মহসীন হাবিব
প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৫১ এএম
আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৪৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আত্মসন্তুষ্টি নয়, কান পেতে শুনুন

আত্মসন্তুষ্টি নয়, কান পেতে শুনুন

যে কোনো দেশের সরকারের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো জনগণের পালস বোঝা। অর্থাৎ সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা কী চায়, কোথায় সরকারের দুর্বলতা আছে বলে মনে করে, কোন কোন ক্ষেত্রে নাগরিকরা অসুবিধা বোধ করছে, কী কী কারণে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে—এসব কান পেতে শোনা। যদি রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান এ পালস বুঝতে না পারেন, তাহলে তার পরিণতি কী হতে পারে, সেটা আমরা দেখেছি বহু দেশে, বহুবার। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও জনক মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে অজ্ঞানতাও অজানা নয়। জিন্নাহর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় পূর্ববঙ্গের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিয়েছিল পাকিস্তানের অংশ হতে। কিন্তু জিন্নাহ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মানুষের পালস বুঝতে পারেননি। শুধু তাই নয়, ভারত বিভক্তির আগে ১৯৪৬ সালের মে মাসে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধিদল জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হওয়ার জোর দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু জিন্নাহ তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছিলেন বার্মার অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে। স্থির মাথায় লিয়াকত আলি খান, ফাতিমা জিন্নাহ বা একান্ত ঘনিষ্ঠ কেউ জিন্নাহকে বিষয়টি বোঝাতে চেষ্টা করেননি। করলে মানচিত্রের কিছুটা হেরফের হতে পারত। শোনা যায়, জিন্নাহ জানতেনই না যে, পূর্ববঙ্গের মানুষ উর্দু ভাষাই জানে না এবং তিনি এটাও জানতেন না যে, বাংলার মানুষ তাদের ভাষাকে কতটা গুরুত্ব দেয়। এ অজ্ঞানতাও অপরাধ ও উপেক্ষার শামিল। জিন্নাহর ওই না বোঝার ফল রোহিঙ্গারাও ভোগ করেছে আবার বাংলাদেশ ভোগ করে প্রতিশোধ গ্রহণ করে স্বাধীনতা লাভ করেছে। অন্য কথায় চলে গেলাম কি?

আধুনিককালে সরকারপ্রধানকে এ পালস বুঝতে সহায়তা করে মূলত দলীয় নেতাকর্মী, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান অথবা থিঙ্কট্যাঙ্ক। দুঃখের বিষয় এর কোনো একটি সত্তা সরকারপ্রধানকে সঠিক রিপোর্ট করেন কি না, তা নিয়ে নানা মহলে সন্দেহ আছে। অথবা করলেও তা সরকারপ্রধানের চোখ পর্যন্ত পৌঁছে কি না, জানা নেই। নির্বাচন হয়ে গেছে এবং প্রধানমন্ত্রী পঞ্চম দফা এবং টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে দেশ চালাচ্ছেন। নির্বাচন বিতর্কিত ছিল এবং দেশে-বিদেশে সমালোচনা হয়েছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এখন সারা দেশে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নেই, কোনো বিক্ষোভ নেই, সড়ক অবরোধ নেই, জ্বালাও-পোড়াও নেই। অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে শান্ত। কিন্তু অসন্তোষ দানা বেঁধে আছে বিশাল আকারে। সেটা কারও না বোঝার কথা নয়। একটু গভীরভাবে তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এ অসন্তোষ যতটা না নির্বাচন ঘিরে তার চেয়ে অনেক বেশি দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দুর্বলতা নিয়ে। ছোটমুখে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, যে অরাজকতা চলছে তা সামাল দিলে সারা দেশের মানুষের ক্লেদ, ক্ষোভ অনেকটাই প্রশমিত হতে পারত। কী সেই অরাজকতা যা সরকারের বোঝা খুবই প্রয়োজন? এই অরাজকতার মূলে আছে ব্যাংক লুটপাট, মানি লন্ডারিং, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, রাষ্ট্রের কর্মচারীদের ঘুষবাণিজ্য, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের সাধারণ মানুষের প্রতি অনাচার ও দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ এবং বক্তব্য। এসব সমস্যা তো বিশেষ কোনো বলার মতো বিষয় নয়, একটি সরকারের অবশ্যকরণীয়! কিন্তু হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প চালু আছে ফরাসি বিপ্লব সম্পর্কে। যদিও এটি একটি গল্পই, এর কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা কোথাও খুঁজে পাইনি। ফরাসি বিপ্লবের মুখে দেশের মানুষের পেটে কোনো আহার ছিল না। কিন্তু রাজপ্রসাদে ছিল ভিন্ন পরিবেশ। সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের স্ত্রী এবং ফ্রান্সের শেষ সম্রাজ্ঞী মারি আতোয়েঁতে তখনো খুব বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন (তাকে নিয়ে অবশ্য অনেক গল্প আছে)। তিনি নাকি প্রাসাদের বাইরে জনতার চিৎকার হট্টগোল শুনতে পেয়ে রাজকর্মচারীদের কাছে জানতে চান, ওরা চেঁচামেচি করছে কেন? কর্মচারীরা মাথা অবনত করে উত্তরে জানায়, মহারানি, ওরা রুটি খেতে চায়। তিনি অবাক হয়ে বলেন, আশ্চর্য! ওরা রুটি খেতে চায় কেন, কেক খেতে পারে না! তিনি জানতেনই না যে দেশের মানুষ অর্ধাহার, অনাহারে আছে। গল্পটি সত্য না হলেও এ গল্পের মধ্যে একটি সত্যের আবহ আছে। সম্রাটের রাজপ্রাসাদ সাধারণ মানুষের পালস বুঝত না। যার পরিণতি কী ভয়াবহ হয়েছিল তা আমরা কমবেশি জানি। আমরা চাই ‘মধ্যস্বত্বভোগীদের’ কারণে যেন আমাদের উচ্চমহলে এমন পরিবেশ না সৃষ্টি হয়।

জনগণের কথা শোনার বা মনোভাব বোঝার একটি সাম্প্রতিক ঘটনা দেখতে পাচ্ছি দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরে। একসময় ইকুয়েডর দেশটি শান্তই ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সন্ত্রাসীরা অশান্ত করে ফেলেছে দেশটিকে। বিশেষ করে মাদক কারবারি এবং কিছু স্থানীয় গ্যাং সম্প্রতি দুজন মেয়রসহ কয়েক ডজন মানুষ হত্যা করেছে। এমনকি গত বছর আগস্ট মাসে একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে হত্যা করেছে। এ সন্ত্রাসীরা কয়েক ডজন মানুষকে অপহরণ করে। মানুষ নিজেদের সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি বলে মনে করতে শুরু করেছে। এর মধ্যেই ৩৫ বছর বয়সী দানিয়েল নোবোয়া গত নভেম্বর মাসে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং এ সমস্যাটিকে তিনি বড় ধরনের সমস্যা বলে চিহ্নিত করেন। ফলে মাদক কারবারি এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তিনি ২১ এপ্রিল একটি গণভোটের আয়োজন করেন। এতে ১১টি বিষয়কে প্রস্তাব করা হয়। এর মধ্যে পুলিশের ক্ষমতা বৃদ্ধি, পুলিশের সঙ্গে সেনাবাহিনীর যৌথভাবে কাজ করা, অপরাধীদের শাস্তি বৃদ্ধি করা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ইকুয়েডরের জনগণ এ গণভোটকে খুবই ইতিবাচক দৃষ্টিতে গ্রহণ করেছে।

আমরা কোনো রেফারেন্ডামের কথা বলছি না। দেশে যে প্রচলিত আইন আছে, সেই আইনে অপরাধীর যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় প্রায়োরিটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কথাটি দেশের প্রধান নির্বাহীকে কারও না কারও জানানো অতি প্রয়োজন। হয়তো কেউ বলতে পারেন তিনি কী জানেন না যে তাকে অর্ধাহারি সাংবাদিকের উপদেশ দিতে হবে? জানেন নিশ্চয়ই। কিন্তু নিশ্চিত সেই জানায় ঘাটতি থেকে যায় আমলাতান্ত্রিক কারণে। তাকে শুধু সব ব্যাপারে ইতিবাচক কথা বলে গেলে তার কাছে ইনফরমেশনের ঘাটতি হতে পারে।

