ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) চার সদস্যের প্রতিনিধিদল সুপ্রিম কোর্টে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করছে, অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা কার্যালয়ের গেটের সামনে তুমুল বিক্ষোভ করছেন। ইইউ প্রতিনিধিরা অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে আসার খবর পেয়ে বিএনপিপন্থি শতাধিক আইনজীবী তার কার্যালয়ের গেটের সামনে এসে জড়ো হন। দোতলায় যখন অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে বৈঠক চলছিল, নিচে গেটের সামনে তখন বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের বিশাল এ বাহিনী প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভ করে।
এটা টিভির পর্দায় ভেসে ওঠা খবরের দৃশ্য। এ দেখে আঁতকে উঠলাম। বিকেলে মগভর্তি চা হাতে এমন অভাবনীয় কাণ্ড দেখে বিস্ময় জন্ম নিল আমার। ভব্যতাবহির্ভূত এমন কেন করছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা! কী হতে পারে কারণ? এমন করে সত্যিই কি সভ্য-ভব্য, কূটনৈতিক শিষ্টাচারসম্পন্ন ইউরোপীয়দের কথা শোনানো যায়? যায় না। এ আমি খুব ভালো করেই জানি।
উন্নত বিশ্বে, যাকে এখন আধুনিক কেতায় বলে ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি, দুটো দেশের কূটনৈতিকদের সঙ্গে পুরো ২৪ বছর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছি। দায়িত্ব পালনকালে ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সব জাতীয় নির্বাচনে পর্যবেক্ষক ছিলাম, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে ওই দেশের নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের সমন্বয়কও ছিলাম। এর ফলে রাজপথে, নিবাচনী কেন্দ্রে, বা শীর্ষ নেত্রী-নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার আলোচনায় অংশ নিয়েছি অসংখ্যবার; কখনোই এমন অভিজ্ঞতা হয়নি আমাদের; দেখিনি বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতা, কর্মীরা আমাদের গায়ের ওপর এসে বিরক্তিকর, অসৌজন্যমূলক বিক্ষোভ আয়োজন করেছেন।
ইউরোপীয় বা আধুনিক বিশ্বের মানুষরা বিশেষত কূটনীতিবিদরা বিবেচনা করে, ফ্যাক্টস। সেখানে মনোযোগ দেয়, যেখানে ফালতু কোনো বাড়াবাড়ি নেই। যথার্থ করে বুঝতে চায় বিষয় ও ঘটনার মধ্যে মূল সত্য। সেটিই তাদের চিন্তার জগতে মূল্যবান। এও বলি, তাদের কেউ যদি গায়ের জোরে বোঝাতে চায় কোনো কিছু, তা হলে কী পরিমাণ বিরক্ত হয়, তারাই জানে, যারা তাদের সঙ্গে কাজ করেছে বা ওইসব দেশের সামাজিক সংস্কৃতিকে চেনে, বুঝে।
কিন্তু সেদিন কী দেখল সারা দেশের মানুষ? অবুঝপনা বা নেহাতই শিশুসুলভ আচরণ। টেলিভিশনে প্রচারিত খবরে পুরো দৃশ্যে ফুটে উঠেছে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের কর্মকাণ্ড। মনে হলো তাদের ভাবখানা, অ্যাটর্নি জেনারেল যা বলবেন, তা তোমরা শুনতে না পাও। যদি তাদের কথা শুনতে না পাও, তবে আমাদের বলা কথাই শুধু তোমাদের কানে যাবে। বৈঠক চলাকালে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের বাইরে গেটের সামনে গত মঙ্গলবার দুপুরবেলা এ ঘটনা। বিক্ষোভে বিএনপির আইনজীবীরা চিৎকার করেই চলেছেন, ‘উই ওয়ান্ট ডেমোক্রেসি, নো মোর হাসিনা’, ‘উই ওয়ান্ট ভোটিং রাইট, নো মোর হাসিনা’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস, নো মোর হাসিনা’, ‘উই ওয়ান্ট কেয়ারটেকার, নো মোর হাসিনা’ স্লোগানে কাঁপিয়ে তুলছেন তারা। খবরের ছবিতেই বোঝা গেল এতেও তারা তৃপ্ত হননি। ভাবলেন, এবার গায়ের কাছ ঘেঁষে চিৎকার করে বলা দরকার। তাই করতে শুরু করলেন। বৈঠক শেষে ইইউ প্রতিনিধিদলটি যখন বের হয়ে আসার জন্য কার্যালয়ের নিচে নেমে আসা মাত্র আরও জোরালো স্লোগান। গননবিদারী স্লোগান।
এ সময় ইইউ প্রতিনিধিরা কিছু সময় দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিলেন। মিনিট দুই পর বিক্ষোভ মিছিলের ভেতর দিয়ে তারা অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে বের হয়ে যান। এরপর ইইউ প্রতিনিধিরা শুধুই নিজেরা দাঁড়িয়ে। গাড়িতে উঠতে যাবেন। চাইলেই তো হয় না। এটা বিএনপিপন্থি আইনজীবীর বিক্ষোভ। বিক্ষোভকারীরা গাড়ির চারপাশ ঘিরে ধরেন। পুলিশ তাদের সরাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তারা ভাবলেন, ব্যারিকেড বলেও তো একটা বিষয় আছে। দুহাত বাড়িয়ে আটকে ফেলো। ‘যেতে নাহি দেব’। হে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিরা, শোনো, শোনো আমাদের যত কথা, আছে যত আমাদের মনে। অতএব, বিক্ষোভকারী বিএনপিপন্থি এক নারী আইনজীবী গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যান। এবার তোমরা পালাবে কোথায়। দাড়িয়াবান্ধা খেলার মতো। দুহাত দুদিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি। এমন এক আজব নাটকীয় ব্যাপারস্যাপার। বেচারা ইইউ চার সদস্যের প্রতিনিধি! কী করুণ তাহাদের