শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কষ্ট দূর করতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘গুচ্ছ’ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা এলেও শুরু থেকেই ছিল নানান সংকট। বিগত বছরগুলোতে না পারলেও এবার আগেভাগেই কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের ঘোষণা দেয় এবং সে অনুযায়ী তাদের কার্যক্রম চলছে। তাদের দেখাদেখি এখন পর্যন্ত সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গুচ্ছের ৭টি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে গেছে। আরও কয়েকটি বের হয়ে যেতে চাচ্ছে। অন্যদিকে, প্রকৌশল গুচ্ছ পুরোটাই ভেঙে গেছে। শিক্ষা উপদেষ্টার বারবার চিঠি ও নির্দেশনাও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত আর্থিক কারণেই এই সম্পর্কচ্ছেদ। সে কারণে সংকটে পড়তে পারে পুরো পরীক্ষা পদ্ধতি।
জানা গেছে, আগে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ভর্তি পরীক্ষা নিত। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের দূরদূরান্তে গিয়ে একাধিক ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো। এতে ভোগান্তির সঙ্গে খরচও বাড়ত। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ক্ষোভ দেখিয়েছিল। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) উদ্যোগে ও সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের নির্দেশনায় ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে প্রথম গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়। এতে অংশ নেয় কৃষি ও কৃষি শিক্ষাপ্রধান সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়। এ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা পরীক্ষা দিতে হয় না। একটি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী তার যোগ্যতা ও পছন্দ অনুযায়ী গুচ্ছে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন। এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণ করায় সফলতা পাওয়া গেলে পরবর্তী সময়ে একইভাবে তিনটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় মিলে প্রকৌশল গুচ্ছ এবং ২২টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে জিএসটি গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী গুচ্ছে যোগ দিলেও শুরু থেকেই কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এই পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি), ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি), গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি)। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ বলেছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ বড় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে গুচ্ছে নিয়ে আসতে হবে। নইলে তারা গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আসেনি। অন্যদিকে, বুয়েটকে গুচ্ছে আসার প্রস্তাব দেওয়া হলে তাদের দাবি ছিল, প্রতি বছর বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম থাকতে হবে। সেটি আবার অন্যরা মানতে নারাজ। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছে আসেনি দেখে এই পদ্ধতিতে না আসা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আর ইচ্ছা দেখায়নি।
এরপর ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে দেশের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ‘একক’ ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি। নতুন এই নিয়মে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য ‘ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটি (এনটিএ)’ নামে পৃথক একটি কর্তৃপক্ষ গঠনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ইউজিসি ‘একক ভর্তি’ পরীক্ষার একটি খসড়া অধ্যাদেশ রাষ্ট্রপতির অনুমতির জন্য পাঠানো হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এটি ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্বন্দ্বে আটকে যায়। ইউজিসিকে ফের খসড়াটি স্বয়ংসম্পূর্ণ করে পাঠানোর জন্য ২০২৩ সালের ২৭ নভেম্বর চিঠি দেওয়া হলেও কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি।
ফলে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষেও গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু রাজনৈতিক পালা বদলের কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই আর গুচ্ছ পদ্ধতিতে থাকতে রাজি নয়। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াই আগামী ২৫ এপ্রিল গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হবে।
বেরিয়ে গেল ৭ বিশ্ববিদ্যালয়:
এখন পর্যন্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গুচ্ছ পদ্ধতি থেকে সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় বেরিয়ে গেছে। সেগুলো হলো—জবি, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি), খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি), কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি), বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি), হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি) ও বশেমুরবিপ্রবি। তাদের মধ্যে গত শুক্রবার ই-ইউনিট (চারুকলা অনুষদ) দিয়ে জবির ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। গত শনিবার আবেদন নেওয়া শেষ হয়েছে শাবিপ্রবির। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। খুবিতে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আবেদন নেওয়া হবে। ১৭ এপ্রিল শুরু হবে ভর্তি পরীক্ষা। কুবিতে গতকাল ভর্তি আবেদন শুরু হয়েছে। চলবে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। পরীক্ষা শুরু হবে ১৯ এপ্রিল। হাবিপ্রবিতে ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত অনলাইনে ভর্তি আবেদন চলবে। ২১ থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত চারটি ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও এখনো ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দেয়নি ববি ও বশেমুরবিপ্রবি। গত ২১ জানুয়ারি ববি এবং ২৬ জানুয়ারি বশেমুরবিপ্রবি গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে যায়।
জানতে চাইলে কুবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী কালবেলাকে বলেন, একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আলাদা করে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা গুচ্ছের বাইরেই আছি।
বশেমুরবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. হোসেন উদ্দিন শেখর কালবেলাকে বলেন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের চাওয়ার কারণে একাডেমিক কাউন্সিলে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। গুচ্ছ নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ ছিল।
ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, ছাত্রদের কল্যাণের কথা না ভেবে কেউ যদি নিজের দিকটা ভাবে, সেটি দুঃখজনক। ছাত্রদের কারণেই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উপাচার্য, কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি আমাদের মর্মাহত করেছে। এখন সরকার তাদের মতো করে এটি বিবেচনা করবে এবং সিদ্ধান্ত নেবে।
কুয়েটের একক সিদ্ধান্তে ভাঙল প্রকৌশল গুচ্ছ!
সূত্র বলছে, প্রকৌশল গুচ্ছে সবার আগে বের হয়ে যায় খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)। তাদের দেখাদেখি বের হয় অন্য দুটি বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) এবং রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট)। মূলত কুয়েট সবার আগে গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে ১৭ নভেম্বর ভর্তি বিজ্ঞপ্তি জারি করে। গত ১১ জানুয়ারি কুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রকৌশল গুচ্ছভুক্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, তারা (কুয়েট) আমাদের না জানিয়েই গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যায়। এর ফলে আমাদের কিছুটা বিপাকেও পড়তে হয়।
শিক্ষা উপদেষ্টার অনুরোধকে থোড়াই কেয়ার!
গুচ্ছ পদ্ধতি বহাল রাখতে শিক্ষার্থীরা একাধিকবার ইউজিসি ভবন ঘেরাও করেছে। ইউজিসি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গুচ্ছ পদ্ধতি বহালের সুপারিশ করবে বলে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। কিন্তু শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ দফায় দফায় চিঠি দিয়েছেন। সেটিকে থোড়াই কেয়ার করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
আর্থিক কারণেই সম্পর্কচ্ছেদ: সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক টাকা আয় হয়। এমন আয়ের দিক থেকে জবি ও বশেমুরবিপ্রবিও ওপরের সারিতে রয়েছে। যে কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছে না আসায় তারাই শুরুতে এই পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। গুচ্ছে না থাকার পেছনে বড় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পদ্ধতিতে যুক্ত না হওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির বাধা ও শিক্ষার্থীদের না চাওয়ার বিষয়টি সামনে আনার মূল কারণ ছিল আর্থিক অবস্থা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউজিসির সাবেক একজন সদস্য কালবেলাকে বলেন, গুচ্ছ পদ্ধতিতে এই পর্যন্ত যতবার পরীক্ষা হয়েছে, কোনো সময়ই এর আয়-ব্যয়ের হিসাব দেওয়া হয়নি। যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে চরম অসন্তোষ ছিল। সে কারণে গুচ্ছ পরীক্ষা শুরুর আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রথম যে সভা হতো, সেখানে কথা কাটাকাটি, তর্কাতর্কির মতো ঘটনাও ঘটেছে।#