উদ্বোধনের পর প্রায় চার মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো শুরু হয়নি সাত জেলার শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার নির্মাণকাজ। গত ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও, সাতটি ইনকিউবেশন সেটারের একটিরও কাজ শতভাগ শেষ হয়নি। কোনো সেন্টারের প্রধান ফটকে তালা ঝুলছে, তো কোনোটির এখনো স্থানই বরাদ্দই হয়নি।
এমন প্রেক্ষাপটে কোনো কোনো সেন্টারের কার্যক্রম শুরু হতে আগামী জুন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের আওতায় বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ দেশের আট জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার নির্মাণ করছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে এসব সেন্টার নির্মাণের দ্বিতীয় সংশোধিত প্রকল্প শুরু হয়। প্রায় ৫৩৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। এ আটটি সেন্টার হলোÑ বরিশাল, চট্টগ্রাম (চান্দগাঁও), রংপুর (পীরগঞ্জ), নেত্রকোনা, মাগুরা, নাটোর (সিংড়া), কুমিল্লা (লালমাই) এবং সিলেট (কোম্পানীগঞ্জ)।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আইটিতে দক্ষ করার মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন, আইসিটি খাতের উদ্যোক্তাদের স্থান দেওয়া, একাডেমিয়া এবং আইটি ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে সেতুবন্ধন এবং আইটি বা আইটি সম্পর্কিত খাতে তরুণদের স্ব-কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করাই এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি প্রকল্পের কাজ শেষ হলে এখানে প্রায় ১৬ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রতিটি সেন্টারে গ্রাফিক্স ডিজাইন, অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট, ভিডিও এডিটিং, থ্রিডি অ্যানিমেশন, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন, ডিজিটাল মার্কেটিং, ই-কমার্স কন্ডাক্টিং, এন্ট্রাপ্রেনারশিপ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, ওয়েবসাইট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ওয়েবসাইট ডিজাইন, ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্টসহ আইটির ১০টি বিষয়ে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রতিটি সেন্টারে ২ হাজার ৫০০ জন প্রশিক্ষণ লাভের সুযোগ পাবেন।
২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশালের সেন্টার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর গত বছরের ১৮ অক্টোবর বাকি সাতটি সেন্টার উদ্বোধন করেন তিনি। বরিশাল ছাড়া বাকি কোনোটির কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। কালবেলার স্থানীয় প্রতিনিধিদের সরেজমিন পরিদর্শনে এমন চিত্র উঠে আসে।
মাগুরা সেন্টার: নির্মাণাধীন ইনকিউবেশন সেন্টারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেহাল দশা মাগুরায়। কালবেলার মাগুরা প্রতিনিধি মোখলেছুর রহমান শহরের জেলা পরিষদ পাড়ায় সেন্টারে সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখেন মূল ফটক তালাবদ্ধ। সেন্টারের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লিটন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মিজানুর রহমান লিটন বলেন, ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের দরপত্রের কিছু সংশোধনী পাস না হওয়া এবং নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় কাজ শেষ হতে সময় লাগছে। আগামী জুনে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার বিষয়ে আশাবাদী তিনি।
নেত্রকোনা সেন্টার: নেত্রকোনার ইনকিউবেশন সেন্টার নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। পরে এর মেয়াদ বেড়ে হয় ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, চলতি মাস অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে কাজ শেষ হবে। নেত্রকোনা প্রতিনিধি হানিফ উল্লাহ আকাশ জানান, এই সেন্টারে এখনো কোনো বেসরকারি, আধাসরকারি, ব্যক্তিমালিকানা বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কোনো স্থান ভাড়া নেয়নি। প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে কথা বলতে চাইলে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপসহকারী প্রকৌশলী হামিদুল ইসলাম সজীব কথা বলতে রাজি হননি। প্রকল্প এলাকার ছবি তুলতে চাইলেও বাধা দেন তিনি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. শামীম জানান, প্রকল্পের ভেতরের কাজ বাকি। নির্বাচনসহ নানা কারণে প্রকল্পের কাজ ধীর হয়।
রংপুর সেন্টার: পীরগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধি আকতারুজ্জামান রানা জানান, উপজেলার লালদীঘিতে ৩ একর ৯ শতক জমির ওপরে ৫৮ কোটি ৯২ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে ইনকিউবেশন সেন্টারটি। সেখানেও এখনো কোনো কার্যক্রম শুরু না হলেও একটি ফ্লোর ভাড়া নিয়েছে বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠান। উপজেলা সহকারী প্রোগ্রামার আশফাকুল ইসলাম বলেন, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষের কথা থাকলেও তা হয়নি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রহমান ট্রেডার্সের প্রকৌশলী মুরাদ হাসান বলেন, ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে। আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে বাকি কাজ শেষ হবে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কনসালট্যান্ট লিমিটেড (বিসিএল) অ্যাসোসিয়েটের প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন বলেন, ৯০ শতাংশ কাজ শেষ। চলতি মাসের মাঝামাঝি নাগাদ বাকি কাজ শেষ হতে পারে।
কুমিল্লা সেন্টার: কালবেলার লালমাই (কুমিল্লা) প্রতিনিধি আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ জানান, প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সৌন্দর্যবর্ধন এবং বৈদ্যুতিক লাইনের কাজ বাকি। ধীরগতির কারণে প্রকল্পের প্রায় ৭ শতাংশ কাজ এখনো বাকি। প্রকল্প এলাকায় এখনো কোনো স্থান বরাদ্দ (ভাড়া/লিজ) নেয়নি কোনো প্রতিষ্ঠান। নির্মাণ প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হামিদ কনস্ট্রাকশনের প্রকৌশলী আশরাফুলের সঙ্গে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। তিনি বলেন, তথ্য দেওয়ার বিষয়ে অফিস থেকে নিষেধাজ্ঞা আছে।
চট্টগ্রাম সেন্টার: চট্টগ্রাম থেকে কালবেলার প্রতিনিধি নূর হোসেন মামুন জানান, চান্দগাঁওয়ে নির্মাণাধীন ইনকিউবেশন সেন্টারের নির্মাণকাজ এখনো ৫ শতাংশ বাকি। সিটি করপোরেশনের ১ দশমিক ৭১ একর জায়গার নির্মাণ করা ইনকিউবেশন সেন্টারে এখন বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। এই সেন্টারের প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে আগামী জুন পর্যন্ত। সেন্টারের উপসহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, মূল ভবনের কাজ এখন পর্যন্ত ৯০ শতাংশ শেষ। লিফট, ইন্টেরিয়র, মুজিব কর্নার ও ফার্নিচার সংযোগের কাজ বাকি। ক্যান্টিন ভবনের কাজ হয়েছে ৯৫ শতাংশ। মূল ফটকের কাজ বাকি ১০ শতাংশ। পকেট গেটের কাজও বাকি রয়েছে। সামান্য কাজ বাকি বাউন্ডারি এবং লেভেলিং ও ড্রেসিংয়ের। শেষ হয়েছে ডোম ফিটিং এবং সড়ক ও পার্কিংয়ের কাজ। অত্র প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হোসেন কনস্ট্রাকশন প্রাইভেট লিমিটেডের প্রকল্প প্রকৌশলী শামীম হোসেন বলেন, সব কাজই প্রায় শেষ। শুধু লিফট ও ইলেকট্রিক সংযোগের কাজ বাকি।
নাটোর সেন্টার: ইনকিউবেশন সেন্টারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে নাটোরের সিংড়া সেন্টার। নাটোরে কালবেলার জেলা প্রতিনিধি পরিতোষ কুমার অধিকারী ইনকিউবেশ সেন্টারের প্রকৌশলী মনির হোসেনের বরাতে জানান, প্রকল্পের প্রায় ৯৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ষষ্ঠতলার অধিকাংশ রুমের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের কিছু কাজ বাকি। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। চতুর্থ তলায় ৬ হাজার ৭৮০ বর্গফুট আয়তনের সুবিধা-সংবলিত ইনকিউবেশন ও স্টার্টআপ সুবিধা-সংবলিত পাঁচটি রুম এবং একটি মিটিং রুম রয়েছে। এই ফ্লোরে ২ হাজার বর্গফুটে স্কিল আপ বাংলাদেশ, ১২৫ বর্গফুটে ডিজিব্রোডিজিটাল, ২৫০ বর্গফুটে শিখব আমরাই, ২৫০ বর্গফুটে নকরেক আইটি এবং ১ হাজার ২৫০ বর্গফুটে বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি বরাদ্দ নিয়েছে। পাশাপাশি কোডা স্টার্ট বাংলাদেশ লিমিটেড ২৫০ বর্গফুট, ইনভিশন আইটি ২৫০ বর্গফুট এবং ই লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং লিমিটেড ৮৪০ বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ নিয়েছে। আরও আটটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে মোট ৫ হাজার বর্গফুট স্পেস বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তারা এখনো কোনো কার্যক্রম শুরু করেনি।
সিলেট সেন্টার: সিলেট থেকে কালবেলা প্রতিনিধি মিঠু দাস জানান, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্কের ভেতরে ইনকিউবেশন সেন্টার ভবন। এই ভবনের বেশিরভাগ কাজ শেষ। বেশকিছু প্রতিষ্ঠান স্থান বরাদ্দ নিয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠানই তাদের কার্যক্রম শুরু করেনি। হাইটেক পার্ক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেন্টারের সম্পূর্ণ কাজ শেষ হতে এপ্রিল পর্যন্ত লাগতে পারে।
আট জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার নির্মাণ প্রকল্পের সদ্য সাবেক পরিচালক ও আইসিটি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোস্তফা কামাল কালবেলাকে বলেন, সেন্টারের ভবনগুলোর নকশা বেশ জটিল, দেশের বাইরের অনেক ভবনের মতো। তাড়াহুড়া করতে গেলে কাজের মান খারাপ হতে পারে। আর দুটি সেন্টারের (নাটোর ও বরিশাল) প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে। আটটি ঠিকাদারের সবাই তো একরকমভাবে কাজ করে না। দুটি সেন্টারের কাজ খানিকটা পিছিয়ে আছে। বাকিগুলোর কাজ ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে শেষ হবে। সব ঠিকাদারকেই তদারকির মধ্যে রেখে দ্রুত কাজ বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছি। উদ্বোধন হলেও ফিনিশিংয়ের কাজে একটু সময় লাগে।