কমরেড হায়দার আকবর খান রনো চলে গেলেন। এগারোই মের ভোররাত ২টা ৫ মিনিটে তার জীবনাবসান হয়েছে। তার মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম তাকে প্রখ্যাত মার্কসবাদী তাত্ত্বিক হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে মার্কসবাদী তত্ত্ব সম্পর্কে তার জ্ঞানভান্ডার সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন নেই। মার্কসবাদী দর্শন ও তত্ত্বের ওপর তার বিভিন্ন বই রয়েছে। তেমনি তার বই রয়েছে শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞানের ওপরও; কিন্তু তার মূল পরিচয় তিনি একজন রাজনীতিক, কমিউনিস্ট বিপ্লবী। স্কুলজীবন থেকে পারিবারিক আবহাওয়ায় তিনি কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হন। আর সেই আকর্ষণ থেকে ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি এদেশের তৎকালীন কমিউনিস্ট আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। তার ছাত্র আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, জাতীয় রাজনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি তার ব্যক্তিগত জীবনেও এই কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতিফলন দেখতে পাই। তার মৃত্যু পর্যন্ত এ আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। এ জন্য তার বন্ধু বিচ্ছেদ হয়েছে; কিন্তু যে নীতি আদর্শে তিনি বিশ্বাস করতেন তাতে তিনি সবসময় অটল থেকেছেন।
রনো ও আমি আবাল্য বন্ধু। সেই স্কুলজীবন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তো বটেই, রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রতিটি বাঁক ও মোড়ে এই সেদিন পর্যন্ত আমরা এক ছিলাম। দুই হাজার আটের নির্বাচনে নির্বাচনী কৌশল নিয়ে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়েছি; কিন্তু আমাদের যে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব তাতে কখনো ছেদ পড়েনি।
সেই স্কুলজীবনের কথা। ভাষা আন্দোলনের পরে তখন উত্তাল সময়। সেই কিশোর বয়সেই রনো আমাকে যশোর রেলস্টেশনে নিয়ে গিয়েছিল কমিউনিস্ট নেতা দেখানোর জন্য। রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে গুলিতে আহত তরুণ কমিউনিস্ট নেতা আব্দুল হক তখন যশোরের একটি আসনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়ছেন। তাকে বন্দি অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। তাকে দেখতে রনো আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া চুয়ান্নর ওই নির্বাচনে মওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা ফজলুল হকের জনসভা শুনতে রনোর সাথী হয়েছি আমি। সেই দুজনেই আমরা আবার সাথী হয়েছি বাষট্টির সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে, শিক্ষা আন্দোলনে। একসঙ্গে মিছিলে হেঁটেছি, একসঙ্গে জেল খেটেছি, এনএসএফের মার খেয়েছি। এভাবে আরও পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি। কেবল বন্ধুত্বের বন্ধনেই নয়, রাজনীতির বন্ধনে, আদর্শের বন্ধনে।
ব্যক্তিজীবনে রনো ছিলেন খুব আবেগপ্রবণ। তার আবেগঘন বক্তৃতা সে সময়ের ছাত্র-তরুণদের উদ্বেলিত করত। সংবাদপত্রের পাতায় তার বক্তৃতা অনেক জায়গা নিয়ে ছাপা হতো। রাজনীতির বক্তৃতার ক্ষেত্রে যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রতিযোগিতাতেও তিনি সামনের সারি দখল করে রেখেছিলেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তিতে তার জুড়ি মেলা ভার ছিল।
কিন্তু ওই রনোই আবার শ্রমিক আন্দোলন করতে গিয়ে দিনের পর দিন টঙ্গীর শ্রমিক বস্তিতে দিন-রাত কাটিয়েছেন। ওই শ্রমিকদের নিয়ে হেঁটে টঙ্গী থেকে ঢাকা এসেছেন। সেই শ্রমিক মিছিল নিয়ে পুরোনো গণভবনে বঙ্গবন্ধুর দরজায় উপস্থিত হলে বঙ্গবন্ধু তাকে নিজের পাশে বসতে বলেছিলেন, ‘তোর জন্য তো বসার জায়গা লাগে না, আমার চেয়ারেই বস’।
কেবল বঙ্গবন্ধু নন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনারও তার জন্য অগাধ ভালোবাসা ছিল। করোনাকালে করোনাক্রান্ত হয়ে রনো ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের কেবিনে ভর্তি হলে প্রধানমন্ত্রী নিজে ফোন করে তার অবস্থা জানতে চেয়েছেন। ফল পাঠিয়ে দিয়েছেন।
বস্তুত, হায়দার আকবর খান রনো ছিলেন অজাতশত্রু। তার নিরহংকারী চরিত্র, সদালাপ তাকে সবার প্রিয় করেছিল। এ কারণেই ভিন্ন মতাদর্শ ও রাজনীতির লোকজনও তাকে ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন।
বাংলাদেশের মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে রনোর অবদান ছিল অতুলনীয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এদেশের বাম কমিউনিস্টরা যখন বিভ্রান্ত, পিকিংপন্থার নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, তখন ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির নেতা হিসেবে রনো ওই বামদের মধ্যে যায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে তাদের সংগঠিত করে গড়ে তোলেন ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ ১৯৭০-এর ২ জুন ওই কমিটির তরফ থেকে যে ঘোষণাপত্র গ্রহণ করা হয়, তার রচয়িতা ছিলেন হায়দার আকবর খান রনো।
বাংলাদেশ পরে ওই ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি’র সঙ্গে আরও দুটি কমিউনিস্ট গ্রুপ একত্রিত হয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী) গঠন করা হয় তার প্রতিষ্ঠায়ও তার অগ্রণী ভূমিকা ছিল। এই লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টিই পরে ভাগ-বিভক্তি-ঐক্যের মধ্য দিয়ে আজকের বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিতে রূপ নিয়েছে। রনো এই পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, ছিলেন পলিটব্যুরোর সদস্য। যে কথা আগে বলেছি, ২০০৮-এর নির্বাচনী কৌশল নিয়ে মতবিরোধে পার্টি ছেড়ে পরে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে।
তার আজীবনের স্বপ্ন ছিল, এ দেশের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সংঘটিত করে বিপ্লব সাধন। সেই বিপ্লব তার জন্য অধরা রয়ে গেলেও ষাটের দশকের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু কর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। আবার বাংলাদেশ-পরবর্তী জিয়া-এরশাদ সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলন বিএনপি-জামায়াত মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সব ক্ষেত্রেই রনো ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। শেষ দিকে দুরন্ত সিওপিডি তাকে আসক্ত করে ফেললেও ওই সাম্যসমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে তিনি পিছু হটেননি। ভুল চিকিৎসার কারণে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েও তিনি কেবল মুখে বলে একের পর এক বই লিখেছেন। সারাক্ষণ খোঁজ রেখেছেন দেশের কোথায় কী হচ্ছে জানতে। আর এসব কিছুর পেছনেই কাজ করেছে তার বিপ্লব চিন্তা।
রনো নেই; কিন্তু তার বিপ্লব চিন্তা নতুন প্রজন্মের মধ্য দিয়ে নতুনভাবে বিকশিত হবে। তার মৃত্যু যে শূন্যতা সৃষ্টি করল, এভাবেই তার পূরণ হবে। আর এভাবেই কমরেড রনো চিরজাগরূক থাকবেন এ দেশের মানুষের মধ্যে।
লেখক: বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী