মহান মে দিবস আজ। প্রতি বছর মে মাসের পহেলা দিনটি পালিত হয়ে থাকে মে দিবস হিসেবে। এই দিবসটি হলো শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতির দিন। বিশ্বব্যাপী শ্রমিকের বিজয়ের দিন, আনন্দ ও উৎসবের দিন। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগান তুলে নতুন সংগ্রামের শপথ নেওয়ার দিন। মে দিবস হলো একটি সংগ্রামের নাম। তা প্রথমত এ কারণে যে, সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এ দিবসটির উদ্ভব ঘটেছে। দ্বিতীয় আরেকটি কারণ হলো মে দিবস আয়োজনের ব্যাপারটাও শুরু থেকে আজ অবধি একটি সংগ্রামের বিষয় হয়ে রয়েছে। সোয়াশ বছরের বেশি সময়ের ইতিহাসে মে দিবস উদযাপনের জন্য দেশে দেশে শ্রমিকশ্রেণিকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। সইতে হয়েছে নানা মাত্রার পুলিশি নির্যাতন, জেল-জুলুম, হুলিয়াসহ দমনপীড়ন। সঙ্গে সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়েছে, মে দিবসের মর্মবাণীকে নানা বিভ্রান্তি ছড়ানোর মাধ্যমে বিভ্রান্ত, দিকনির্দেশনাহীন ম্লান ও পানসে করে তোলার নানা অপপ্রয়াস। এখনো মে দিবস পালন করাকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী কমবেশি একই পরিস্থিতি বিদ্যমান। আমাদের দেশেও দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মে দিবস উদযাপনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে।
এ কথা আজ স্পষ্ট যে, লুটেরা বুর্জোয়াদের হাতে শাসনক্ষমতা থাকলে দেশ ক্রমাগতভাবে ধ্বংসের পথেই ধাবিত হতে থাকবে। তাই দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হলে চলতি বুর্জোয়া শাসনের অবসান ঘটিয়ে ‘নিরানব্বই শতাংশ’ মেহনতি মানুষের রাষ্ট্রক্ষমতা ও রাজনীতির সামনে এসে দাঁড়ানো আজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। ‘মে দিবস’ আবার নতুন করে দেশের মেহনতি মানুষের সামনে এ ঐতিহাসিক কর্তব্য হাজির করেছে।
পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকরা কাজ করে ‘জীবিত’ থাকার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহের জন্য। সে কাজ করে তার শ্রম প্রদানের ক্ষমতা পুনরুৎপাদনের উদ্দেশ্যে। শ্রমশক্তির অব্যাহত পুনরুৎপাদনের জন্য যা অপরিহার্য, তা হলো শ্রমিকের নিজের জন্য ও নিজের শ্রমশক্তির অব্যাহত প্রবাহ নিশ্চিতের জন্য বংশবৃদ্ধি করতে, গোটা পরিবারের জন্য, ভরণপোষণ, শিক্ষা-চিকিৎসা, মাথা গোঁজার ঠাঁই ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। সেইসঙ্গে শরীর ঠিক রাখার জন্য অপরিহার্য হলো ন্যূনতম ঘুম ও বিশ্রাম। এসবই হলো মানুষের ‘জীবিত’ থাকার আয়োজনের ব্যাপার। প্রশ্ন হলো, মানুষ কী উদ্দেশ্যে এসব আয়োজনে নিজেকে নিয়োজিত রাখবে? নিশ্চয়ই তা হলো, প্রকৃত ‘বেঁচে থাকা’ (to live) বলতে আসলে যা বোঝায় সেজন্য। পুঁজিবাদী সমাজে কাজ ও বিশ্রামের সময়টুকু হলো জীবিত থাকার আয়োজন মাত্র (to earn a living)। আসল ‘বাঁচার’ (to live) জন্য সময়টা হলো এর বাইরে।
‘আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম ও বাকি আট ঘণ্টা বিনোদন ও সংগ্রাম’—এটাই ছিল মে দিবসের মূল স্লোগান। শ্রমিকের সে সংগ্রাম হলো শোষণ থেকে মুক্তির জন্য, শোষণমুক্ত মানবিক সমাজের জন্য, মুক্ত মানুষের মুক্ত বিশ্ব প্রতিষ্ঠার জন্য, সমাজতান্ত্রিক-সাম্যবাদী সভ্যতা নির্মাণের জন্য সংগ্রাম। অনেক দেশে শ্রমিকদের কাজের সময়ের দাবিটি পরবর্তীকালে আরও অগ্রসর হয়েছে। ‘সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা অথবা ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ নয়’—এভাবে দাবি উঠেছে। সে দাবি আদায়ও হয়েছে। কত ঘণ্টা কাজ করতে হবে, এটি হলো নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মানবিক বিষয়। কিন্তু আরও