একজন রিটায়ার্ড যুগ্ম সচিব একদিন এক জেলা প্রশাসকের কাছে গেলেন। তার শ্বশুরের জমি নিয়ে সমস্যার কথা বলতে যাওয়া খুব আবশ্যক ছিল। সমস্যার বিষয়টা পরে বলি। আগে ওই রিটায়ার্ড যুগ্ম সচিব সম্পর্কে কিঞ্চিৎ বর্ণনা দেওয়া দরকার। তবে তার নাম এখানে সংগত কারণেই বলব না। তিনিও একদা অর্ধযুগের বেশি সময়ব্যাপী দুটি জেলায় জেলা প্রশাসক হিসেবে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বলাবাহুল্য, অন্য দশজন জেলা প্রশাসকের চেয়ে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম এবং জনদরদি প্রশাসক। ব্যতিক্রম বলছি এজন্য যে, তার দরজা ছিল সব মানুষের জন্য অবারিতভাবে খোলা। যে কোনো মানুষ তার সঙ্গে দেখা করে তার সমস্যার কথা সহজেই তাকে বলতে পারত। আর তার কাছে একবার পৌঁছতে পারলে যেমনই হোক তিনি (ওই জেলা প্রশাসক) একটা কিছু প্রতিকারের চেষ্টা করতেন, এ কথাই ভুক্তভোগীরা জানেন। কেউ তার কাছ থেকে খালি হাতে ফিরে আসেনি কখনো।
এ তো গেল তার অফিসের নির্ধারিত দায়িত্বের কথা। এ ছাড়া জেলা প্রশাসক হয়েও খেলোয়াড়দের সঙ্গে মাঠে তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর একজন খেলোয়াড় (বিশেষত ক্রিকেট খেলায়)। তিনি খেলার মাঠে খেলোয়াড়ের পোশাক পরিহিত অবস্থায় সাইডলাইনে বসে আবার অফিসের ফাইলও দেখতেন। আর খেলা দেখতে দেখতে এবং অফিসের কাজ করতে করতে প্রয়োজনে সতীর্থ খেলোয়াড়দের নির্দেশনা দিতেন। কখনো কখনো তিনি স্কাউটদের সঙ্গে স্কাউটস ক্যাম্পে ছিলেন। সাহিত্যের আলোচনায় কিংবা কবিতা পাঠের ক্ষেত্রে তিনি সুবক্তা কিংবা দীর্ঘ কবিতা (কবিগুরুর বা অন্য কবির) অবলীলায় মুখস্থ পড়ে দিতে পারেন। আবার মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে সময়মতো হাজির হতেন তিনি। তিনি ছিলেন একজন মানবসেবক। তার পরিচিত মানুষের কাছে তিনি এমনই একজন অসাধারণ মানুষ হিসেবে সমাদৃত ছিলেন। তিনি দায়িত্বের দিক থেকে একজন প্রশাসক হলেও কার্যত ছিলেন প্রকৃত জনসেবক। জনদরদি প্রশাসক (Pro-people administrator).
