নারিকেল গাছে সাদা মাছির আরও একটি নতুন প্রজাতি শনাক্ত করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক। গবেষণা দলের সদস্যরা সাদা মাছির নানা প্রজাতি শনাক্তে সম্প্রতি যশোর, খুলনা ও বাগেরহাট গেলে সেখানে নতুন প্রজাতির উপস্থিতি লক্ষ করেন। পরে গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের পর নতুন এই প্রজাতি শনাক্ত করা হয়। তবে সাদা মাছির নতুন এই প্রজাতি নারিকেল শিল্পের জন্য হুমকি হতে পারে বলে মনে করছে গবেষক দল। নতুন প্রজাতির সাদা মাছির বৈজ্ঞানিক নাম প্যারালেইরোডেস বোন্দারি। যাকে বাংলায় বলা হয় বোন্দার নেস্টিং সাদা মাছি। বিষয়টি জানিয়েছেন প্রকল্পের প্রধান গবেষক বাকৃবির কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. গোপাল দাস। রুগোজ স্পাইরালিং হোয়াইটফ্লাইয়ের বায়ো-ইকোলজি এবং মরফো-মলিকুলার অধ্যয়ন এবং গবেষণাগারে এই পোকার বিরুদ্ধে কিছু নতুন জেনারেশনের কীটনাশকের কার্যকারিতা মূল্যায়ন শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় গবেষণাটি পরিচালিত হচ্ছে।
কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) অর্থায়নে অধ্যাপক ড. গোপাল দাস গত বছর থেকে এই পোকার বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণা করছেন। তার গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করছেন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী সোহেল রানা।
গবেষক ড. গোপাল দাস বলেন, দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল নারিকেল। একসময় গ্রামাঞ্চলে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কমবেশি নারিকেল গাছ ছিল। এর ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন জেলায় গড়ে উঠেছিল ছোট-বড় অনেক শিল্প। তবে সম্প্রতি নারিকেল উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ, মরছে গাছ, কমেছে ফলন। রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ এর অন্যতম কারণ।
তিনি বলেন, রুগোস স্পাইরালিং হোয়াইটফ্লাই (বৈজ্ঞানিক নাম-আলিউরিডিকাস রুজিওপারকিউলেটাস) যা নারিকেলের সাদা মাছি নামে পরিচিত। এটি একটি বিদেশি পোকা। পোকাটি দেশের নারিকেল শিল্পে একরকম বিপর্যয় ঘটিয়েছে। নারিকেল চাষিদের জন্য সর্বনাশকারী এই সাদা মাছি। ২০১৯ সালে বারির কীটতত্ত্ববিদরা দেশে এর উপস্থিতি শনাক্ত করেন। আমরা দেশব্যাপী জরিপের মাধ্যমে এই পোকার ৬১ পোষক উদ্ভিদ শনাক্ত করেছি, যা আমেরিকার একটি জার্নালে গত বছর প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে আমরা এই পোকার বায়ো-ইকোলজি, প্রজাতি শনাক্তকরণ ও বিভিন্ন জৈব-বালাইনাশকের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করছি।
এই গবেষক আরও বলেন, নতুন প্রজাতি শনাক্তকরণে আমরা দেশের ৩০টি এগ্রো-ইকোলজিক্যাল জোন থেকে সাদা মাছি সংগ্রহ করেছি। এরই ধারাবাহিকতায় যশোর, খুলনা ও বাগেরহাট থেকে নারিকেল গাছ থেকে সাদা মাছি সংগ্রহ করে গবেষণাগারে আনা হয়। পরে এই সাদা মাছিগুলোর মর্ফোলজিক্যাল বা বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য গবেষণাগারে অধ্যয়ন করা হয় এবং সেখানে কিছু ভিন্ন প্রজাতির সাদা মাছির উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়।
ড. গোপাল দাস নতুন প্রজাতির মাছির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানান, নতুন প্রজাতির সাদামাছি আকারে খুব ছোট এবং নারিকেলের সাদা মাছির প্রায় অর্ধেক (১.১-১.২ মিমি লম্বা)। এই পোকাটির সামনের পাখায় ক্রস-চিহ্নযুক্ত ধূসর বর্ণের ব্যান্ড রয়েছে। অন্য সাদা মাছি স্পাইরাল আকারে ডিম পারে, তবে এটি মোম ও তুলা দিয়ে পাখির মতো বাসা তৈরি করে সেখানে ডিম পাড়ে। এদের ডিমে পাতার বোটার মতো থাকে যা অন্য সাদা মাছিতে দেখা যায় না। এদের পিউপেরিয়াম সমতল এবং কোনো লেজের মতো প্রজেকশন থাকে না। বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে শনাক্ত করা হলেও মলিকুলার অধ্যয়নের কাজ চলমান রয়েছে। অন্যান্য যেসব এগ্রো-ইকোলোজিক্যাল জোন থেকে সাদা মাছি সংগ্রহ করা হয়েছিল সেখানে এর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়নি।
নতুন প্রজাতির মাছি হুমকির কারণ হওয়ার বিষয়ে ড. গোপাল দাস বলেন, ২০১৮ সালে এটি ভারতের কেরালায় এবং ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে শনাক্ত করা হয়। এ বছরের শুরুর দিকে পোকাটি শ্রীলঙ্কায় শনাক্ত করা হয়। বোন্দার নেস্টিং সাদা মাছির কী কী পোষক উদ্ভিদ রয়েছে, বিভিন্ন এলাকায় আক্রমণের তীব্রতা ও ক্ষতির মাত্রা কেমন সেসব বিষয়ে বিশদ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
ভারত ও শ্রীলঙ্কার কিছু গবেষণাগারে দেখা গেছে, এই নতুন পোকাটির ডিম পাড়ার সময়কাল ও প্রজনন সক্ষমতা নারিকেলের সাদা মাছির থেকেও বেশি। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নারিকেলের সাদা মাছির সংখ্যা কমে গিয়ে বোন্দার নেস্টিং সাদা মাছির সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে। আমাদের এই অঞ্চলে জলবায়ুর ধরন মোটামুটি একই রকম হওয়ায় দেশেও পোকাটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং নারিকেলের উৎপাদন আরও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
বিষয়টি নিয়ে অধিকতর গবেষণার বিষয়ে অধ্যাপক গোপাল দাস বলেন, এই পোকার ক্ষতির ধরন নারিকেলের সাদা মাছির মতোই। তবে ক্ষতির ভয়াবহতা কেমন সেটি জানতে এর বায়োলজি, প্রজনন সক্ষমতা, বৃদ্ধির হার ইত্যাদি নিয়ে গভীরতর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। নির্বিচারে কীটনাশক প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে এবং এর উপকারী পোকাগুলোকে প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।