মেজর (অব.) ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ
প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৩৪ এএম
আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৩৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ওমর আলি সাইফুদ্দিন মসজিদ

ওমর আলি সাইফুদ্দিন মসজিদ

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দক্ষিণ চীন সাগরের তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দ্বীপের নাম বর্ণীয়। এ দ্বীপটি তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম দুটি ভাগ যথাক্রমে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার অন্তর্ভুক্ত। আর অন্য অংশের ৫৭৬৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে আলাদাভাবে গড়ে উঠেছে তেল, গ্যাস ও অন্যান্য খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ একটি ধনী রাষ্ট্র ব্রুনাই দারুস সালাম। এ ভূখণ্ডের জনসংখ্যা সাড়ে চার লাখেরও কিছু বেশি, যার মধ্যে প্রায় ৮৩ শতাংশই মুসলমান।

ইতিহাস মতে, ১৪০০ শতকে ব্রুনাইয়ে ইসলাম প্রচারকদের আগমন শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার। সেইসঙ্গে বৃদ্ধি পায় মসজিদ, ঈদগাঁ, মাদ্রাসা প্রভৃতির নির্মাণ। ১৯৫০ সালে ব্রুনাইয়ের তৎকালীন সুলতান আহামাদ তাজুউদ্দিন ইংল্যান্ডে যাওয়ার পথে সিঙ্গাপুরে হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তারই ছোট ভাই এবং বর্তমান সুলতানের বাবা তৃতীয় ওমর আলি সাইফুদ্দিন মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই তিনি ব্রুনাইয়ের রাজধানী বন্দরসেরি বেগাওয়ানে একটি আকর্ষণীয় ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ার চিন্তা করতে থাকেন। সেই চিন্তা অনুযায়ী ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮—এ চার বছরে তৎকালীন ১০ লাখ ডলার ব্যয়ে গড়ে ওঠে ব্রুনাইয়ের অহংকার বলে খ্যাত অপরূপ মুসলিম স্থাপত্য ‘ওমর আলি সাইফুদ্দিন মসজিদ’।

একটি সূত্রের দাবি, ওমর আলি সাইফুদ্দিন মসজিদের আগে ব্রুনাইয়ের রাজধানী ও সবচেয়ে বড় শহর বন্দর সেরি বেগাওয়ানে আক্ষরিক অর্থেই স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনো মসজিদ ছিল না। বিশাল শহরে ‘মারবুত পাক টুঙ্গাল’ ছিল কাঠের তৈরি একমাত্র ছোট্ট মসজিদ। তৃতীয় ওমর আলি সাইফুদ্দিনের দাদা সুলতান মুহাম্মদ জামালুল আলমের আমলে নির্মিত ৫০০ মানুষের ধারণক্ষমতার ওই মসজিদটির ছাদ তৈরি হয়েছিল পামগাছের বড় বড় পাতা দিয়ে। তবে তেল উৎপাদন শুরু হলে ব্রুনাইয়ের অর্থনীতির চাকা সচল হয় এবং সুলতান সাইফুদ্দিনও উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প হাতে নিতে শুরু করেন। তার আমলেই নির্মিত হয় ওমর আলি সাইফুদ্দিন মসজিদ।

মালয়েশিয়াভিত্তিক স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান বোটি এডওয়ার্ডস অ্যান্ড পার্টনারসকে এ মসজিদের নকশা প্রণয়ন করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। মূলত সুলতান ওমর আলি সাইফুদ্দিন এ মসজিদটির অবয়ব কল্পনা করেন এবং ইতালিও ভাস্কর রুদলফো নল্লির কাছে তার কল্পনার কথা প্রকাশ করেন। এরপর রুদলফো নল্লির কাছ থেকে ধারণা নিয়ে মালয়েশিয়ার স্থপতিরা মুঘল স্থাপত্য রীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এ মসজিদটির নকশা করেন।

মসজিদটির দৈর্ঘ্য ২২৫ ফুট (৬৯ মিটার) প্রস্থ ৮৬ ফুট (২৬ মিটার) এবং উচ্চতা ১৭১ ফুট (৫২ মিটার)। ঠিক মাঝখানে নির্মিত ও স্বর্ণ দ্বারা আচ্ছাদিত একটি গম্বুজ মসজিদটির অন্যতম আকর্ষণ। ইতালি থেকে ২ লাখ ডলার ব্যয়ে আমদানিকৃত মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত হয়েছে মসজিদের মেঝে ও কলাম। মসজিদে ব্যবহৃত ৬৯টি বাতিবিশিষ্ট ঝাড়বাতিটির উচ্চতা ১৫ ফুট এবং ওজন ৩ টন। মেঝেতে পাতা হয়েছে বেলজিয়াম ও সৌদি আরব থেকে আনা হাতে বোনা কার্পেট। আর দরজা নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে ফিলিপাইনের কাঠ। মসজিদে আরও নির্মিত হয়েছে ১৭১ ফুট উচ্চতার মিনার। লিফটে চড়ে এ মিনারের ওপরে ওঠা যায় এবং পুরো রাজধানীর অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়।