আমি সেই জেলা প্রশাসকের কথাই বলছি। তিনি রিটায়ার করার পর ঢাকার জেলা প্রশাসকের দ্বারস্থ হলেন (ঘটনার সময়টা সুনির্দিষ্ট করে বলা ঠিক হবে না) একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সেবা নিতে। সমস্যা ছিল জমির রেকর্ডে। জমির রেকর্ড ভুলবশত ১ নম্বর খাস খতিয়ানে হয়েছিল। উল্লেখ্য, সিএস রেকর্ড এবং আরএস রেকর্ড ছিল তার শ্বশুরকুলের নামে। অথচ বিএস জরিপের সময় তা রেকর্ড হয় ১ নম্বর খাস খতিয়ানে। কিন্তু এমনভাবে মালিকানা পরিবর্তনের কোনোই সূত্র বা কারণ নেই।
আমাদের অনেকেরই এমন অভিজ্ঞতা আছে যে, জরিপের সময় কোনো কারণে মূল মালিকের পক্ষে কেউ সরেজমিনে উপস্থিত না থাকলেই বদর আমিন সাহেব জমির মালিকানা উল্টাপাল্টা করে লিখে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এর প্রকৃত কারণ হলো বদর আমিন সাহেব জরিপকালে মালিকের পক্ষ থেকে হয়তো দক্ষিণা পায়নি। তাই তিনি সরকারকে মালিক বানিয়ে যথাযথ দায়িত্ব(?) পালন করেছেন।
যাহোক, এভাবে ভুল রেকর্ড হলে তখন তা সংশোধনের জন্য আবার সিভিল কোর্টে মামলা করতে হয়। আর ওই মামলায় ডিক্রি বা রায় নিয়ে তারপর আবার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তা সংশোধন করতে হয়। ওই রিটায়ার্ড যুগ্ম সচিব সেই মতে আদালতের রায় নিয়েই গিয়েছিলেন ওই জেলা প্রশাসকের কাছে। তিনি জেলা প্রশাসকের সহায়তা চাইলেন আদালতের রায়ের ভিত্তিতে রেকর্ড সংশোধনের জন্য। জেলা প্রশাসক সাহেব রিটায়ার্ড যুগ্ম সচিব সাহেবকে বললেন, ‘স্যার, একটু সময় লাগবে।’
এ কথা বলে জেলা প্রশাসক তাকে বিদায় দিলেন বটে। কিন্তু সরকারি উকিলকে (জিপি) ডেকে দ্রুত আপিল করার জন্য বলেন। আর অমনি আপিল দায়ের হয়ে গেল। কিন্তু সেই আপিল মামলায়ও আবার মূল মালিকের পক্ষেই রায় হয়। তখন ওই যুগ্ম সচিব আবার জেলা প্রশাসকের শরণাপন্ন হন। জেলা প্রশাসক আবার জিপিকে বলেন উচ্চ আদালতে আপিল করার জন্য। এবার জিপি সাহেব জেলা প্রশাসককে লিখিতভাবে মতামত দেন যে, ‘আপিল করে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। কারণ এই জমি আসলে ব্যক্তি মালিকানাধীন।’
জেলা প্রশাসক জিপি সাহেবের মতামতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি ওই যুগ্ম সচিবকে জমির রেকর্ড সংশোধনের ব্যবস্থা না করে দিয়ে বিষয়টি ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন এবং করণীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা চান। যুগ্ম সচিব এবার ভূমি মন্ত্রণালয়ে বারবার যেতে থাকেন। কিন্তু সেখানে তিনি কোনো কর্মকর্তার কাছ থেকেই কোনো ইতিবাচক সহযোগিতা পাননি। তখন তিনি আমার কাছে আসেন। কারণ তিনি যখন জেলা প্রশাসক ছিলেন, তখন আমি তার অধীনে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম। আর আমি এই সময় সচিব বিধায় তার মনে ধারণা হয়েছিল যে, আমি যদি ভূমি সচিবকে বলে দিই, তবে তার কাজটি দ্রুত হবে। আমি খুব আন্তরিকতার সঙ্গে ওই রিটায়ার্ড যুগ্ম সচিব স্যারকে নিয়ে ভূমি সচিবের কাছে গেলাম। ভূমি সচিব ছিলেন আমার খুব ঘনিষ্ঠ এবং তিনিও খুব সম্মান দিয়েই বিষয়টি দ্রুত ইতিবাচকভাবে নিষ্পত্তির জন্য তার অধীন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ডেকে বলে দিলেন। আমরা খুশি হয়ে চলে এলাম।