অনেক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ কথাটি হলো, ‘কাজের সময় কমাতে হবে’। কারণ ‘কাজের সময়ের’ বাইরে যেটুকু সময় ‘বিনোদন ও সংগ্রামের’ জন্য রাখতে পারবে, শুধু সেটুকুই হবে শ্রমিকের ‘নিজের সময়’। কাজের সময় কমানো প্রয়োজন, যাতে করে শ্রমিক তার ‘নিজের জন্য সময়’ বাড়িয়ে নিয়ে প্রকৃত ‘বাঁচার জন্য’ সময় করে নিতে পারে। ইংরেজিতে বললে, ‘so that he can live, besides just earning a living’। ‘মে দিবসের’ আট ঘণ্টা কাজের কেন্দ্রিক-দাবিটির কালোত্তীর্ণ গুরুত্ব ও তাৎপর্যের একটি প্রধান উৎস এখানেই।
১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগো শহরের শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের মূল দাবি ছিল আট ঘণ্টা কাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা। ওই কর্মসূচির অংশ হিসেবে সেদিন তিন লাখ শ্রমিক এক ঐতিহাসিক ধর্মঘটে শামিল হয়েছিল। ২ মে ছিল রোববার। ৩ মে আরও বড় শ্রমিক সমাবেশে মালিকের গুন্ডারা আক্রমণ চালিয়ে ছয়জন শ্রমিককে হত্যা করেছিল। এর প্রতিবাদে ৪ মে শহরের ‘হে মার্কেট’ স্কয়ারের বিশাল সমাবেশে মালিক ও সরকারের সশস্ত্র বাহিনীর নির্বিচার লাঠিচার্জ ও গুলিতে শ্রমিকের রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল ‘হে মার্কেট’ চত্বর। নিহত হয়েছিল চারজন শ্রমিক। কয়েকজন পুলিশও প্রাণ হারিয়েছিল। ৮ জন শ্রমিকনেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।
আমেরিকার শ্রমিকদের এ আন্দোলনের সমর্থনে দেশে-দেশে শ্রমিকরা সংহতি আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ফলে মালিকরা ক্রমান্বয়ে বাধ্য হয়েছিল আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবি মেনে নিতে। ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকী উপলক্ষে ফ্রেডেরিক অ্যাঙ্গেলসের নেতৃত্বে প্যারিসে ‘দ্বিতীয় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ওই বছরই অনুষ্ঠিত ‘সোশ্যালিস্ট লেবার ইন্টারন্যাশনালের’ সম্মেলনে জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিনের ঘোষণা অনুযায়ী, ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর ১ মে দিনটিকে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এভাবেই আন্তর্জাতিকভাবে মে দিবস পালনের সূচনা হয়েছিল; অর্থাৎ মে দিবসের সামগ্রিক ইতিহাস শুরু থেকেই ছিল শ্রমিকশ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠা, মুক্তি অর্জন ও আন্তর্জাতিক সংহতির লক্ষ্যে ধারাবাহিক সংগ্রামের ইতিহাস। শ্রমিকশ্রেণির কাছে মে দিবস হলো সেই লক্ষ্যে নতুন সংগ্রামে উজ্জীবিত হওয়ার শপথের দিন। এটি কখনোই নিছক কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। মে দিবসকে আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বন্দি করার অর্থই হলো শ্রমিকশ্রেণিকে তার চূড়ান্ত অর্থনৈতিক-সামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত সংগ্রাম থেকে বিচ্যুত করার প্রচেষ্টা।
ব্রিটিশ আমলে মে দিবস পালন করাকে কার্যত দেশদ্রোহী কাজ বলে ব্রিটিশ শাসকরা বিবেচনা করত। পাকিস্তান আমলেও মে দিবস পালন করতে হতো অনেক সতর্কভাবে ও লুকিয়ে ছাপিয়ে। ১৯৬৯-৭০ সালের দিকে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল। প্রকাশ্যে মে দিবসের অনুষ্ঠান করা শুরু হয়েছিল। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রণাঙ্গনেই আমরা মে দিবসের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। স্বাধীনতার পর মে দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে বাধাগুলো বহুমাত্রায় অপসারিত হয়েছে।