মুখ। অনেক কষ্টে পুলিশ সেই নারী আইনজীবীকে সরালে ধীরগতিতে গাড়ি চলতে শুরু করে। কিন্তু ব্যারিকেড সরালেও সবাই ভাবলেন, শোনানো তো এখনো বাকি! এবার তখন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে করতে গাড়ির পেছন পেছন সুপ্রিম কোর্টের বার কাউন্সিলসংলগ্ন গেট পর্যন্ত আসেন। অথচ অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে ইইউ প্রতিনিধিদের বৈঠক এমন ছিল না যে, এখানে নির্ধারিত হবে বাংলাদেশের আসছে সাধারণ নির্বাচনের পদ্ধতি। এখানেই ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিলেই সরকার কুপোকাত হবে। অথবা বিরোধীরা চায় প্রথমবারের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জানতে পাবে। যা জানার, তা তারা অনেক আগে থেকেই জানে। সেই আলোচনায় ছিল আরপিও, ফৌজদারি-দেওয়ানি আইন ও নাগরিকের অধিকার সম্পর্কে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আগ্রহ। খবরে যতটুকু জানা যায়, আলোচনায় সুনির্দিষ্ট কিছু ছিল না। বাংলাদেশের আইন সম্পর্কেই তারা জানতে চেয়েছেন। এ সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, এর প্রয়োগ বা কোনো বিশেষ মামলা নিয়ে আলোচনা হয়নি বলে জানা গেছে। তবে বলা ভালো, এসব আলোচনার ফাঁকেই কূটনৈতিক কৌশলে তারা হয়তো বুঝতে চেয়েছে অ্যাটর্নি জেনারেলের মনস্তত্ত্ব। হয়তো এমন ছিল, তারা অনুধাবন করতে চেয়েছে বাংলাদেশের আইন বিষয়ে তিনি কতটুকু নাগরিকদের জন্য নির্দলীয় ভাবনা ভাবেন।
কেন আইনি বিষয়ে অনেক জানতে চান তারা? এমন প্রশ্নের সংগত উত্তর মনে হয় এরকম, বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগকৃত পুঁজির সুরক্ষা। জনগণ যদি ভালো থাকে, তবে বাংলাদেশের সমাজে ক্ষোভ কম হবে, সুস্থির হবে সমাজ। বাংলাদেশ সুস্থির থাকলে ইইউর বিনিয়োগ ও বাণিজ্য চলবে মসৃণভাবে। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি ইইউর বিনিয়োগ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশের দিক থেকে নীতিমালা পরিবর্তন করা হলে তা দ্রুত পরিবর্তিত হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যবসা করার জন্য একটি চমৎকার জায়গা।’ দৃশ্যমানরূপে বাংলাদেশে ইইউর ২ বিলিয়ন ডলারের এফডিআই মজুত রয়েছে। ‘স্ট্রেংদেনিং বাংলাদেশ-ইউ ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন : ইস্যুজ অ্যান্ড পলিসি প্রায়োরিটিজ’ শিরোনামে এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ইউরোপের ২৭ দেশে বছরে বাংলাদেশ এখন ২৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। এর পরিমাণ আরও ১৮ বিলিয়ন বাড়ানো সম্ভব সক্ষমতা ও পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়িয়ে। ২০০০-০১ সালে ইউকে এবং ইইউতে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি ছিল ২.৫ বিলিয়ন ডলারের। গত ২০-২১ বছরে তা এখন ১০ গুণ বেড়ে ২৫ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। ইউরোপে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের শতকরা ৯০ ভাগই তৈরি পোশাক। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো থেকে নেট এফডিআই প্রবাহ গত পাঁচ বছরে ৩.৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা এ সময়ের মধ্যে মোট এফডিআই প্রবাহের প্রায় এক-চতুর্থাংশ।
বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ ও নির্বাচন-পূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় ইইউর নির্বাচনসংক্রান্ত তথ্যানুসন্ধানী একটি দল ১৬ দিনের সফরে গত শনিবার ঢাকায় এসেছে এবং প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হয়েছে এমন পরিস্থিতির। বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা এমন করেছেন, যেন তাদের রাজনৈতিক বসরা দেখেন তারা খুব সক্ষম, তৎপর, দক্ষ। এটা প্রমাণ হলে আসছে দিনে ক্ষমতার যদি পালাবদল হয়, তবে এসব নেতা বড় বড় পদ পাবেন। রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ হবে। বসকে সন্তুষ্ট করতে তারা অস্থির বোধ করছেন বিদেশিদের কাছে নিজেদের রাগ উপস্থাপন করতে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যাচ্ছেন না কেন এ নিয়ে চঞ্চল। আবার অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীনরা সংবিধানে প্রণীত ধারা বলে নির্বাচন করতে অনড়। বুধবার বিএনপি এক দফা ঘোষণা করেছে। কিন্তু সরকার বলছে, বিএনপির এক দফা দাবি সংবিধানের পরিপন্থি। সরকার মনে করে, বিএনপি ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের পরিকল্পনা করছে। আওয়ামী লীগ তাদের ভাষায় বলছে, তারা শান্তি ও স্থিতিশীলতার বিষয়ে আপস করব না। কিন্তু দুপক্ষের মাঝ দিয়ে জনগণ বলছে, জনগণ সংঘাত চায় না। জনগণ চায়, পেট ভরে খাওয়া, সন্তানের লেখাপড়া, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা।
লেখক : সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন