সন্ধ্যা হলেই আতঙ্ক বাড়তে থাকে খুলনায়। প্রায় প্রতি রাতেই নগরীর কোথাও না কোথাও সন্ত্রাসী হামলার খবর পাওয়া যায়। গুলি করে অথবা কুপিয়ে ফেলে যাওয়া হচ্ছে ছাত্র, রাজনীতিবিদ বা ব্যবসায়ীকে। গত ৪ মাসে খুলনা নগরী ও জেলায় অর্ধশত ছোটবড় সন্ত্রাসী হামলায় খুন হয়েছেন ১১ জন। সর্বশেষ শুক্রবার রাতে অর্ণব কুমার সরকার (২৬) নামে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) এক শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। গতকাল শনিবার পর্যন্ত এ হত্যার কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশ তিনটি সম্ভাব্য কারণ নিয়ে তদন্ত চালালেও পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো কারও বিরুদ্ধে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়নি।
শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে খুলনা নগরের তেঁতুলতলা মোড়ে চা খাওয়ার সময় অর্ণবকে গুলি করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মোটরসাইকেলে আসা কয়েকজন অর্ণবকে লক্ষ্য করে গুলি করে। একটি গুলি তার মাথায় বিদ্ধ হয়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার পর রাতেই তিনজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। প্রাথমিক তদন্ত শেষ না হওয়ায় আটক ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করা হয়নি।
সোনাডাঙ্গা মডেল থানার ওসি মো. শফিকুল ইসলাম জানান, অর্ণবের শরীরে বেশ কয়েকটি গুলির চিহ্ন রয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে তিনটি পিস্তলের গুলি ও একটি শটগানের গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি বলেন, বেশ কয়েকটি বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। অর্ণবের বাবা ঠিকাদার ছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি সেই ব্যবসা দেখাশোনা করতেন অর্ণব। এটা নিয়ে কোনো পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি নারীঘটিত কোনো ঘটনা বা অন্য কোনো দ্বন্দ্ব ছিল কি না, সে ব্যাপারগুলো তদন্তে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে অর্ণবের মা চন্ডী রানী এখনো জানেন না তার ছেলেকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করেছে। তিনি জানেন ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ছেলেকে হারিয়ে পরিবারে চলছে শোকের মাতম। গতকাল দুপুরে নগরীর বানরগাতি এলাকায় অর্ণবদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একটি কক্ষে বিলাপ করছিলেন অর্ণবের মা চন্ডী রানী। তাকে ঘিরে সান্ত্বনা দিচ্ছেন নারীরা। চন্ডী রানীকে জানানো হয়নি যে, তার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তিনি মারা গেছেন বলে জানেন চন্ডী রানী। এজন্য চন্ডী রানী বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, ‘কেন মোটরসাইকেল নিয়ে বাইরে গেলি। কোনো হেলমেট নিয়ে গেলি না। আমার বুকে ফিরে আয় আমার বাবা। আমার নিরীহ বাবা ফিরে আয়।’
অর্ণব হত্যার আগের দিন বৃহস্পতিবার কৃষকদল নেতার দুই চোখ উপড়ে ফেলার চেষ্টার ঘটনায়ও কাউকে আটক করা যায়নি। এ ছাড়া গত সোমবার ৯ ঘণ্টার ব্যবধানে পৃথক তিনটি স্থানে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এতে মানিক নামে যুবদলের এক নেতা নিহত হয়েছেন। একজনের আঙুল ও একজনের কবজি কেটে নিয়ে গেছে সন্ত্রাসীরা।
পুলিশের তথ্য বলছে, গত চার মাসে খুলনা জেলা ও মহানগরীতে ১১টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গুরুতর জখম হয়েছে অনেকে। প্রতিটি ঘটনার পেছনে মাদক কারবারি ও এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
গত সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় পুরাতন রেলস্টেশন এলাকায় নগরীর ২১ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাবেক সহসভাপতি মানিক হাওলাদারকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জখম করা হয়। বিকেলে তিনি মারা যান। সন্ধ্যা ৬টায় নগরীর আযমখান কমার্স কলেজের ভেতরে সন্ত্রাসীরা নওফেল নামে এক যুবককে কুপিয়ে তার আঙুল বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। রাত সাড়ে ৯টায় নগরীর বয়রা শ্মশানঘাট এলাকায় সজীব শিকদার নামে আরেক যুবককে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়।
রোববার রাতে ২৭ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহীনকে লক্ষ্য করে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। আশঙ্কাজনক অবস্থায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়ে। এ সুযোগে পুরোনো সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারিরা এলাকায় ফিরে এসেছে। অনেকে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে তারা সংঘাতে জড়াচ্ছে। বেশিরভাগ থানায় পুলিশের নতুন কর্মকর্তা যোগ দিয়েছেন। স্থানীয় সন্ত্রাসীদের চিনতে তাদের সময় লাগছে।
খুলনার নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব বাবুল হাওলাদার বলেন, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। এতে অস্ত্রের মহড়া ও হত্যাকাণ্ড বেড়েছে। মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে।
খুলনা মহানগর পুলিশের কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, ১২ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা তৈরি করে গ্রেপ্তারের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।