মে দিবস এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে। দিবসটি এখন সরকারি ছুটির দিন। এটি এখন শ্রমিকদের উৎসবের দিনে পরিণত হয়েছে। শ্রমিকরা দলে দলে ঢাকঢোল বাজিয়ে, রং ছিটিয়ে এসব অনুষ্ঠানে যোগদান করে। পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরাও এখন মে দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। মে দিবসে ঢাকা শহর আজকাল অনেকটাই শ্রমিকের উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মে দিবস পালনে ‘মুক্তি’ অর্জন সম্ভব হলেও মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও চেতনা-ধারার মতোই, ‘মে দিবসের মুক্তিকেও’ তীব্র হোঁচট খেয়ে পড়তে হয়েছে। এ দেশের শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনগণকে আবার শোষণ-বঞ্চনা-অধিকারহীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নীতি থেকে বস্তুত বিতাড়িত হয়েছে মেহনতি মানুষের মুক্তির প্রশ্নটি। শোষণ-বঞ্চনা ও নিপীড়ন থেকে মুক্ত হয়ে প্রতিটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন হলেও আজ পর্যন্ত সেই স্বপ্নপূরণ হয়নি।
সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদনব্যবস্থা ও বণ্টন প্রণালিগুলোর মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন দেশের জনগণ।’ ১৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশগুলোকে সব ধরনের শোষণ হইতে মুক্ত করা।’
সংবিধানে এখনো এসব নির্দেশনা বহাল থাকলেও তথাকথিত মুক্তবাজার নীতির নামে ‘উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদনব্যবস্থা ও বণ্টনপ্রণালি’র মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ ‘দেশের জনগণের’ হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অসংখ্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তুলে দেওয়া হয়েছে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে। লুটপাট চালিয়ে তারা সেসব শিল্প ধ্বংস করে ফেলেছে। ‘কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশের’ ওপর এখনো চলছে নানামাত্রিক শোষণ-নিপীড়ন।
ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে শ্রমিকদের। নারী শ্রমিকদের ওপর চলছে অধিকতর বঞ্চনা ও বৈষম্য। শ্রমিকদের অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার খর্ব করে রাখা হয়েছে। ভবন ধসে, কারখানায় আগুন লেগে হাজার হাজার শ্রমিক মারা যাচ্ছে। কর্মস্থলে কাজের উপযুক্ত পরিবেশের ব্যবস্থা করা তো দূরের কথা, বেশিরভাগ কলকারখানায় শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তাটুকুরও ব্যবস্থা নেই।
সব সমাজ আজ ভয়াবহ অবক্ষয় ও পচনের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। প্রতি বছর লাখো-কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে, খেলাপি ঋণ ও কালো টাকার পরিমাণ বাড়ছে, সৎ বিনিয়োগকারী-ব্যবসায়ীদের তুলনায় অর্থনৈতিক অপরাধীদের বাড়তি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, মেগা প্রজেক্টের নামে চলছে মেগা লুটপাট, অবকাঠামো নির্মাণে লোহার রডের বদলে বাঁশ ব্যবহার করার মতো অপরাধ ঘটতে থাকলেও এসবের বিচার থেকে পার পেয়ে যাওয়ার ঘটনা ক্রমাগত ঘটছে।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন এক বিপ্লবী গণজাগরণ। ঊনসত্তরের মতো, একাত্তরের মতো। বুর্জোয়া শক্তি আজ চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ। সে ক্ষেত্রে অন্য শ্রেণিশক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে। মধ্যবিত্ত সমাজকে সঙ্গে রাখতে হবে ঠিকই, কিন্তু তাদের ওপর নির্ভর করে থাকলে হবে না। এবার হাল ধরতে হবে মেহনতি মানুষকে। ইতিহাসের এটিই স্পষ্ট নির্দেশনা। এ উপলব্ধি সবার মাঝে উদয় হোক; মেহনতি মানুষের মাঝে সেই বিপ্লবী দায়িত্ববোধ সঞ্চারিত হোক—এবারের ‘মে দিবসে’ সেটিই সব থেকে বেশি করে কাম্য।
লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি