জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের ১২তম আবর্তনের শিক্ষার্থী পরিচয়ে ২০১৮ সাল থেকেই ক্যাম্পাসে অবস্থান বহিরাগত সোহেল রানার। মারধর, চাঁদাবাজি, সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানি থেকে শুরু করে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মতো বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এক সময় ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করলেও বর্তমানে জবি ছাত্রদলের সদ্য ঘোষিত আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেয় সোহেল।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮ সালে ক্যাম্পাসে প্রবেশের পর ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের ১২তম আবর্তনের ছাত্র হিসেবে ভুয়া পরিচয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হয়ে ওঠে সোহেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হয়েও ভুয়া স্টুডেন্ট আইডি কার্ড ব্যবহার করে জবির সিরাজগঞ্জ জেলা ছাত্রকল্যাণ পরিষদের ২০২২ সালের কমিটির সহসভাপতির দায়িত্বও নেয় সোহেল। এরপর ২০২৩ সালে তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থীকে হয়রানির অভিযোগ উঠলে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের ১২তম আবর্তনের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোহেল এই বিভাগের ছাত্র নয়।
এরপর শুরু হয় নতুন পরিচয়ে আগমন। আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর জবির অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের ভুয়া আইডি তৈরি করে ক্যাম্পাসে ফিরে আসে সোহেল। এবার নিজেকে পরিচয় দেয় ছাত্রদলের নেতা হিসেবে। তবে শাখা ছাত্রদল বলছে, সংগঠনের জবি শাখায় সোহেলের কোনো পদ নেই।
সোহেলের তৈরি ভুয়া আইডি কার্ডে ব্যবহৃত স্টুডেন্ট আইডি নম্বর অনুসন্ধান করে জানা যায়, তা অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের ১২তম আবর্তনের শিক্ষার্থী রোহিত প্রসাদ ঘোষের। রোহিত জানান, তিনি সোহেলকে চেনেন না এবং তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোহেল ঢাকা প্রফেশনাল কলেজের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। এ বিষয়ে জানতে ঢাকা প্রফেশনাল কলেজে যোগাযোগ করলে বিষয়টি নিশ্চিত করে কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, সোহেল এই কলেজের বিবিএ ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী এবং এরই মধ্যে এই সেশনের শিক্ষার্থীদের অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হয়েছে।
এদিকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে রকি নামে খুলনার ম্যানগ্রোভ ইনস্টিটিউটের এক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে সোহেল পঞ্চাশ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী রকি বলেন, ‘এক বন্ধুর মাধ্যমে সোহেলের সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন আমি জানতাম, সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছাত্রলীগ পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় তার পরিচিত লোক আছে এসব মিথ্যে বলে সে আমাকে এলজিইডিতে চাকরি দেওয়ার কথা বলে পঞ্চাশ হাজার টাকা নেয়। তার কাছ থেকে আমি কোনোভাবেই সে টাকা উদ্ধার করতে পারিনি।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সোহেল রানা বলেন, ‘আমি ২০১৬ সাল থেকে জবি ছাত্রদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ২০১৭ সালে জবির ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ডিপার্টমেন্টে পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেলেও ভর্তি হইনি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজগঞ্জ জেলা ছাত্রকল্যাণের বেশিরভাগ স্টুডেন্ট আমার বন্ধু হওয়ায় আর সবাই আমাকে গ্রহণ করার কারণে আমি তাদের সঙ্গে এই সংগঠনে যুক্ত হয়ে যাই।’
অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস ডিপার্টমেন্টের নামে ভুয়া আইডি কার্ড বানানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটা পাবলিকেশনের চাকরির জন্য এই আইডি কার্ডটি বানিয়েছিলাম।’
ছাত্রদলের সঙ্গে সোহেলের সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক মেহেদী হাসান হিমেল বলেন, ‘৫ আগস্টের পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইভিনিংয়ের স্টুডেন্ট পরিচয়ে সে আমাদের সঙ্গে পরিচিত হয়। তখনো আমরা জানতাম না, সে বহিরাগত। সে ব্যক্তিগতভাবে ছাত্রদল করতে পারে, তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের পোস্টপ্রাপ্ত কোনো নেতা বা কর্মী নয়।’
অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর সামসুন্নাহার বলেন, ‘এই বিষয়ে যেহেতু কোনো লিখিত অভিযোগ আসেনি, তাই এখনো আমরা এ বিষয়ে অবগত নই। তবে যার আইডি নম্বর ব্যবহার করে বহিরাগত সেই ছেলে নকল আইডি কার্ড বানিয়েছে, তার উচিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়া।’
সংশ্লিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. তাজাম্মুল হক বলেন, ‘কারও বিরুদ্ধে যদি নকল আইডি কার্ড ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিচয় দেওয়ার অভিযোগ আসে, তাহলে অবশ্যই রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে তার সত্যতা যাচাই করা হবে। যদি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম বলেন, ‘এ বিষয়ে যদি কোনো অভিযোগ আসে, তাহলে অবশ্যই সত্যতা যাচাইপূর্বক তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
মন্তব্য করুন