কয়েক দিন পর ওই স্যার এসে জানালেন, ভূমি মন্ত্রণালয় হতে এখন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছে। কারণ বিবেচ্য জমির পাশেই ছিল গণপূর্তের জমি। বিএস জরিপে এই জমি ও বিবেচ্য জমি নিয়ে বদর আমিন একটা সিঙ্গেল প্লট করেছে। আর ওই পল্টের অংশবিশেষ এখন গণপূর্তের নামে রেকর্ডকৃত। বাকিটা (অর্থাৎ পূর্বে যেটা যুগ্ম সচিব সাহেবের আত্মীয়ের নামে রেকর্ড ছিল) ১ নম্বর খাস খতিয়ানে রেকর্ডকৃত। তাই তো বলি, ভাগ্য যদি খারাপ হয় তবে দুর্ভোগের আর শেষ থাকে না।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ভূমি মন্ত্রণালয় হতে চিঠি পেয়ে সরেজমিনে পরিমাপ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই পরিমাপ হতে হবে আবার যৌথভাবে। কারণ বাকিটা ডিসির নামে রেকর্ড আছে। সুতরাং এবার গণপূর্ত ও এসিল্যান্ড অফিসের সার্ভেয়ার মিলে মাপ হতে হবে। বাস্তবে সে মতেই পরিমাপ করা হয়। অবশেষে গণপূর্তের জমিও তাদের দখলে ঠিকঠাকমতো পাওয়া যায়। কাজেই বিবেচ্য জমিতে সরকারি স্বার্থ ছিল না। তার প্রতিবেদনও তৈরি হয়।
কিন্তু ওই যুগ্ম সচিবের পায়ের জুতা ততদিনে ক্ষয় হয়ে গেছে অনেকটা। আর সেই প্রতিবেদন পূর্ত মন্ত্রণালয় হয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে পৌঁছানোর পরও আমার ঘনিষ্ঠ সচিব ওই বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে পারেনি। কারণ প্রথমত নিচের দিকের কর্মকর্তাদের অনীহা ছিল এটা নিষ্পত্তির জন্য নথিতে ইতিবাচক নোট দিতে (সরকারি স্বার্থ(?) ক্ষুণ্ন হবে বলে)। কারণ তাদের জনমুখী ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। দ্বিতীয় কারণ সচিবের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া (তবে সচিব চাইলে চাকরি শেষ করার আগে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে পারতেন)।
কিন্তু আমাদের প্রত্যাশামতে তার নিষ্পত্তি আর হলো না। আর এভাবেই বিলম্বে বিলম্বে গঙ্গার পানি অনেকদূর গড়িয়েছে। ফলে যা হলো, সেটা হলো ‘আর্তনাদ’। আমি দেখলাম একজন সৎ কর্মকর্তার আর্তনাদ। যেই কর্মকর্তা তার কর্মকালে মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে সেবা দিয়েছেন। যিনি সারা জীবন মানুষের সেবা করেছেন সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে, যিনি মানুষের হয়রানি পছন্দ করতেন না, তাকেই দেখেছি ঘাটে ঘাটে হয়রানি হতে আর অসম্মানিত হতে। তিনি তার জুনিয়র সহকর্মীর কাছ থেকেই সময়মতো ও ন্যায়সংগতভাবে সুবিচার ও সহযোগিতা পাননি। এ দুঃখে তিনি আমার কাছে চোখের জল সংবরণ করতে পারেননি।
এই হলো আমাদের প্রশাসন। এই হলো আমাদের ভূমি ব্যবস্থাপনা। একজন রিটায়ার্ড যুগ্ম সচিবের ক্ষেত্রে যদি এমন ঘটনা ঘটে, তবে ভাবতেই আমার ভয় হয় যে, এ দেশের অতি সাধারণ মানুষের সেবাপ্রাপ্তি আমরা কতটুকু নিশ্চিত করতে পারছি?
