১৭ মে, ১৯৮১ সাল। ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটি ছিল সরকারি ছুটির দিন। সবার লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিমানবন্দর। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা জনতার ভিড় জমা শুরু হয় সকাল থেকেই। ভিড়ের বিবরণ পাওয়া যায় দৈনিক ইত্তেফাকের পাতা থেকে। পত্রিকাটিতে লেখা হয়—‘ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমানটি আসিয়া পৌঁছে বিকাল সাড়ে ৪টায়। কিন্তু বিমানবন্দরে দেশের বিভিন্ন স্থান হইতে আগত জনতার ভিড় জমিতে থাকে বেলা ১২টা হইতেই। বিমানবন্দরের রানওয়ে, টারমার্ক ও বিমানবন্দর প্রাঙ্গণ হইতে শেওড়াবাড়ী পর্যন্ত এলাকা জুড়িয়া দুপুর হইতে অপেক্ষমাণ দলীয় সমর্থকরা তাহাকে অভ্যর্থনা জানান। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে সভানেত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে বিমান হইতে ট্রাকে নামাইয়া নেন। পুলিশের ধাওয়া সত্ত্বেও স্লোগানমুখর জনতা বারবার বিমান ও ট্রাককে ঘিরিয়া অধীর হইয়া উঠে।’ (দৈনিক ইত্তেফাক ১৮ মে, ১৯৮১)।
প্রায় ছয় বছর পর দেশে ফিরেছিলেন এক বেদনাবিধুর ভগ্ন হৃদয় নিয়ে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বিমানবন্দর থেকেই চলে যান বনানী কবরস্থানে। মায়ের ও নিহত পরিজনের কবরস্থানে গিয়ে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়েন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের
শোকের ছায়ায় নিজের বাবা-মা ভাইদের ও পরিজনদের হারানোর শোক উথলে উঠল পুনর্বার। জিয়ারত শেষে মায়ের কবরের পাশে
গিয়ে স্বগতোক্তি করেন, ‘মা, আমাকে কেন রাখিয়া গেলে?’ তিনি যেদিকে তাকান, সেটি যেন শোকে মুহ্যমান। পরিবেশ বড়ই অচেনা, অজানা। কিন্তু তিনি সাহস পেলেন। কিন্তু পাশে পেলেন এ দেশের লাখ লাখ জনতাকে।
তাই তো সেদিনের সংবর্ধনা সভার শুরুতেই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বললেন, ‘আসুন, আবার আমরা এক হই।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করতে তিনি জনতার উদ্দেশে কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে আরও বললেন, ‘আপনাদের কাছে আমি বিচার চাই।’ বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবেও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার এ দাবি ছিল অত্যন্ত ন্যায়সংগত, গ্রহণযোগ্য এবং প্রাসঙ্গিক। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনে তদানীন্তন ক্ষমতাসীনরা বিচারকে কুক্ষিগত করেছিল আইনের বেড়াজাল দিয়ে (ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে)। পুরস্কৃত করা হয়েছিল কুখ্যাত খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরির মাধ্যমে।
দুই. ১৯৮১ সালের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর পাঁচ দশকের রাজনীতিতে তিনি যেমন বিরোধী দলে ছিলেন, আবার বারবার নির্বাচিত হয়ে সরকারপ্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছেন এবং এখনো আছেন। তার রাজনীতির নেতৃত্ব, বিচক্ষণতা এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ব অভিমুখে। বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রনায়করা তাকে অনুসরণ করেন। উদাহরণস্বরূপ যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকসহ অনেকের কথাই বলা যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়কোচিত ভাব, স্বাধীন সত্তা বিশ্ব দরবারে এখন বাংলাদেশকে অহংকারে পরিণত করছে। মাত্র বছরখানেক আগে যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ৫০ বছরের পূর্তি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পরম সমাদর করা হয়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশই বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন সহযোগী। কিন্তু এমন সাড়ম্বর অনুষ্ঠান বিশ্বব্যাংক অন্য কোনো দেশের জন্য সাধারণত করে না। এ সম্মান যেমন বাংলাদেশের, ঠিক তেমনই সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
