সাইদুল ইসলাম
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৪৬ এএম
আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৩৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পণ্য বয়কট: বাজার ও বাস্তবতা

পণ্য বয়কট: বাজার ও বাস্তবতা

বাংলাদেশের কিছু কমিউনিটির যে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক, তার পেছনে অর্থনৈতিক কারণ নেই। এমন না যে, ভারত অমুক পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দিয়েছে তার জন্য বয়কট করলাম। এই বয়কটের মূল কারণটা হলো রাজনৈতিক ও ধর্মীয়। অনেকেই অবশ্য বলতে চান, বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আধিপত্যবাদের প্রতিবাদ হিসেবেও এ বর্জনের ডাক দিয়েছেন তারা। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতারাও কথা বলেছেন, যা আরও বেশি প্রভাব ফেলেছে জনমনে। এবারের ঈদ বাজারেও দেখা গেছে তার বড় প্রভাব। অনেকেই ইচ্ছা করেই ভারতীয় পোশাক কেনেননি এমন তথ্যও আছে।

এখন প্রশ্ন হলো যে, পণ্য আমরা বর্জন করার ঘোষণা দিচ্ছি তা কি বাংলাদেশে যথেষ্ট তৈরি হয়? তা কি অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হবে না? সেখানে কি দামের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে না? কিংবা অন্য দেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করে দেশে পণ্য তৈরি করলেন। কিন্তু প্রতিযোগিতায় যদি অন্য দেশের আরও ভালো পণ্য আরও কমদামে মেলে তাহলে মানুষ কি আপনার দেশিটা কিনবে? এত সচেতন মানুষ কি আমাদের দেশে আছে?

আমরা মুক্তবাজার অর্থনীতি মেনে নিয়েছি। সুতরাং প্রতিযোগিতায় টিকতে গেলে আমাকে পণ্যের মান ও দাম নিয়ে প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকতে হবে। শুধু ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান হয়তো প্রাথমিকভাবে কিছু ফল আর তৃপ্তি দেবে তবে টেকসই হবে না। কারণ অর্থনীতির গণিতটা একটু আলাদা। আর বাজার অর্থনীতির মূল কথাই হলো, ক্রেতা যেখান থেকে কম দামে জিনিস পাবে, সেখান থেকেই কিনবে। ফলে ভারতীয় পণ্য বর্জনের এ আন্দোলন খুব বেশিদিন স্থায়ী হবে বলে আমার মনে হয় না।

অনেকেই বলছেন, পণ্য বয়কটের আন্দোলন দেশীয় অর্থনীতি ও উৎপাদনকে শক্তিশালী করার একটি হাতিয়ার। যেমন উদাহরণ দিয়ে অনেকেই বলেন, ভারতীয় গরু আসা বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশে গরুর মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। সেই মানুষগুলোই কিন্তু দাম বেশি হওয়ার কারণে আবার গরুর মাংস বয়কটের ডাকও দিচ্ছে। আবার ভারতীয় গরু এলে দাম কমে যাবে সেই আশাও করে। এক মাস সীমান্ত খুলে দিয়ে ভারতীয় গরু আসার সুযোগ করে দিয়ে দেখেন না, গরুর মাংস যদি ৫০০ টাকা কেজি হয় সেখানে কয়জন ভারতের গরু বলে বর্জন করেন।

স্বদেশি আদর্শে উদ্বুদ্ধ আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিকভাবে ব্রিটিশ শক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান। আন্দোলনের রণকৌশলের অন্তর্গত ছিল ব্রিটিশ পণ্য বয়কট এবং দেশীয় শিল্প ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার উন্নতিসাধন। অর্থাৎ স্বদেশি আন্দোলন ছিল শুধু ব্রিটিশ শক্তিকে উচ্ছেদের জন্য নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতি সাধনের জন্য। তাই যদি হয় তাহলে বাংলাদেশের চলমান ভারতীয় পণ্য বয়কটের বিষয়টি কেন কারও কারও মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে, এমন যুক্তি আছে অনেকের। কিন্তু ব্রিটিশ আমলের বাজার অর্থনীতি আর আজকের বাজার অর্থনীতি এক জিনিস নয়। দেশ স্বাধীনতাকে টার্গেট করে বয়কট আর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে একটি ভারতবিরোধী ক্যাম্পেইন—এক জিনিস নয় যে। আর ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানির গতিপ্রকৃতিও আগের জায়গায় নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮ হাজার ৯১৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয় ভারত থেকে। সেই অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করে ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য। তবে বর্তমানে বাংলাদেশ যে পরিমাণে পণ্য ভারত থেকে আমদানি করে, তার একটি বড় অংশ রপ্তানি খাতে পণ্য তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আবার বাংলাদেশে আগে বেশি আমদানি হতো খাদ্যপণ্য ও পোশাক। কিন্তু বর্তমানে আমদানি করে উন্নয়ন উপকরণ ও রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল। বাণিজ্য ঘাটতিও দিনে দিনে কমে আসছে।

ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ১০০ কোটি ডলারে উন্নীত হতে সময় লেগেছে ৪৭ বছর। অথচ এরপর তা ২০০ কোটি ডলারে উন্নীত করতে সময় লেগেছে মাত্র পাঁচ বছর। কাজেই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাণিজ্য লেনদেন বাড়লে যে কোনো দেশের জন্যই তা সাশ্রয়ী হয়।

বাংলাদেশ ভারতের পঞ্চম বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও সে দেশের শীর্ষ ১০ আমদানি উৎস দেশের তালিকায় নেই বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশ যে ভারতকে রপ্তানি করবে সেই ধরনের পণ্য উৎপাদন এখনো বাড়াতে পারেনি। তাই বাংলাদেশকে ভারতের বাজারে আধিপত্য করতে হলে কমদামে গুণগত মানের পণ্য উৎপাদনের বিকল্প নেই।

আসলে বর্তমান বৈশ্বিক যে অর্থনৈতিক বাস্তবতা, তাতে কোনো দেশের পণ্য বর্জন করে রাজনৈতিকভাবে বাজার কিছুটা গরম করা সম্ভব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাজারই নির্ধারণ করে দেয় আপনি কিনবেন কি না। বর্তমানে ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে ডাক সেখানে দেশপ্রেম বা দেশীয় পণ্যের প্রসারের কোনো মোটিভ আছে বলে আমার কাছে মনে হয় না। কারণ যে মানুষ ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেয় সে আবার ব্রাজিল থেকে গরু আমদানির খবরে পুলকিত হয়। ব্রাজিল থেকে যদি গরু বা গরুর মাংস আমদানি শুরু হয়, দেশি খামারিরা কি টিকতে পারবে? এত বড় একটা সেক্টর যেখানে হাজার হাজার যুবকের কর্মসংস্থান, শত শত পরিবার চলে এর ওপর সেটি কি আগের জায়গায় থাকবে? মাংস উৎপাদনে নিজস্ব যে সক্ষমতা তা কি মুখ থুবড়ে পড়বে না?

ভারতের পণ্যই বলেন আর পাকিস্তানের পণ্যই বলেন, সেটি যদি আপনার প্রয়োজনের হয় আর আপনি নিজে যদি তা চাহিদামতো উৎপাদন করতে না পারেন তাহলে কোনো না কোনো দেশ থেকে তা আপনাকে আমদানি করতেই হবে। জোগান দিতে না পারলে বাজারটা অস্থির হবে। সেই সুযোগটা অন্য কেউ নেবে। ফলটা সাধারণ মানুষকেই ভোগ করতে হবে। তাই যে কোনো পণ্য বর্জনের ঘোষণাটা অনেক হিসাবনিকাশ করেই দেওয়া উচিত।

শেষ করব বয়কটের সাম্প্রতিক ঘটনা দিয়ে, রোজার মাসে তরমুজের পর গরুর মাংস বয়কটেও অনেকে ডাক দিয়েছিলেন। তাতে কী হলো? গরুর মাংসের দাম তো কমলোই না, উল্টো গরুর মাংস বয়কটের আওয়াজের সুযোগে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়ে গেল কেজিতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষ যারা ব্রয়লার মুরগি মাংস খায় তাদের পকেট থেকে ব্যবসায়ীরা নিয়ে গেলে কত কোটি টাকা? তাই বয়কট মানেই অর্জন নয়, বিসর্জনও হয়।

লেখক: সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এরদোয়ানের বিরাট সাফল্য, কুর্দিস্থানের যোদ্ধাদের নতুন অধ্যায়ের সূচনা

একে স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৯৪ শতাংশ পাস

জামায়াতের সঙ্গে জোট নয়, এনসিপির সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা উন্মুক্ত : সালাহউদ্দিন

কর্ণফুলী ইপিজেডে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৮ ইউনিট

সাতক্ষীরায় যাবেন এনসিপি নেতারা, তড়িঘড়ি করে সড়ক সংস্কার

দুই ওভারে দুই হ্যাটট্রিক! ক্রিকেটারের অবিশ্বাস্য কীর্তি

জেসিআই বাংলাদেশের উদ্যোগে ‘জেসিআই ব্লাড বন্ড’ স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি অনুষ্ঠিত

পাক অভিনেত্রীর ময়নাতদন্তের রিপোর্টে চাঞ্চল্যকর তথ্য

ক্লাস নেওয়ার সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক

খুলনায় সাবেক যুবদল নেতাকে গুলি করে হত্যা

১০

পরিত্যক্ত রেলপথ ব্যবহার করে অভিনব রাস্তা তৈরি (ভিডিও)

১১

ইসরায়েলকে বিমানঘাঁটি বানিয়ে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

১২

শেরপুর সীমান্তে শিশুসহ ১০ জনকে পুশইন

১৩

নিখোঁজের ৫ দিন পর পাটক্ষেতে মিলল শিশুর মরদেহ

১৪

কফি আসলেই ত্বকের উপকারে আসে, নাকি ক্ষতি করে?

১৫

জিপিএ-৫ পেল বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী তানিশা

১৬

গানের মঞ্চ থেকে রুপালি পর্দায় কারিনা

১৭

ছাত্রদলের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা

১৮

‘সবাই বিবাহিত হওয়ায় পরীক্ষায় ফেল করেছে’

১৯

রংপুর ক্যাডেট কলেজে শতভাগ জিপিএ ৫

২০
X