গ্রামীণ সুবিধাবঞ্চিত নারীদের বিশেষ ছয়টি নির্দিষ্ট বিষয়ে সেবা প্রদানের লক্ষ্য নিয়ে শুরু হওয়া ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পটি বন্ধ হতে চলেছে চলতি বছরের জুন মাসে। সেজন্য সারা দেশে প্রতিটি উপজেলায় তথ্য আপাদের ব্যবহৃত কার্যালয় গুটিয়ে নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয় থেকে। প্রকল্প শেষে চাকরি স্থায়ীকরণের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব বিভাগে স্থানান্তরের প্রতিশ্রুতির বিষয় উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাবে উল্লেখ করে এসব নারীকে নিয়োগ দেওয়া হলেও এখন তা বরখেলাপ করায় ভবিষ্যৎ অন্ধকার তথ্য আপাদের। একই প্রকল্পের অফিস সহায়ক পদে কিছু পুরুষসহ প্রায় আড়াই হাজার জনবলের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার পথে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তথ্য আপা প্রকল্পের অধীনে সারা দেশে ৪৯২ জন উপজেলা তথ্যসেবা কর্মকর্তা, ৯৮৪ জন সহকারী উপজেলা তথ্যসেবা কর্মকর্তা পদে নারীরা কাজ করছেন। ৪৯৭ জন অফিস সহায়ক পদে নারী ও পুরুষ উভয়েই কর্মরত রয়েছেন। চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাওয়ায় ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত প্রতিটি পরিবার। নতুন করে কোনো চাকরি বা কর্মসংস্থানের চিন্তায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে অনেকে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে পাইলট প্রকল্প হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ের সফলতায় পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালে সারা বাংলাদেশের ৪৯২টি উপজেলায় প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। ৪৯২টি উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত তথ্যসেবা কেন্দ্র থেকে গ্রামীণ সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য তিনটি মাধ্যমে ছয়টি বিষয়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইন, কৃষি, লিঙ্গসমতা এবং ব্যবসা সংক্রান্ত তথ্য ও পরামর্শ সেবা প্রদানের লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু করে। সেবাগুলো তথ্যকেন্দ্র ও বাড়িতে গিয়ে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে চালু করা হয়।
পাশাপাশি, তথ্যকেন্দ্রগুলো থেকে বিনামূল্যে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা, ওজন পরিমাপ, রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ পরিমাপ, শরীরের তাপমাত্রা ও উচ্চতা পরিমাপসহ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন চাকরির, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও বৃত্তি, প্রতিবন্ধীদের ভাতার ও বিভিন্ন চাকরির-প্রশিক্ষণের তথ্য ও আবেদন, উদ্যোক্তাদের ই-লার্নিং প্রশিক্ষণ প্রদান, পরীক্ষাসহ অনলাইনে প্রাপ্ত বিভিন্ন বিষয়ের ফল অবহিতকরণ এবং ক্যারিয়ারবিষয়ক পরামর্শসহ তথ্য ও পরামর্শ সেবা দেওয়া হয় এসব কেন্দ্র থেকে। এমনকি উঠান বৈঠকের মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধান ও সচেতনতা তৈরি, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল, স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ, আইনগত সহায়তা প্রদানের কাজও করেন এসব তথ্য আপারা। এই প্রকল্প বন্ধের মাধ্যমে দুই হাজার মানুষ চাকরি হারানোর সঙ্গে গ্রামীণ নারীরাও বঞ্চিত হবেন বিভিন্ন সেবা থেকে।
তথ্য আপা পদে কর্মরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত কমগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ দেওয়ার যে নীতি বর্তমান সরকার গ্রহণ করেছে, তারই আওতায় বাদ দেওয়া হচ্ছে তথ্য আপা প্রকল্পের বৃদ্ধির পরিকল্পনা। তথ্য আপা প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়) এর উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে পাঁচ বছর শেষে প্রকল্পে কর্মরত জনবলকে রাজস্বতে স্থানান্তরের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় অথবা জাতীয় মহিলা সংস্থা উদ্যোগ গ্রহণ করবে—উল্লেখ থাকায় কর্মরত নারীরা অন্য কোনো চাকরি বা কর্মসংস্থানের চেষ্টা না করায় বেকার