গাইবান্ধা সরকারি কলেজের পাশে প্রফেসর কলোনি সুন্দরজাহান মোড়ের বাড়িতে শুয়ে বসে দিন কাটছে ১৬ বছরের কিশোর রাহিয়ান ইসলাম সিয়ামের। গাইবান্ধা সরকারি কারিগরি শিক্ষা স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র সে। প্রচণ্ড মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, প্রতি রাতে জ্বর আসায় স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে তার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের ছররা গুলিতে আহত রাহিয়ানের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় থাকা মা-বাবাও অসুস্থতায় দিন পার করছেন।
রাহিয়ান বলে, লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হতে চাই। তাই এ অসুস্থ শরীর নিয়েও একদিন স্কুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রচণ্ড মাথাব্যথার যন্ত্রণায় ক্লাস না করেই বাসায় চলে আসতে বাধ্য হই। বাসায়ও লেখাপড়া করতে পারছি না।
জানা গেছে, বড় ভাই আহসান হাবীব আরিফের সঙ্গে ৪ আগস্ট দুপুরে ছাত্র আন্দোলনে যায় রাহিয়ান। গাইবান্ধা সদরে ডিসি অফিসের কাছে যেতেই পুলিশের ছররা গুলি তার বুকের বাঁ পাশে, মুখের ডান পাশে, মাথায় এবং ডান ও বাঁ হাতে লাগে। চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রাহিয়ান। সঙ্গে সঙ্গে বড় ভাই কোলে তুলে জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে আহতের ভিড় ছিল। চিকিৎসকরা প্রাথমিকভাবে রক্ত বন্ধের জন্য আহতদের ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছিলেন।
সেদিন রাহিয়ানের ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করে চিকিৎসক বলেছিলেন, ওকে সার্জারি কনসালট্যান্ট দেখাতে হবে। এখানে চিকিৎসা হবে না, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু বড় ভাই হাসপাতাল থেকে রাহিয়ানকে বাড়িতে নিয়ে যায়। মামলার ভয়ে রাহিয়ানকে হাসপাতালে চিকিৎসা করতে নেওয়া হয়নি। কিন্তু প্রচণ্ড যন্ত্রণায় টিকতে না পেরে দুদিন পর রাহিয়ানকে এসকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন সার্জারি চিকিৎসকও একই কথা বলেন। এখানে গুলি বের করা যাবে না। রক্তক্ষরণ হবে। দুদিন পর কয়েকজন ছাত্রসহকারে আবার গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় রাহিয়ানকে। হাসপাতালের পরিচালক ডা. আর এমের নির্দেশে অপারেশন করা হলে বুক, দুই হাত ও ঠোঁটের ওপরের অংশ থেকে পাঁচটি গুলি বের করা হয়। তার মাথা, মুখ, বুক ও পেটে এখনো সাতটি গুলি রয়েছে। মাথা থেকে গুলি বের করার চেষ্টা করলে রক্তক্ষরণ হয়। শেষে রংপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক।
পরিবারের সদস্যরা জানান, ১১ আগস্ট ছাত্ররা রাহিয়ানকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলেও কোনো চিকিৎসা হয়নি সেখানে। প্যারাসিটামল, গ্যাসের ট্যাবলেট আর ক্ষতস্থানে লাগানোর জন্য একটি মলম লিখে দেন চিকিৎসক। তিন দিন এভাবেই হাসপাতালে কাটে। এরপর চিকিৎসক মাস খানেক পর আসতে বলেন। তিনি বলেন, তখন আপনা-আপনি ক্ষতস্থান পেকে গুলি বের হবে।
এদিকে ছেলের শারীরিক অবস্থা দেখে শঙ্কিত রাহিয়ানের বাবা গাইবান্ধা পৌর গোরস্তানের সরকারি খাদেম তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাহিয়ানের শরীরে ১২টি গুলি লাগে। পাঁচটি গুলি বের করলেও ক্ষতস্থানে আর ড্রেসিং করা হয়নি। ক্ষতস্থানে চাপ দিলে পুঁজ বের হয়। দেড় মাসে গুলিবিদ্ধ স্থানগুলোর যন্ত্রণাও বেড়েছে। সঠিক চিকিৎসা না পেলে ছেলের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। ওর সুচিকিৎসা দরকার। এই জেলা শহরে তা সম্ভব নয়।
মা রাহিনুর বেগমের কান্না যেন থামছেই না। তিনি বলেন, দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে সবার ছোট হওয়ায় রাহিয়ান অনেক আদরের। গুলির যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পারে না। মা হয়ে কীভাবে ছেলের কষ্ট সহ্য করব। ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা করাব, এমন সামর্থ্যও আমাদের নেই। ওর বাবা যা রোজগার করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় খরচ করি।