পাঁচ একর জমির ওপর নির্মিত এ মসজিদে একসঙ্গে তিন হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের প্রায় চারদিক ঘিরে আছে মানব সৃষ্ট একটি জলাধার (লেগুন)। আর জলাধারের মাঝখানে নির্মিত হয়েছে ‘মাহিলিগাই’ নামক একটি কৃত্রিম নৌযান (বার্জ)। কথিত আছে যে, ১৬০০ দশকে ব্রুনাইয়ের তৎকালীন সুলতান বালকিয়া ঠিক এ ধরনের একটি নৌযান ব্যবহার করতেন, যা স্মরণ করেই এ কৃত্রিম নৌযান নির্মিত হয়েছে। সুদৃশ্য জাহাজের মতো দেখতে মসজিদের পাশের এ স্থাপনাকে সংযুক্ত করে এখানে নির্মিত হয়েছে আরেকটি মর্মর পাথরের সেতু। একসময় এটি ব্যবহার করা হতো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের জন্য। এ কৃত্রিম নৌযানটি উদ্বোধন হয় ১৯৬৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর। পবিত্র কোরআন শরিফ নাজিলের ১৪০০ বছর পূর্তিকে স্মরণ করে কৃত্রিম নৌযান নির্মিত ও উদ্বোধন হয়েছিল, যা আজ দেশটির অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। জলাধারের একদিকে থাকা সর্পিলাকার একটি সেতু সত্যিই দেখার মতো।

কৃত্রিম আলোর সুপরিকল্পিত ব্যবহারের কারণে মসজিদে স্বর্ণনির্মিত গম্বুজটি রাতের বেলায় অনেক দূর থেকেই স্পষ্ট দেখা যায়। তখন পুরো এলাকায় সোনালি আভায় ভরে যায়। বিদেশ থেকে আসা রাষ্ট্রীয় অতিথিসহ সর্বস্তরের পর্যটক ব্রুনাই ভ্রমণকালে এ মসজিদটি দেখার সুযোগ নেন।

ব্রুনাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দক্ষিণেই ওমর আলি সাইফুদ্দিন মসজিদ। মসজিদের আশপাশে রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম প্রাসাদ তথা সুলতানের বাসভবন ‘ইস্তানা নুরুল ইমান’, রয়্যাল রিগ্যালিয়া মিউজিয়াম, ব্রুনাই মিউজিয়াম ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম ‘ওয়াটার ভিলেজ’ বা ভাসমান গ্রাম ক্যাম্পং আইয়ার। মসজিদ ঘুরে দেখতে গেলে এ স্থানগুলোও ঘুরে দেখেন পর্যটকরা।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর, গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এসএসসির ফল ঘোষণা আজ

৩৫ প্রত্যাশীদের আমরণ গণঅনশন

আজ থেকে নতুন দামে কিনতে হবে সোনা 

দুঃসংবাদ দিল আবহাওয়া অফিস

রিয়াল বিক্রির নামে প্রতারণা, মূলহোতা ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

পানিতে ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যু

ট্রাকচাপায় প্রাণ গেল নারীর

ইয়াবাসহ মাদক কারবারি আটক

এবার নাগালের বাইরে শুঁটকি বাজার

জাজিরা প্রেস ক্লাবের সভাপতি পলাশ, সম্পাদক শাওন

১০

ভারতের সঙ্গে শত্রুতা করে বিএনপি দেশের ক্ষতি করেছে : ওবায়দুল কাদের

১১

আরেক জিম্মির ভিডিও প্রকাশ করে ফিলিস্তিনিদের সতর্কবার্তা

১২

হলফনামা বিশ্লেষণ / এমপি পুত্রের চেয়ে ভাইয়ের সম্পদ ৭ গুণ বেশি 

১৩

টেকনাফ-উখিয়ায় পানি ও আবাসস্থল সংকটে বন্যপ্রাণীকূল

১৪

এসএসসির ফল রোববার

১৫

পুলিশ-সাংবাদিক পেটানোর মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান মিঠু গ্রেপ্তার

১৬

পানির নিচে তলিয়ে গেছে টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়ক

১৭

হবিগঞ্জে ট্রিপল হত্যা মামলার প্রধান আসামি গ্রেপ্তার

১৮

ব্র্যান্ড প্র্যাক্টিশনার্স বাংলাদেশের মার্কেটিং ফেস্ট অনুষ্ঠিত

১৯

বিএনপি আগের চেয়ে শক্তিশালী : শামা ওবায়েদ

২০
X