প্রিয় পাঠক, এখন আমিও রিটায়ার্ড। আর রিটায়ার্ড হওয়ায় এরই মধ্যে আমি ওই রিটায়ার্ড জেলা প্রশাসক ও যুগ্ম সচিব মহোদয়ের মতোই নিজের আত্মীয়স্বজনের জন্য কিছু ঘটনায় অনুরূপ অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। আমিও এক জেলা প্রশাসকের কাছে একটা আবেদন করে দীর্ঘ পাঁচ মাসেও কোনো সিদ্ধান্ত পাইনি। অথচ ডিসি সাহেব মুখে বলেছেন, ‘স্যার, ধরে নেন এটা হয়ে গেছে। কোনো সমস্যা নেই। এই তো করে দিচ্ছি।’ কিন্তু কার্যত আমারও স্যান্ডেল ক্ষয় হচ্ছে। কাজ আর হচ্ছে না।
অবশ্য এ কথাও সত্য যে, অনেকেই সাক্ষাতে খুব সম্মান দিয়ে কথা বলে। আর আচরণে-আপ্যায়নে অমায়িক ব্যবহার করে থাকে বটে কিন্তু ভূমিসংক্রান্ত সমস্যার সমাধানে বা সার্ভিস ডেলিভারির ক্ষেত্রে সময়মতো সেবা পাওয়া সুদূরপরাহত। কখনো কখনো সিনিয়র কলিগ হিসেবে একটু-আধটু খাতির বা সম্মান দেখিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা পাওয়া যায়, আবার কোনো কোনো কর্মকর্তার কাছে তাও পাওয়া যায় না।
উল্লেখ্য, ভূমিসেবার ক্ষেত্রে বিষয়গুলোকে অহেতুক জটিল করে ফেলা হয় এবং অহেতুক সময়ক্ষেপণ করা হয়। এটার কারণ অনেকেই ভূমি আইন স্পষ্ট করে বোঝে না বা মান্ধাতার আমলের সেই ঔপনিবেশিক মনোভাব নিয়ে কাজ করে (কেউ কেউ সহজ বিষয়কে খুব জটিল করে উপস্থাপন করে সুবিধা নিতে অভ্যস্ত কর্মচারীদের দ্বারা প্রভাবিত)। এরা জনদরদি (pro people) হতে পারে না। ফলে জনগণ চরম ভোগান্তিতে পড়ে।
আমি এ বাস্তব ঘটনাটি লিখছি এজন্য যে, আমাদের বর্তমান প্রজন্মের অফিসারদের বিবেক যেন জাগরিত হয় এবং নিম্নে বর্ণিত বিষয়গুলো একটু মনে রাখে (যদি কেউ এটা পড়ে তবে, আর বোধোদয় না হলেও আমার ক্ষতি নেই):
(১) মনে রাখা দরকার যে, আজ যে ক্ষমতার চেয়ারখানা আছে, একদিন তা ছেড়ে চলে আসতে হবে। তখন এই চেয়ারে যিনি থাকবেন তার কাছেই আবার নিজের সমস্যা নিয়ে যেতে হতে পারে।
(২) সম্মানের বিষয়টি একমুখী নয়, কাউকে সম্মান দিলে তবেই অন্য কেউ আবার আমাকে সম্মান দেবেন। অন্যথায় তা আশা করা সমীচীন নয়। এজন্য চেয়ারে থাকা অবস্থায় চেয়ারবিহীন মানুষদের সম্মান দেওয়ার অভ্যাস থাকা ভালো।
(৩) আজকে কেউ কোনো সমস্যা নিয়ে চেয়ারের কাছে এলে তার সমাধান যত দ্রুত সম্ভব আইনানুগভাবে দিতে হবে। মনে রাখা দরকার যে, ভবিষ্যতে এমন সমস্যা নিয়ে তাকেও কারও কাছে যেতে হতে পারে এবং তখন তাকেও অনুরূপ পরিস্থিতির শিকার হতে হবে।
(৪) ভূমি আইনকে ভালোভাবে বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। আইনের অপব্যাখ্যা করা সমীচীন নয়। যারা ভূমি আইন ভালো বোঝে বা জানে এবং প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা, তাদেরই ভূমি মন্ত্রণালয়ে বা ভূমিসংক্রান্ত দপ্তরে পদায়ন করা দরকার। অন্যথায় অহেতুক বিষয় নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হবে আর মানুষের ভোগান্তি হবে এবং হয় বটে।
লেখক: প্রাক্তন সিনিয়র সচিব ও
চেয়ারম্যান, বিটিআরসি, ঢাকা