প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে আবাসনহীন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের জন্য আধুনিক ও যুগোপযোগী ক্যাম্পাস উপহার দেওয়ার ঘোষণা দেন। এরপর ২০১৮ সাল থেকে ঢাকার কেরানীগঞ্জে নতুন ক্যাম্পাসের কাজ চলছে। প্রকল্পটির শুরু থেকেই একের পর এক অনিয়মের চিত্র উঠে আসছে। বর্তমানে নতুন ক্যাম্পাসে চলমান পাঁচ তলাবিশিষ্ট প্রকৌশল ও প্ল্যানিং দপ্তরের ভবন এবং পুকুরের ঘাট নির্মাণের কাজে চাঞ্চল্যকর অনিয়মের চিত্র দেখা গেছে।
ভবনটিতে ৫৫ ফিটের স্থলে ৩০ থেকে ৩৫ ফিট পাইলিং করা, ভিত্তি দুর্বল করে পাইলের বাকি অংশ ভেঙে তার রড-সিমেন্টে পুকুরের ঘাটে ঢালাই দেওয়া হচ্ছে। এতে ভিন্ন দুই কোম্পানির পাওয়া দুই টেন্ডারের কাজে একই রড-সিমেন্টে দুবার বিল নেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলীরা নতুন ক্যাম্পাসের কাজ তদারকিতে থাকলেও অনিয়মের কোনো তথ্য নেই তাদের কাছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, ভবনের জন্য ৫৫ ফিট পাইলিং করার কথা। হ্যামার দিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ ফিট পাইল ঢোকানো হচ্ছে। বাকি ২০ থেকে ২৫ ফিট পাইলের রডসহ কংক্রিটের অংশ ভেঙে সেটা আরেকটি প্রতিষ্ঠানের করা পুকুরের ঘাট ঢালাইয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে প্রথমে যেমন ভবনের ৫৫ ফিট পাইলের বিল নেওয়া হচ্ছে, তেমনই আবার বাকি ভাঙা ২০ থেকে ২৫ ফিট পাইলের অংশটুকু পুকুরের ঘাটে ঢালাই হিসেবে ব্যবহার করে বিল নেওয়া হচ্ছে। একই রড-সিমেন্ট দুই কাজে ব্যবহার দেখিয়ে দুইবার বিল নেওয়া হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ৬১ কোটি ৮৯ লাখ ৯ হাজার ৩৪৭ টাকা মূল্যে এসএসএল ও আরএস নামে দুটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে পাঁচতলা প্রকৌশল ভবনের টেন্ডার পায়। অন্যদিকে ৩ কোটি ২৮ লাখ ৩৪ হাজার ৫১৪ টাকায় নতুন ক্যাম্পাসের পুকুরের ঘাট করার টেন্ডার পায় আরএন এন্টারপ্রাইজ নামে আরেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আরএন এন্টারপ্রাইজের ঠিকাদার ওমর ফারুক রুমি। তিনি ভবনটির টেন্ডার কিনে কাজ করছেন। ঠিকাদার একই হওয়ার কারণে ভবনের ভাঙা পাইল পুকুরের ঘাটের ঢালাইয়ে ব্যবহার করছেন। এ ধরনের বড় অনিয়ম হলেও ঠিকাদার রুমি বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রধান প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন পাটোয়ারীর ঘনিষ্ঠ হওয়ায় পার পেয়ে যাচ্ছেন। ভবনটির কাজ প্রতিদিন পরিদর্শন করতে যান প্রধান প্রকৌশলীর অত্যন্ত আস্থাভাজন সহকারী প্রকৌশলী গৌতম কুমার শিকদার। তিনিও এসব অনিয়ম দেখলেও যোগসাজশে নীরব থাকেন।
প্রকৌশল দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে এত বহুতল ভবনে পাইলিং করা গেলেও হাওর এলাকায় মাত্র পাঁচতলা ভবনের পাইল ঢুকছে না—এটা অবান্তর। বরিং সিস্টেমেও পাইল ঢোকানো যায়। মূলত একই জিনিসের ভাঙাগড়া করে দুবার ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি ‘টেন্ডার চক্র’। প্রায় সাড়ে তিনশর ভেতরে এরই মধ্যে ২২০টির মতো পাইলিং করা শেষ।
এ বিষয়ে ঠিকাদার রুমি বলেন, ‘৩০ ফিট পাইলিংয়ের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগ। ডিপার্টমেন্টের নিয়ম অনুযায়ী ৫৫ ফিটের পাইলিং করা হচ্ছে। অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। আপনি চাইলে মেপে দেখতে পারেন।’
কাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রকৌশলী গৌতম কুমার শিকদার বলেন, ‘প্রথম দিকে ১৫-১৬টি পাইল সম্পূর্ণ যায়নি। তখন কিছু গাফিলতি ছিল। কিছু পাইল তারা ইচ্ছাকৃতভাবে সঠিক গভীরতায় ঢোকায়নি। প্রতিদিন ৩-৪টি পাইল ঢোকানো যায়। কিন্তু তারা পাইলিং দ্রুত শেষ করার জন্য প্রথমদিকে দিনে ১০-১২টি ঢোকাচ্ছিল। আমি মানা করায় এখন এমন করছে না।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, পাইলগুলো ৫৫ ফিট দেওয়ার কথা থাকলেও নিচের মাটি শক্ত হওয়ার কারণে সম্পূর্ণ ঢোকানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রথম দিকে ঠিকাদার আমাদের বিষয়টি জানায়নি। এটা অন্যায় হয়েছে তাদের। পরে আমরা জানার পর আবার সয়েল টেস্ট (মাটি পরীক্ষা) করিয়েছি। সে রিপোর্টেও নিচের মাটি শক্ত পাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তিনি আরও বলেন, পাইলের অবশিষ্ট অংশ ঘাটে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না—আমি জানি না। প্রতিদিন তো আর ওখানে গিয়ে দেখা সম্ভব নয়। যদি তারা ঘাটে ব্যবহার করে, সেটা সম্পূর্ণ অবৈধ হবে। দুটি কাজ আলাদা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে। যদি পাইলের অবশিষ্ট মালপত্র যোগসাজশ করে ঘাটের ঠিকাদার ব্যবহার করে, তাহলে সেটা তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ড. হুমায়ুন কবীর চৌধুরী বলেন, পাইলিংয়ের ভাঙা অংশ ঘাটের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, সে সম্পর্কে জেনেছি। বিষয়টি উপাচার্যের সঙ্গে বিস্তর আলাপ করে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা দেখব।