হতে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে চাকরিরতদের প্রতিশ্রুত বেতন দশম গ্রেডের কর্মকর্তার জন্য ২৭ হাজার ১০০ টাকার স্থলে ২৪ হাজার ৭০০ টাকা, তথ্যসেবা সহকারীদের বেতন ১৭ হাজার ৪৫ টাকার স্থলে ১৫ হাজার ৬৫০ টাকা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বেতনবৈষম্য ও উন্নয়ন প্রকল্পে প্রস্তাবে চাকরি রাজস্বে স্থানান্তরের প্রতিশ্রুতির বিষয়ে ২০২৩ সালে উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন করা হয়। এর কারণ জানতে চেয়ে সরকারকে চার সপ্তাহের সময় বেঁধে দেন আদালত। সময় পেরিয়ে গেলেও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে ঝালকাঠি সদর উপজেলা তথ্যসেবা কর্মকর্তা সঙ্গীতা সরকার কালবেলাকে বলেন, সরকারি চাকরির বয়স থাকা সত্ত্বেও কয়েকধাপের পরীক্ষা শেষে আমরা এই পদে কাজ শুরু করেছি। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে রাজস্বে স্থানান্তর করা হবে—এই প্রতিশ্রুতিতে আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ সময় ব্যয় করেছি। কিন্তু এখন যদি প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়, দুই হাজার মানুষ বেকার হয়ে যাবে, অনিশ্চিত হয়ে যাবে ভবিষ্যৎ। একমাত্র উপার্জনক্ষম নারীদের পরিবার অকূলপাথারে পড়ে যাবে। নারী উন্নয়নে কাজ করা প্রধান উপদেষ্টাসহ সবার কাছে দাবি জানাই আমাদের বিপদে না ফেলতে।
জানা গেছে, গত ২ জানুয়ারি জাতীয় মহিলা সংস্থা থেকে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে চলতি বছরের জুন মাসে। এ লক্ষ্যে আগামী জুন মাসে তথ্য আপার কার্যালয় ছেড়ে দেওয়ার জন্য অবহিত করা হয় এবং ভাড়ার চুক্তিপত্র জুন মাস পর্যন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর তথ্য আপার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গত ১৮ ও ১৯ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ও সচিবালয়ের সামনে মানববন্ধন করেন। মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব নাজমা মোবারক ও প্রকল্প পরিচালক শাহনাজ বেগম নীনা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দ্রুত গ্রহণের বিষয়ে আশ্বস্ত করেন।
এর আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত প্রথম একনেক সভায় তথ্য আপা প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ জুন থেকে ২০২৫ জুন পর্যন্ত এক বছর বৃদ্ধি করা হয়। সভা শেষে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বিবৃতিতে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তথ্য আপা প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে নতুন কর্মপরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের কীভাবে আরও দক্ষ করা যায় বা সরকারের কোনো কাজে লাগানো যায় কি না, এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি এখনো। কিন্তু তথ্য আপা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শাহনাজ নীনা গত বছরের জুলাই নতুন কর্মপরিকল্পনা প্রদান থেকে বিরত রয়েছেন। এমনকি মাঠপর্যায়ের কর্মরতদের বেতন পর্যন্ত বন্ধ করে রেখেছেন। বেতন ছাড়াই এই সেবার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। কয়েক মাসের বেতন বকেয়া থাকায় পরিবারের একক উপার্জনক্ষম নারী, বিধবা, বিবাহবিচ্ছেদের শিকার কর্মকর্তারা অবর্ণনীয় অবস্থায় দিনানিপাত করেছেন। প্রকল্প প্রধান অফিস থেকে স্কাইপি ভিডিও মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সকাল ৯-৫টা সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর অফিস উপস্থিতি, মাঠ ও তথ্যকেন্দ্রের কার্যক্রম নিশ্চিত করা হচ্ছে।
প্রকল্প পরিচালক শাহনাজ নীনা কালবেলাকে বলেন, কার্যালয় ছেড়ে দেওয়ার একটা বার্তা দেওয়া হয়েছে। মেয়াদ দুই দফায় বৃদ্ধি করা হয়েছে, তৃতীয় দফায় বৃদ্ধি হবে কি না, সে বিষয়ে সন্দিহান। সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলমান রয়েছে। সম্প্রতি কর্মরত নারীরা আন্দোলন করায় সরকারের উচ্চমহল নাখোশ। রাজস্বতে স্থানান্তর সরকারের বিষয়। এ রকম অনেক প্রকল্পের কর্মরতরা অতীতেও আবেদন করেছে; কিন্তু সরকার তা আমলে নেই নাই। বেতন স্থান ভেদে ভিন্ন হবে—এটাই স্বাভাবিক।