মমতাজ বেগম শিক্ষক ও মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগ্রামী নারী। তিনিই একমাত্র নারী ভাষা-সংগ্রামী; যিনি ভাষার জন্য দীর্ঘ সময় কারাভোগ করেন। মমতাজ বেগম ১৯২৩ সালের ২০ মে কলকাতার হাওড়ার শিবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম কল্যাণী রায় চৌধুরী। ১৯৪৪ সালে কলকাতার সিভিল সাপ্লাই অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আবদুল মান্নাফের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি মমতাজ বেগম নাম গ্রহণ করেন। তার বাবা রায় বাহাদুর মহিমচন্দ্র রায় ছিলেন জেলা জজ এবং পরে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি। মা মাখনমতি দেবী ছিলেন স্কুলশিক্ষক। তার পূর্বপুরুষ রাজশাহীর রঘুনন্দপুরের জমিদার এবং নাটোরের রানি ছিলেন তাদের আত্মীয়। মমতাজ বেগম বিশিষ্ট সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশীর বোনের মেয়ে।
তার বাবা উচ্চশিক্ষিত হলেও ছিলেন অতিশয় রক্ষণশীল। মেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে তার তেমন আগ্রহ ছিল না। সম্পূর্ণ নিজ প্রচেষ্টায় মমতাজ বেগম ম্যাট্রিক পাস করলেও পরিবারের পক্ষ থেকে তার লেখাপড়া বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু নিজের প্রতিজ্ঞা ছিল উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার। কঠিন পর্দাপ্রথার ঘেরাটোপে থেকে ১৯৪২ সালে তিনি কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিএড পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ‘এডুকেশন ওয়ার্কশপ ফর টিচার্স’ কোর্স সম্পন্ন এবং ১৯৬৩ সালে এমএড ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪২ সালে তিনি কলকাতার ‘দ্য স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’য় যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। দেশ ভাগের পর তিনি ময়মনসিংহ চলে আসেন এবং শহরের বিদ্যাময়ী স্কুলে সহকারী শিক্ষিকা পদে যোগ দেন। ১৯৫১ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জের মর্গ্যান হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলিতে ছাত্র শহীদ হওয়ার সংবাদে নারায়ণগঞ্জের রহমতুল্লাহ মুসলিম ইনস্টিটিউট মাঠে একটি বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওইদিন মমতাজ বেগমের নেতৃত্বে মর্গ্যান স্কুলের ছাত্রীসহ মহিলাদের প্রথম মিছিল ওই জনসভায় উপস্থিত হয়। এ ছাড়া ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করতে তিনি তৎকালীন রাজনীতিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক ও মতবিনিময় করেন। তিনি আদমজী জুট মিল শ্রমিকদের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা বৈঠক করেন এবং তাদের আন্দোলনের তাৎপর্য বোঝাতে সক্ষম হন। দূরদর্শী ও দক্ষ সাংগঠনিক কর্মতৎপরতায় হয়ে ওঠেন আন্দোলনের প্রধান প্রাণশক্তি। তাকে গ্রেপ্তার করতে পারলেই আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাবে—এ লক্ষ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মর্গ্যান স্কুলের তহবিল তছরুপের মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করা হয় এবং বায়ান্নর ২৯ ফেব্রুয়ারি তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জে সংঘটিত বিক্ষোভ-মিছিল সংবাদ ১৯৫২ সালের ৩ মার্চ ভারতের দ্য স্টেটমেন্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
মমতাজ বেগম ১৯৫৩ সালের মে মাসে কারামুক্ত হন। সে বছর ‘ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি স্কুল পরিদর্শক’ হিসেবে যোগদান করেন। জীবনের অবশিষ্ট সময় শিশুদের সেবা ও শিক্ষা বিস্তারের মধ্য দিয়ে তিনি কাটাতে চেয়েছেন। এ লক্ষ্যে ‘শিশু নিকেতন’ নামে একটি কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠা করেন এবং মৃত্যুর আগপর্যন্ত শিক্ষকতা পেশাতেই নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৭ সালের ৩০ জুন এ সংগ্রামী নারী মারা যান।