বিশ্বব্যাপী চরম দুর্যোগ, মহামারি এবং অর্থনৈতিক মন্দা বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও তার নেতৃত্বে এমডিজিতে সাফল্যের পর ২০১৬ সাল থেকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে চলেছে দেশ। সাফল্যের এ মুকুটে ফোর্বস সাময়িকীর দৃষ্টিতে তিনি এখন বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফরেন পলিসি সাময়িকীর করা বিশ্বব্যাপী শততম বৈশ্বিক চিন্তাবিদদের তালিকাতেও রয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রাজনীতি বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় নেতৃত্বের অবদান থাকবে সমাজ জীবনের প্রতিটি স্তরে। রাষ্ট্রে, সমাজে, পরিবারে, কলকারখানায়, অফিস-আদালতে, খেলার মাঠে অর্থাৎ সর্বস্তরে। আমরাও তাই দেখছি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণে বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, প্রতিবন্ধী এবং মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ প্রান্তিক মানুষের জন্য বিভিন্ন ভাতা চালু হয়েছে। এসব ভাতাভোগীর সংখ্যা এবং টাকার পরিমাণ উভয়ই বৃদ্ধি করা হয়েছে। সমাজের সব অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ যেমন হিজড়া, বেদে, হরিজন, সুইপার, চা শ্রমিক—এদের জন্য বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষাভাতা ও অন্যান্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় এখন প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ উপকৃত হচ্ছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, যোগ্য নেতৃত্বের প্রভাবে একটি সমাজ সফলতার শিখরে আরোহণ করতে পারে।
আমরা এরই মধ্যে নতুন এক বিশ্ব ব্যবস্থার মধ্যে অতিক্রম করছি, যেখানে ‘স্টাডি ফ্রম হোম’-এর চেয়েও ‘ওয়ার্ক ফ্রম এনিহোয়্যার’ প্রয়োজন। এ ব্যবস্থা আমাদের নতুন প্রজন্মকে ভাবাচ্ছে। এ ভাবনার মধ্যে সবটাই রয়েছে। যেমন বাণিজ্য, অর্থ, পরিষেবা, যোগাযোগ, প্রযুক্তি এবং গতিশীলতা অর্থাৎ সবকিছুই। অভিজ্ঞ দূরদৃষ্টি নেতা হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তি দিয়ে বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। এজন্য তিনি ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত-স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। এজন্য পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১ প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন শুরু করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ প্রণয়ন করেছেন। ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করে নিজ প্রচেষ্টায় নিজের প্রতিভা দিয়ে কঠোর পরিশ্রমের ভিত্তিতে বিজ্ঞান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং তথ্যপ্রযুক্তিসহ সব ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি চিহ্ন রেখে যাচ্ছেন। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের বিষয়।
নেতৃত্বের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক দল সফলতা অর্জন করতে পারে। আবার নেতৃত্বের জন্য দরকার জনসমর্থনের। এ দুটিই এখন আওয়ামী লীগ প্রধানের আছে। রাষ্ট্রনায়কত্বের সঙ্গে নেতৃত্বের গভীর সম্পর্ক আছে বলেই বিশ্ববাসীর কাছে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের পরিকল্পনার কথা বলতে পারেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের দূরদৃষ্টির কারণেই বাংলাদেশ এখন অনন্য। বাংলাদেশ এখন অনেক দেশের কাছে মডেল হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে, তা অনুপ্রেরণাদায়ক।
আজকের বাংলাদেশের এ সফলতার পেছনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সাহসী সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই অর্জিত হয়েছে। দুঃসময়ে রাজনীতির হাল ধরেছিলেন বলেই তিনি আজ বিশ্বনেতৃত্বের কাতারে। শেখ হাসিনা এখন শুধু জাতীয় নেতাই নন, তিনি আজ তৃতীয় বিশ্বের একজন বিচক্ষণ বিশ্বনেতা। এ যুগের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়কদের একজন। তার তুলনা তিনি নিজেই। কবির ভাষায় বলতে ইচ্ছে হয়—
পরেছ কিরীট কনক কিরণে,
মধুর মহিমা হরিতে হিরণে,
কুসুম-ভূষণ জড়িত-চরণে
দাঁড়ায়েছে মোর জননী।
আলোকে শিশিরে কুসুমে ধান্যে
হাসিছে নিখিল অবনী।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়