

বিভাগের ইউজার ফির (রোগীদের থেকে নেওয়া চিকিৎসা ব্যয়) কোটি টাকা তুলে নেওয়া, মতের বিরুদ্ধে গেলে অন্য চিকিৎসকদের জামায়াত ও রাজাকার ট্যাগ দেওয়া, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ইচ্ছামতো জরুরি বিভাগে ফেলে রাখা, বিভাগের একাধিক কক্ষ নিজের দখলে রাখাসহ অসংখ্য অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, তিনি অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দীন শাহ। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে লাগানো হয়েছে হেমাটোলজি বিভাগের সাবেক এই চেয়ারম্যানের ছবিসহ পোস্টার। এতে লেখা হয়েছে, ‘স্বৈরাচার-ফ্যাসিস্ট সরকারের হাইব্রিড দালাল, দুর্নীতিবাজ, বিকৃত-মানসিকতার স্যাডিস্ট অধ্যাপক ডা. মো. সালাহউদ্দীন শাহ এর পদত্যাগ চাই। হেমাটোলজি বিভাগে দুর্নীতি ও বাণিজ্য করে বহিরাগত শিক্ষক নিয়োগকারী ধুরন্ধরের অবিলম্বে অপসারণ চাই।’
এর পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যাপক সালাহউদ্দীন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে লিখিত আবেদন করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ডা. সালাহউদ্দীন শাহ বিভাগীয় চেয়ারম্যান হওয়ার পর সিনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, হুমকি-ধমকি, দুর্নীতি, বিভাগের চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হয়রানি নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়। বিভাগের শিক্ষক ও চিকিৎসকদের পর্যাপ্ত কক্ষ না থাকলেও তিনি বিভাগের সবচেয়ে বড় দুটি কক্ষ নিজের দখলে রাখেন। গত ২০২২ সালে বিভাগের পারিতোষিকের টাকায় গাজীপুরের ব্র্যাক সিডিএমএ পিকনিক আয়োজন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি ছাড়াই বিভাগের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে বিভিন্ন জায়গা থেকে গোপনে অর্থ সংগ্রহ করেন। এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বিরুদ্ধে একাধিকবার তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালীদের দিয়ে তা বন্ধ করিয়ে দেন। এ ছাড়া তার ব্যক্তিগত মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ল্যাব ওয়ানের ব্যয়বহুল বিভিন্ন পরীক্ষা বিএসএমইউ থেকে বিনামূল্যে করিয়ে নিতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, বিভাগীয় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে বিভাগের দুজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. মো. আদনান হাসান মাসুদ ও ডা. কাজী মুহাম্মদ কামরুল ইসলামকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সাধারণ জরুরি বিভাগে বদলি করা হয়। এমনকি বিভাগের আরেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে ১৩ মাস জরুরি বিভাগে ফেলে রাখেন ও তার বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট পর্যন্ত বন্ধ করে দেন। তার মেয়াদে হেপাটোলজি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে বিভাগীয় যোগ্য প্রার্থীদের পদোন্নতি বঞ্চিত করে বেআইনিভাবে সরকারি (বিসিএস) চাকরিরত তিনজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এমনকি পদোন্নতির পরীক্ষায় বিভাগের সবচেয়ে যোগ্য ও সিনিয়র প্রার্থীকে ইন্টারভিউ কার্ড ইস্যু করতে দেননি।
ভুক্তভোগী চিকিৎসক ডা. মো. আদনান হাসান মাসুদ বলেন, ‘বিগত ১৫ বছর আমরা এই বিভাগে আয়নাঘরের মতো ছিলাম। আমাদের বসার কোনো রুম তো দূরের কথা, কোনো চেয়ার পর্যন্ত দেওয়া হতো না। সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরও গত ১৫ বছরে কোনো পদোন্নতি পাইনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন যে প্রশাসন এসেছে অধ্যাপক সালাহউদ্দীন সেই প্রশাসনের লোক হয়ে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছেন। আমরা চাই, তার সব ধরনের অনিয়ম তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’
২০০৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় বছর হেমাটোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক পদ জোর করে দখল করে রাখেন সালাহউদ্দীন শাহ। এক পর্যায়ে সোসাইটির অন্য চিকিৎসকদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় তাকে সরিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। তিনি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ছিল।
বিভাগের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় তিনি সরকারি ও বেসরকারি রেসিডেন্ট চিকিৎসক ও কর্মচারীদের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে বাধ্য করতেন। ২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনেও তাদের যেতে বাধ্য করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী সর্বস্তরের শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এ রকম একজন ঘৃণ্য, বর্ণচোরা, অত্যাচারী ও দুর্নীতিবাজ চিকিৎসকের অতিদ্রুত বিচার ও চাকরি থেকে অপসারণ দাবি করছেন।
ওই বিভাগের একজন চিকিৎসক জানান, চিকিৎসক-কর্মচারীদের নানাভাবে হয়রানির ক্ষেত্রে তিনি অদ্বিতীয়। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সুবিধাবাদী হিসেবে পরিচিত। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি থাকলেও সংগঠনের নির্দেশনা অমান্য করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সঙ্গে একই প্যানেলে নির্বাচন করে ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। এজন্য সে সময় তাকে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর থেকে বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের সঙ্গে সখ্য বজায় রেখে ২০০৫ সালে একই সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও বিএসএমএমইউতে সহকারী অধ্যাপকের চাকরি বাগিয়ে নেন। ২০০৭ সালে এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগার হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। সেই সময়ে তার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে অধ্যাপক ডা. মনজুর মোর্শেদ চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক সালাহউদ্দীন শাহ কালবেলাকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। বিভাগীয় প্রধান হিসেবে আমার বিভাগের সবাইকে যথাসময়ে উপস্থিত থাকা ও শৃঙ্খলা মেনে চলতে বলেছি। আমি নিজেও শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালন করেছি। নিয়ম মেনেই বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। এখানে অনিয়ম করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ আমি নিয়োগকর্তা ছিলাম না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বা নিয়োগকর্তা ছিলেন উপাচার্য।’
তিনি বলেন, ‘আমার সম্মানহানি করতে একটি পক্ষ এসব অপবাদ ছড়াচ্ছে। এ বিষয়ে আমি উপাচার্য বরাবর একটি আবেদনও করেছি।’