চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সরকারের কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আয় না হওয়ায় ব্যয় নির্বাহে ব্যাংকের ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়েছে। তবে পরের মাস আগস্টে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ কিছুটা কমেছে। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের মুনাফাই ঋণ কমায় অন্যতম ভূমিকা রেখেছে। এ সময় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেও বাংলাদেশ ব্যাংকে উল্টো পরিশোধ দেখানো হয়েছে। এতে নিট ঋণ ঋণাত্মক হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা।
এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে পরিশোধ দেখানো হয়েছে ১০ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। ফলে এ সময় সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ২১২ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৫ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা। তবে আগস্টে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুনাফা সরকারের কাছে হস্তান্তর করায় ঋণের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। ২৮ আগস্ট পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। আর এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংককে আগের নেওয়া ঋণ পরিশোধ দেখানো হয়েছে ২৩ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা। এতে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা।
আগস্টে অস্বাভাবিক হারে ঋণ কমার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, বিদায়ী অর্থবছর বাংলাদেশ ব্যাংক ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। যার পুরোটাই সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার রীতি রয়েছে। চলতি বছর সরকার সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগে নেওয়া ঋণের পরিশোধ হিসেবে সমন্বয় করে নিয়েছে। মূলত এ কারণেই আগস্ট মাসে সরকারের ঋণ কমেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছর ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই হিসাবে প্রতি মাসে আদায় করতে হবে প্রায় ৩৫ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে আদায় হয়েছে মাত্র ২০ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। অর্থাৎ অর্থবছরের প্রথম মাসেই লক্ষ্যমাত্রা ঘাটতি তৈরি হয়েছে ১৫ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের তুলনায়ও জুলাইয়ে কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। আগস্টের রাজস্ব আদায়ের তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি এনবিআর। তবে এ সময় ঘাটতি আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আশানুরূপ রাজস্ব আদায় না হওয়া, কাঙ্ক্ষিত বিদেশি ঋণ না পাওয়া এবং সঞ্চয়পত্রে ঋণ না বেড়ে উল্টো কমে যাওয়ায় সরকারের ঘাটতি সংস্থানে ব্যাংকেই নজর দেওয়া হচ্ছে। তবে ১০ শতাংশের মতো মূল্যস্ফীতির কারণে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা ছাপিয়ে ঋণ নেওয়া বন্ধ রেখেছে সরকার। এ বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে সরকারকে অনুরোধ করব যেন ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে খুব বেশি ঋণ না নেয়।
এদিকে বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বেশিরভাগ সময়েই বেসরকারি খাতে কমেছে ঋণ প্রবৃদ্ধি। অর্থবছর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
এর আগে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল সরকার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার রেকর্ড ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি সরবরাহ করেছিল ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা, যা নতুন টাকা ছাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে অর্থনীতিবিদদের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে গত অর্থবছর টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামীতেও এমন সুবিধা দেওয়া হবে না বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কেন না বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে ঋণ দিলে তা সরাসরি মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলে। এ অবস্থায় সরকারকে ব্যাংকমুখী না হয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তারা বলেছেন, সাধারণত বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বাড়লে বেসরকারি খাত প্রয়োজনীয় ঋণের জোগান থেকে বঞ্চিত হয়। এ কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে যত সম্ভব কম ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দেন তারা।
এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে এমনিতেই চাপে রয়েছে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। অন্যদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে যদি সরকার বেশি ঋণ নেয়, তাহলে বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে বিনিয়োগ কম হবে। আর বিনিয়োগ কম হলে কর্মসংস্থান কম হবে। ফলে প্রবৃদ্ধির ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। এমন অবস্থায় সরকারকে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ না নিয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। সেখানেও করের হার না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
একই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ব্যাংকগুলো সরকারকে ঋণ দিয়ে বেশি সুদ পাচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর লাভ হচ্ছে। তবে বেসরকারি খাতের ওপর চাপ বাড়ছে। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিও কিছুটা কমে যাচ্ছে। সরকার যদি ব্যাংক থেকে কম ঋণ নিত, তাহলে বেসরকারি খাতে আরও চাঙ্গা ভাব থাকত। কিন্তু সরকারের ব্যয় অনুপাতে আয় কম। এ কারণেই ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার গতি বাড়ছে। চলতি অর্থবছর বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার।