিপন্থি এবং স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। অন্তত মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজ আদায় করা উচিত। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসে ফজরের নামাজ আদায় করে মসজিদে ইবাদত করতেন, সাহাবিদের দ্বীন শেখাতেন। সূর্যোদয়ের পর ইশরাকের নামাজ আদায় করে ঘরে ফিরতেন।

আমরা যদি প্রকৃত অর্থেই মাহে রমজানের শিক্ষা অন্তরে ধারণ করতে পারি তাহলে সংযমের অনুশীলন হবে, অভাবী-অনাহারীর দুঃখ-কষ্ট বুঝতে সক্ষম হব। সংযম-সাধনার এ মাসে ক্ষুধা ও পিপাসার প্রকৃত অনুভূতির মাধ্যমে বিত্তবান-সচ্ছল রোজাদার মানুষ দরিদ্র ও অভাবী মানুষের না খেয়ে থাকার কষ্ট বুঝতে সক্ষম হন। এ উপলব্ধির আবেশেই বিত্তশালী ব্যক্তি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা নিয়ে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণা বোধ করেন। রাসুল (সা.) রমজানকে ‘শাহরুল মুওয়াসাত’ তথা সহমর্মিতা-সহানুভূতির মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর এ সহমর্মিতার ক্ষেত্র শুধু আর্থিক সহযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আর্থিক সাহায্যের পাশাপাশি অন্য মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে সর্বোত্তম বিনম্র আচরণ, সদুপদেশ প্রদান, তার জন্য প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করায় সবই সহমর্মিতার মধ্যে গণ্য। এ বিষয়টির অপরিহার্যতা ফুটে উঠেছে নুমান ইবনে বাশির (রা.) বর্ণিত সুন্দর একটি হাদিসে। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনদের একে অন্যের প্রতি সম্প্রীতি, দয়া ও মায়া-মমতার উদাহরণ একটি দেহের মতো। যখন দেহের কোনো অঙ্গ ব্যথা পায়, তখন তার জন্য পুরো শরীরই অনিদ্রা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।’ (বোখারি : ৬০১১)

পবিত্র মাহে রমজানে আমাদের কুপ্রবৃত্তি ধ্বংস করতে হলে অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করে সৎ সঙ্গ গ্রহণ করতে হবে। কেননা মানুষ পাপ কাজে অসৎ সঙ্গীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই পাপ থেকে বেঁচে থাকতে সৎ ও ভালো মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত। মহানবী (সা.) ভালো মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘তুমি মুমিন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও সঙ্গী হবে না এবং তোমার খাদ্য যেন পরহেজগার লোকে খায়।’ (আবু দাউদ : ৪৮৩২)। রোজার প্রধান উদ্দেশ্য হলো, তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হলো, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদের ওপরও; যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)। আমাদের সবার মনে সর্বদা এই চেতনা জাগ্রত রাখতে হবে যে, প্রতিমুহূর্তে আমরা যা করছি আল্লাহতায়ালা তা দেখছেন। যেমন পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা যা করো আল্লাহ তা দেখেন।’ (সুরা হুজরাত : ১৮)। পবিত্র রমজান মাসের সহমর্মিতার এসব শুভ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ আমরা যদি বছরব্যাপী অনুশীলন করি, তবেই মানব সমাজে আর দেখা যাবে না কোনোরকম অসাম্য ও শ্রেণিবৈষম্য। দূর হয়ে যাবে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশান্তি-হানাহানি। রহমতের এ বসন্তকালে আসুন আমরা খোদাভীতি অর্জন করি এবং নিজেদের পাপকর্মের জন্য খাঁটি মনে তাওবা করে ভবিষ্যতেও যাবতীয় পাপকর্ম থেকে বেঁচে থাকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করে একটি পুণ্যময় রমজান কাটাই। তবেই অনিন্দ্য সুন্দর হবে আমাদের ইহকাল ও পরকাল।

লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিদ্যুৎস্পর্শে লাইনম্যানের মৃত্যু

ট্রেবল থেকে এক ম্যাচ দূরে কিংস

ইউএস-বাংলা গ্রুপে নিয়োগ, সাপ্তাহিক ছুটি ২ দিন

৪২ জেলায় দাবদাহ, তাপমাত্রা বাড়বে

আমরা রোজা আছি বলায় তারা কিছু করেননি : এমভি আবদুল্লাহর ক্যাপ্টেন

নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো ডিবেট ফেস্ট 

কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু

গবেষণা / সিজারিয়ানে জন্ম নেওয়া শিশুর শরীরে হামের টিকা কম কার্যকর

নাবিকদের বুকে টেনে নিলেন চসিক মেয়র

প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল বুধবার

১০

মোটরযান গতিসীমা প্রণয়নে সরকারকে অভিনন্দন জানাল রোড সেইফটি কোয়ালিশন

১১

হেরোইনসহ মাদককারবারি আটক

১২

কনডেম সেলে বন্দি রাখা অবৈধ ঘোষণায় হাইকোর্টকে আসক-এর সাধুবাদ 

১৩

বিদেশে বসে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে উসকে দেওয়া হয় : দীপু মনি

১৪

২৫ বছর অপেক্ষার পর বিএনপি থেকে জাপায় এসেছি : রুনা খান

১৫

মৃত বাড়ি গিয়ে খাবার খেয়ে অজ্ঞান, হাসপাতালে ৭

১৬

নিয়োগ দিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, থাকছে না বয়সসীমা

১৭

জালালাবাদ গ্যাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মুখ খুললেন ব্যারিস্টার সুমন

১৮

গোসল করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন যুবক

১৯

রাতে ঢাকাসহ ৮ জেলায় ঝড়ের শঙ্কা

২০
X