দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে জ্বালানি বিভাগ। এরই মধ্যে জার্মানির একটি কোম্পানি আগ্রহও দেখিয়েছে। জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।
এদিকে, বহু বছর আগের মীমাংসিত বিষয় নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি না করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ ও পরিবেশবিদরা। তারা বলেন, অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার ফুলবাড়ীতে যদি উন্মুক্ত খনন করে, তাহলে তা জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে জরুরি সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এ নিয়ে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাহলে তা নির্বাচিত সরকার নেবে।
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে গত মঙ্গলবার কালবেলাকে বলেন, দিন দিন আমাদের কয়লার চাহিদা বাড়ছে, আমদানি করতে হচ্ছে। কয়লার চাহিদা মেটাতে নিজেদের কয়লা ব্যবহার করতে পারলে সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কার্যক্রম বছরখানেকের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তখন খনির কাছে অবস্থিত বড়পুকুরিয়ায় স্বল্পমূল্যের বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে আমাদের অতিরিক্ত কয়লার প্রয়োজন হবে। ফুলবাড়ী থেকে বড়পুকুরিয়া অনেক কাছে।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে খনি থেকে কয়লা তোলার পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক চলছে। দিনাজপুরের ফুলবাড়ী খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলা নিয়ে ২০০৬ সালে তৎকালীন এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে বড় ধরনের আন্দোলন হয়। এতে তিনজন নিহত হন। ওই সময় তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছয় দফা চুক্তি করেছিল। সেই চুক্তির মূল বিষয় ছিল ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা যাবে না। একই সময় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনি হবে না। কৃষিজমির ক্ষতি করে কয়লা তোলা হবে না। তা সত্ত্বেও শুরু থেকেই ফুলবাড়ী নিয়ে তৎপর ছিল এশিয়া এনার্জি। পরে কোম্পানিটির নাম পরিবর্তন করে জিসিএম রিসোর্সেস করা হয়। এই কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কয়লাখনি নিয়ে কোনো চুক্তি নেই। তবে বিভিন্ন সময়ে ফুলবাড়ী প্রকল্প নিয়ে তথ্য প্রকাশ করে লন্ডন শেয়ারবাজারে মূল্য প্রভাবিত করার অভিযোগ রয়েছে।
সর্বশেষ গত বছরের ১১ মার্চ জিসিএম রিসোর্সেস তাদের ওয়েবসাইটে ‘ফুলবাড়ী কোল মাইনিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ওভারবর্ডেন স্ট্রিপিং কনট্রাক্ট’ বিষয়ে একটি ঘোষণা দেয়। এজন্য চীনা কোম্পানি পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন চায়নার সঙ্গে চুক্তি করে জিসিএম। কোম্পানিটি ‘পাওয়ার চায়না’ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। এই চুক্তির মাধ্যমে পাওয়ার চায়না দিনাজপুরের আলোচিত ফুলবাড়ী কয়লাখনি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে উন্নয়ন করবে। পাশাপাশি সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াটের বেশি ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। বাংলাদেশে এখনো এশিয়া এনার্জি করপোরেশন নামেই সক্রিয় রয়েছে জিসিএমের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি।
অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তক্ষরণের মাধ্যমে ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনি বন্ধ করা হয়েছে। ওই সময় এখানে উন্মুক্ত হবে না, এমন অ্যাগ্রিমেন্ট হয়েছে। এখন অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের এই অ্যাগ্রিমেন্ট ভাঙলে তা হবে জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। তিনি বলেন, এই সরকারের উচিত জরুরি সংস্কার কাজ করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া। নির্বাচিত সরকার এসে ফুলবাড়ী নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
অর্থনীতিবিদ এবং তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সাবেক সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ কালবেলার সঙ্গে আলাপকালে এ বিষয়ে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হাসিনা সরকারের লুণ্ঠনমূলক প্রকল্পগুলো বাতিল করা। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো বাতিল করা। কিন্তু তা না করে ফুলবাড়ীতে পুনরায় উন্মুক্ত খনি করার উদ্যোগ নেওয়া জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা। তিনি বলেন, হাসিনা সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে ভুল করেছে। সেই ভুলের ওপর দাঁড়িয়ে কয়লার চাহিদা দেখিয়ে উন্মুক্ত খনি করা হবে আরেকটি ভুল। ফুলবাড়ী একটি মীমাংসিত বিষয়। এই মুহূর্তে সরকারের উচিত বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে যেসব তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হয়েছে, তা বাতিল করা। তার পরও সরকার যদি উন্মুক্ত খনি করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তা জনগণের প্রতিরোধের মুখে পড়বে।
বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এ বিষয়ে কালবেলাকে বলেন, এটা উদ্বেগের কথা। আমরা অবশ্যই বিরোধিতা করব। আমাদের অবস্থান দৃঢ়। কোনো পদ্ধতিতেই কয়লা উত্তোলনের পক্ষে নই আমরা। বরং কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, সারা বিশ্ব কয়লা থেকে সরে যাচ্ছে, আর বাংলাদেশ কয়লার ব্যবহার বাড়াচ্ছে। এতে করে পরিবেশ-প্রতিবেশ নষ্ট হওয়া শুরু করেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনি হবে না, এটা মীমাংসিত বিষয়। ওই সময় খালেদা-হাসিনা উভয়েই চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। ফলে এই মীমাংসিত বিষয় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নতুন করে কোনো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। তাহলে আবারও জনগণকে নিয়ে তা প্রতিহত করা হবে।
খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি বিএইচপি মিনারেলস দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে কয়লা খনি আবিষ্কার করে। এখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে চেয়েছিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি এশিয়া এনার্জি। ২০০৬ সালে আন্দোলনের মুখে সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে সরকার। এখানে মজুতের পরিমাণ ৫৭ কোটি টন। উত্তোলনযোগ্য মজুত ৪৭ কোটি টন।
ফুলবাড়ী খনি এলাকায় কৃষিজমি ৪১৬২ হেক্টর, বনভূমি ১৯৫ হেক্টর, জলাভূমি ৮১ হেক্টর, আর বসতি ৬৬৬ হেক্টর। এতে শস্য উৎপাদন হয় বছরে হেক্টরপ্রতি ধান ৩ থেকে ৪.৫ টন, আলু ২০ থেকে ২৩ টন, গম ৩ থেকে ৩.৫ টন, ভুট্টা ১০ টন, আর ডাল প্রায় ১ টন। সূত্রমতে, খনির জন্য ফুলবাড়ীতে একবারে ভূমি লাগবে ২ হাজার হেক্টর। খনি এলাকার আয়তন হবে ৫৪.৮ বর্গকিলোমিটার। সেখানকার ৪৬ হাজার ৫০০ মানুষকে পুনর্বাসন করতে ১০ থেকে ১২ বছর লাগবে। তাতে ব্যয় হবে ১ বিলিয়ন ডলার।