বাস্তবে দেশের পরিস্থিতি কী দেখছি আমরা? সম্প্রতি কারিগরি সনদ জালের যে ঘটনা উন্মোচিত হয়েছে, তা দেশের সার্বিক চিত্রের একটি উদাহরণ। কত বিশালসংখ্যক মানুষ এ জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত তার একটি ফিরিস্তি এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। একজন অপরাধী নাম ধরে ধরে বলেছেন, কারা কারা জড়িত, কে কত টাকা গ্রহণ করেছেন। তারপরও মানুষের মনে শঙ্কা রয়েছে, এ অপরাধের সঙ্গে জড়িত সবাইকেই আইনের আওতায় আনা হবে কি না, তা নিয়ে। আমাদের আশঙ্কাও এ জায়গাতেই। সরকারকে সেটা বুঝতে হবে। আবারও বলছি, নির্বাচন যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে। সরকার দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিলে, আইনের যথাযথ প্রয়োগের চর্চা শুরু করলে এ দেশের মানুষ সরকারের প্রতি যতরকম অসন্তোষ আছে, তা অনেকাংশেই মিনিমাইজ করে ফেলত। এমনিতেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সরকারের প্রতি মানুষের একটি প্রতিপক্ষ মনোভাব থাকে। কিন্তু সমস্যাগুলো সঠিকভাবে অ্যাড্রেস করলে মানুষের সে ক্ষোভ অনেকটাই প্রশমিত হয়। উন্নয়ন চলুক উন্নয়নের মতো। এখন সরকার যে অবকাঠামো উন্নয়ন অতি জরুরি বলে মনে করে, তাতে হাত দিক। কিন্তু মানবিক উন্নয়নও যে জরুরি সেটা উপেক্ষিত থাকলে কোনো উন্নয়নই দেশকে দাঁড় করাতে পারবে না।

আরও একটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করি। আমরা নানা প্রচারমাধ্যমে শুনছি বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয়, কৃষি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ, ধান-চাল উৎপাদনে সফল ইত্যাদি। কিন্তু এ দেশে লাখ লাখ মানুষ সাত দিনেও যখন একটি মাছ কিনতে পারে না তখন সব পরিসংখ্যান হাস্যকর হয়ে যায়। উৎপাদন অনেক বেড়েছে, কথা সত্য। কিন্তু রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজি, ওপেন টেলিফোনে আলোচনা করে দ্রব্যমূল্য চড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা চলছেই। এখন তরমুজের সময়। একটি তরমুজ উৎপাদক বিক্রি করছেন ২০ টাকায়, সেটি বড় শহরে এসে হয়ে যাচ্ছে ৩০০ টাকা! ফড়িয়া কারবার আগেও ছিল, এখনো আছে। এটি বাজার অর্থনীতির অংশ। কিন্তু এতটা জিম্মি করে কীভাবে—তা কিন্তু কারও কাজে অজানা নয়। জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা গেলেই এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারে সাধারণ মানুষ। তার জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন; যা এ দেশে আজীবন অনুপস্থিত! এবং দেশের মানুষকে এ কাঙ্ক্ষিত বিষয়টি উপহার দেওয়া না গেলে ফরাসি বিপ্লবের মতো গল্পই চলতে থাকবে। চলাটাই স্বাভাবিক।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে উড়ল রং-বেরঙের ঘুড়ি

যুদ্ধবিরতিতে ফিলিস্তিনিদের এক সপ্তাহের আল্টিমেটাম ইসরায়েলের

বাবার কোলে চিরনিদ্রায় সেই পেট জোড়া লাগানো জমজ শিশু

‘চাঁদপুরের ইলিশ বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করে তাই আমিও পছন্দ করি’

ভুয়া নিয়োগপত্রে কোটি টাকা হাতিয়ে নেন শিবলু, অতঃপর...

গাজায় ‘জয়ী’ হতে না পেরে অন্যত্র দৃষ্টি ইসরায়েলের

শুভ্রতার প্রতীক মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার আট মিনারবিশিষ্ট নান্দনিক মসজিদ

হাসপাতাল নয়, যেন তেলাপোকার বসতঘর

বঙ্গবন্ধু কন্যাকে নৌকাখচিত চেয়ার উপহার দিতে চান হিরু কারিগর

যবিপ্রবিতে ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন, ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই ফল

১০

‘রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলা প‌রিচালনার তহ‌বি‌ল অপর্যাপ্ত’

১১

প্রার্থীর আজব কাণ্ড, মোটরসাইকেল গাছে ঝুলিয়ে প্রচার

১২

উপজেলা নির্বাচন / ভোটের মাঠে মা-ছেলে-নাতি মুখোমুখি

১৩

চবিতে ‘ম্যাটেরিয়ালস, এনার্জি এন্ড এনভায়রনমেন্ট’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত

১৪

২৫-এ বিয়ে না করলেই শাস্তি!

১৫

গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা: ‘বি’ ইউনিটে পাবিপ্রবিতে উপস্থিতি ৮৪.২১ শতাংশ

১৬

কিম জং উনের হেরেমের গোপন কাহিনি প্রকাশ্যে

১৭

অভিষিক্ত তামিমের অর্ধশতকে টাইগারদের সহজ জয়

১৮

উল্কা গেমসের কর ফাঁকি / এনবিআরের অভিযান নিয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যাখ্যা 

১৯

আ.লীগ নেতারা নিজেদের ভেতরকার অস্থিরতা আড়াল করতে চাচ্ছে : প্রিন্স

২০
*/ ?>
X