সময়ক্ষেপণের কারণে চার বছরের বেশি সময় ধরে নির্বাসিত ফুটবল দফায় দফায় ব্যয় বৃদ্ধিতে সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ গচ্চা যাচ্ছে ফ্লাডলাইট, গ্যালারির চেয়ার, মাঠ, অ্যাথলেটিকস ট্র্যাক, পানির ব্যবস্থায় সমস্যা থাকছেই ।
সময়ক্ষেপণ হয়েছে অদূরদর্শিতার কারণে। এতে বেড়েছে প্রকল্প ব্যয়, যা ৯৯ কোটি থেকে প্রায় ১৫৯ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। তাতেও প্রত্যাশিত সংস্কার হচ্ছে না বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের। কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ক্রীড়াঙ্গনের বহুল আলোচিত এই প্রকল্পের কাজ। বিতর্ক এড়াতে নানা সমস্যা জিইয়ে রেখেই গোঁজামিলে প্রকল্প সমাপ্তির চেষ্টা চলছে!
ভেন্যু সংস্কারের নামে ২০১৭ অর্থবছরে উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। শুরু থেকেই এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কমতি নেই। তবুও প্রকল্পটির চূড়ান্ত সরকারি অনুমোদন দেওয়া হয় ২০১৯ সালে। ২০১৮ সালের দর অনুযায়ী প্রকল্পের মোট ব্যয় ধার্য ছিল ৯৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এর মাঝে ৯৬.৫৫ কোটি ছিল প্রকল্প ব্যয় ও বাকি ৩ কোটি টাকায় আনুষঙ্গিক খরচ মেটানোর কথা। ২৪ মাস সময় বেঁধে কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০২০ সালের ১ জুন। ২০২২ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার শর্ত থাকলেও চার অর্থবছরে বাজেটের মাত্র ৬২ কোটি টাকার তহবিল পেয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান। এরই মাঝে ২০২৩ সালের জুনে প্রকল্পের পুনর্মূল্যায়নের পর নতুন বাজেট দাঁড়িয়েছে ১৫৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। নতুন বাজেটে প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে ৬০ কোটি ৯ লাখ টাকা। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) একটি সূত্র কালবেলাকে নিশ্চিত করেছে, নতুন করে মূল্যায়নের পর বাস্তবে প্রকল্পের বাজেট দাঁড়িয়েছে ৬৯ কোটি টাকা।
প্রাথমিক বাজেটে ফ্লাডলাইটে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩ কোটি টাকা। কিন্তু বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) চাহিদা অনুযায়ী অত্যাধুনিক ফ্লাডলাইট স্থাপনে তা তিন গুনেরও বেশি বাড়িয়ে করা হয় ৪০ কোটি টাকা। বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, বাজেট বাড়ানো হলেও পুরোনো টাওয়ারের ওপরই বসানো হচ্ছে নতুন লাইট। কালবেলার অনুসন্ধানে মিলেছে এই শুভংকরের ফাঁকি। ফলে সংস্কার শেষে ফ্লাডলাইটগুলো থেকে যাচ্ছে সেই ৩০-৩৫ বছরের পুরোনো অবস্থাতেই। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এ লাইটে বেশি বিদ্যুৎ খরচ হবে। কিছুদিন ব্যবহারের পর কমে আসবে আলোর পরিমাণও। প্রকল্পের এক ফ্লাডলাইট খাত থেকেই বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে।
এভাবে প্রায় প্রতিটি খাত থেকেই অর্থ লোপাটের মহোৎসব চলছে। প্রকৃত সমস্যার সমাধানে মনোযোগ নেই। ফ্লাডলাইটের মতো সমস্যা জিইয়ে রাখা হয়েছে স্টেডিয়ামের মূল মাঠে। বেজমেন্টে বালুর পরিমাণ বেশি থাকায় মাঠের ঘাসের মান ঠিক রাখতে দিতে হচ্ছে প্রচুর পানি। পানি দেওয়ার জন্য স্প্রিঙ্কলার বসানো হয়েছে। সেটি দিয়ে পানি পৌঁছায় না মাঝ মাঠ পর্যন্ত। গত মাসের শেষদিকে এবং চলতি মাসের শুরুর দিকের প্রচণ্ড খরতাপে মাঠের বিভিন্ন অংশের ঘাসের দেখা মিলেছে সরেজমিন মাঠ পরিদর্শনে। এত বড় প্রকল্পে নেই নিজস্ব পানির পাম্প, একমাত্র ভরসা ওয়াসার সংযোগ। সেখানে জটিলতার কারণে সংকটের আশঙ্কাও থাকছে। গ্যালারিতে যে মানের চেয়ার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা নিয়েও রয়েছে বড় প্রশ্ন। নতুন স্থাপন করা অ্যাথলেটিকস ট্র্যাকের দক্ষিণ দিকে পানি জমে থাকে। যা স্বল্পসময়ে ট্র্যাকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে।
প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, এত বড় একটি প্রকল্পের বিভিন্ন কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কয়েকটি নিম্নমানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। ফলে কাজ নিম্নমানের হচ্ছে বলেই মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি, প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধান অন্তরায় খোদ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)! সংস্থাটির দায়িত্বশীলরা পরামর্শকদের নির্দেশনা না মেনে নিজেদের লোকদের দিয়ে যা ইচ্ছা তাই করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
যদিও এনএসসি পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক মো. শামসুল আলম এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘পরিকল্পনা অনুযায়ীই কাজ করা হচ্ছে। ভেন্যুর শেড নির্মাণ অর্ধেক হয়েছে। ফ্লাডলাইটের কাজও চলছে। এ ছাড়া প্রেসবক্স ও কিছু কাজ বাকি আছে। অক্টোবরের মধ্যে এসব কাজ সম্পন্ন করে মাঠ পরিচর্যার কাজে হাত দেওয়া হবে। আমরা ডিসেম্বরের মধ্যেই কাজ সম্পন্ন করব।’ যদিও সোমবার পর্যন্ত স্টেডিয়াম পরিদর্শন করে দেখা গেছে, গ্যালারির ওপর শেড নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে ৫০ ভাগ। প্রেসবক্সে ঘষামাজা চলছে। উত্তর-পূর্ব গ্যালারিতে জায়ান্ট স্ক্রিন মেরামত কাজ চলছে। জেনারেটর স্থাপনের সঙ্গে চলছে পাওয়ার স্টেশন মেরামত কাজ।