বেসরকারি টিভি চ্যানেল একুশে টেলিভিশনের (ইটিভি) সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুস সালামের অবৈধ সম্পদ অর্জন মামলার তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিচার শুরুর পর আদালতের নজরে আসে তদন্ত সঠিকভাবে করা হয়নি। চার্জশিটে আব্দুস সালামের প্লট ও ফ্ল্যাটের সঠিক ঠিকানা নেই এবং তার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ জব্দ বা ক্রোক করা হয়নি। মামলাটি ফের তদন্ত করে চার্জশিট জমা দেওয়ার আদেশ দেন আদালত। এর পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটি তদন্ত করে ফের চার্জশিট দাখিল করতে পরিচালক ফরিদ আহমেদকে দায়িত্ব দেয় দুদক। তদন্তের অংশ হিসেবে এ-সংক্রান্ত নথিপত্র চেয়ে রাজউক, ঢাকার সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও বিভিন্ন ব্যাংকে চিঠি পাঠিয়েছেন ফরিদ আহমেদ।
দুদকের তথ্য বলছে, ইটিভির সালামের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে করা মামলাটির তদন্ত সঠিক হয়নি। ওই মামলার চার্জশিটে একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরে ১৬ নম্বর রোডের ১০ নম্বর প্লটের ১৪.৩৪ কাঠা জমি, ৭ নম্বর সেক্টরে ১৮ নম্বর রোডের ৩৫ নম্বর প্লটের ৫ কাঠা জমি, কল্যাণপুর মেইন রোডে ১৫.৫০ কাঠা জমি, ধানমন্ডি ৫ নম্বর রোডের ৫২ নম্বর বাড়ির ৫/ডি নম্বর ১৪০০ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট, গুলশান ৩৭ নম্বর রোডের ৩৯ নম্বর বাড়ির জে-নম্বর ১৯৫০ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট, নিকুঞ্জ কবি ফারুক সরণির ১০ নম্বর প্লটে ১১.৩ কাঠা জমি এবং ১০.৭১ কাঠা জমি এবং বেইলি রোডে ২১০০ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট, যার মূল্য দেখানো হয়েছে ৫৫ লাখ টাকা।
দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, চার্জশিটে বেইলি রোডে ফ্ল্যাটের তথ্য থাকলেও সুনির্দিষ্ট ঠিকানা উল্লেখ নেই। তার ওপর আসামির সম্পদ চিহ্নিত না করে এবং জব্দ বা ক্রোক না করেই চার্জশিট দেওয়া হয়। অবৈধ সম্পদ অর্জন মামলার চার্জশিটে সঠিকভাবে সম্পদ চিহ্নিত করা ও ক্রোক করে দিতে হয়, যা করা হয়নি। এ ছাড়া তার বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা থাকলেও জব্দ করা হয়নি একটি ব্যাংক হিসাবও। এসব কারণে সালামের সম্পদ বর্তমানে কী অবস্থায় আছে, তা আদালতের জানার বাইরে থেকে যায়। এ জন্যই মামলাটি পুনর্তদন্ত করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। তদন্ত এরই মধ্যে শুরুও হয়েছে। নতুন তদন্ত কর্মকর্তা সম্প্রতি কমিশনে এ বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।
দুদকের তথ্যমতে, ২০১৬ সালের ২১ নভেম্বর কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপারের মাধ্যমে আবদুস সালামের কাছে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ পাঠায় দুদক। নোটিশে আবদুস সালাম ছাড়াও তার স্ত্রী, তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের নামে অর্জিত যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ-সম্পত্তি, দায়-দেনা ও আয়ের উৎস বিবরণ সাত কর্মদিবসের মধ্যে দুদকে জমা দিতে বলা হয়। আবদুস সালাম ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর তা গ্রহণ করলেও নির্ধারিত সময়ে বিবরণী জমা দেননি। পরে দুদকের উপপরিচালক সামছুল আলম বাদী হয়ে ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল রমনা থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে ৩২ কোটি ২০ লাখ ৯৫ হাজার ৮৫৬ টাকা মূল্যের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। সংস্থাটির উপপরিচালক সামছুল আলমকে মামলার তদন্ত শেষ করে ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট আদালতে চার্জশিট দেন। বিচার শুরুর পর দেখা যায়, চার্জশিটে সালামের সম্পদের সঠিক তথ্য দেওয়া হয়নি। সম্পদের এলাকা উল্লেখ করা হলেও বাসা নম্বর ও সড়ক নম্বর নেই। সম্পদ সংযুক্ত করা হয়নি। এ ছাড়া সম্পদ জব্দ ও ক্রোক না করায় বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত হবে। এসব কারণেই মামলাটি ফের তদন্ত করে চার্জশিট দাখিলের আদেশ দেন আদালত।
ইটিভির সাবেক চেয়ারম্যান সালামের নামে অর্জিত স্থাবর সম্পদের মূল্য ১৩ কোটি ৮৫ লাখ ৫ হাজার ৬৫৬ টাকা, অস্থাবর সম্পদের মূল্য ৬৪ কোটি ৯৯ লাখ ৮ হাজার ২৬১ টাকা। স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে মোট সম্পদ ৭৮ কোটি ৮৪ লাখ ১৩ হাজার ৯১৭ টাকা। তদন্তের সময় তার বক্তব্য নেওয়া হয় এবং আয়ের উৎসের বিষয়ে রেকর্ডপত্র সরবরাহের অনুরোধ জানানো হয়; কিন্তু আয়-ব্যয় সংক্রান্ত কোনো রেকর্ডপত্র উপস্থাপন করেননি সালাম। আয়কর বিভাগে তার জমা দেওয়া আয়কর রিটার্ন—সংশ্লিষ্ট নথি জব্দ করা হয়। সেগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ রয়েছে ৩২ কোটি ২০ লাখ ৯৫ হাজার ৮৫৬ টাকার। ২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারি রাতে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত একটি সভায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৫০ মিনিটের একটি বক্তব্য ইটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এক দিন পর ৬ জানুয়ারি ভোরে আবদুস সালামকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ।
মন্তব্য করুন