অমর একুশে বইমেলা ২০২৫ শেষ হতে বাকি আর মাত্র দুই দিন। মাসব্যাপী এই মেলা বাঙালির সংস্কৃতি, ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম প্রধান উৎসব হলেও এবারের মেলা প্রকাশকদের জন্য আশানুরূপ সুখবর বয়ে আনতে পারেনি। প্রথম দিন থেকেই মেলায় উপচে পড়া ভিড় ছিল, স্টলগুলোতে ছিল পাঠকদের আনাগোনা; কিন্তু সেই ভিড় বই কেনায় খুব একটা পরিণত হয়নি।
প্রকাশকদের আশা ছিল, এত মানুষের সমাগমের ফলে বিক্রি ভালো হবে; কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটা। বই বিক্রির হার কমে যাওয়ায় অনেক প্রকাশকই হতাশ। তাদের দাবি, গত বছরের তুলনায় এবারের বিক্রি অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। তারা বলছেন, বইপ্রেমীদের আনাগোনা আগের মতো থাকলেও কেনার আগ্রহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ফলে মেলার শেষ প্রান্তে এসেও বিক্রির লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেননি অনেক প্রকাশক।
লেখক প্লাবন রায় কালবেলাকে বলেন, এবারের বইমেলায় প্রচুর মানুষ এসেছে, স্টলে ভিড় লেগেই আছে; কিন্তু বই কেনার হার আশানুরূপ নয়। আমি দেখেছি, পাঠকরা স্টল ঘুরছেন, বই দেখছেন, ছবি তুলছেন, তবে অনেকেই শেষ পর্যন্ত কেনার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। অর্থনৈতিক মন্দা এর একটা কারণ হতে পারে, আবার ডিজিটাল মাধ্যমে বইয়ের সহজলভ্যতাও হয়তো ভূমিকা রাখছে। আগের বছরগুলোতে যেখানে পাঠকরা একাধিক বই কিনতেন, এবার তাদের অনেকেই একটি বা দুটি বই নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকছেন। লেখক হিসেবে আমরা চাই, পাঠকের হাতে বই পৌঁছাক; কিন্তু এই পরিস্থিতি আমাদের জন্য হতাশাজনক।
প্রকাশক শাকিল আহমেদ বলেন, মেলায় মানুষের ভিড় যথেষ্ট; কিন্তু বই কেনার আগ্রহ তুলনামূলকভাবে কম। স্টলে পাঠক আসছেন, বই দেখছেন, লেখকদের সঙ্গে কথা বলছেন, ছবি তুলছেন—কিন্তু কেনার সিদ্ধান্ত নিতে অনেকেই দেরি করছেন বা শেষ পর্যন্ত কিনছেন না। আগে যেখানে পাঠকরা একাধিক বই কিনতেন, এবার অনেকেই শুধু ঘুরে দেখেই চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, শেষ দিকে ছাড় পাওয়া যাবে, তাই অপেক্ষা করছেন। তবে যদি সবাই শুধু দেখেই চলে যান, তাহলে বইমেলার আসল উদ্দেশ্যটাই হারিয়ে যাবে। মেলার শেষ দুই দিনে আমরা আশাবাদী, বইপ্রেমীরা কিছুটা হলেও সক্রিয় হবেন এবং বই কিনবেন। কারণ লেখক-প্রকাশকরা বছরের পর বছর পরিশ্রম করে বই প্রকাশ করেন, আর বইমেলা সেই পরিশ্রমের ফল পাঠকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার সবচেয়ে বড় সুযোগ।
পাঠক সমাবেশের প্রোডাকশন ম্যানেজার খোকন মিয়া বলেন, এবারের বইমেলায় তাদের বিক্রি গত বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। বিক্রি আগের মতো নেই, পরিস্থিতি খুব খারাপ। মূলত অর্থনৈতিক অস্থিরতা, চলমান রাজনৈতিক আন্দোলন ও বিভিন্ন কারণে এবারের মেলায় মানুষের উপস্থিতি কমেছে। যারা আসছেন, তারা বেশিরভাগই শুধু ছবি তোলা কিংবা ঘুরে দেখতে আসছেন।
তিনি আরও বলেন, গত বছরের শেষ সময়ে ক্রেতারা এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে, তাদের হাত থেকে সময় বের করার সুযোগ ছিল না; কিন্তু এবার অবস্থা পুরোপুরি ভিন্ন। এখন মেলায় আসা মানুষদের বেশিরভাগই বসে সময় কাটাচ্ছেন, কেননা বিক্রি অনেক কমে গেছে। বইমেলার আগের সেই উৎসাহ ও গতি এখন প্রায় নেই। ক্রেতাদের অভাব আর আয়োজকদের জন্য এটি বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গতকালও বইমেলার অনেক স্টল ঘুরে দেখা যায় ক্রেতাশূন্য আর বিক্রেতারা নিজেদের মধ্যে গল্প করছেন। তারা বলছেন, মেলার শেষ দিকে এসে এবারের ভিড় অনেকটাই কমে গেছে। বিক্রিও গত বছরের তুলনায় অনেক কম।
বিক্রেতারা মন্তব্য করছেন, গত বছর এই সময়ে অনেক বেশি মানুষ আসতেন; কিন্তু এবার পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। অধিকাংশ স্টলেই ক্রেতার উপস্থিতি নেই, আর যেসব স্টলে কিছু মানুষ আসছেন, তাদের আগ্রহ তেমন নেই। এ ছাড়া, বই কেনার প্রতি আগ্রহও অনেক কমেছে, অনেকেই এখন মেলায় ঘুরতে বা ছবি তুলতে আসছেন; কিন্তু বই কেনার উদ্দেশ্যে আসছেন না।
গতকাল মেলায় নতুন বই এসেছে ১৬৬টি। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘জুলাই প্রজন্ম ও প্রযুক্তি: নতুন সামাজিক বন্দোবস্তের খোঁজে’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সামিনা লুৎফা নিত্রা। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কল্লোল মোস্তফা এবং এহসান মাহমুদ। সভাপতিত্ব করেন ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন কবি শ্যামল জাকারিয়া, মানব সুরত, এ বি এম সোহেল রশীদ, ইউসুফ রেজা, রোকন জহুর, জামিল জাহাঙ্গীর, ক্যামেলিয়া আহমেদ, আশিক আকবর, নুরতার পারভীন, জেসমিন বন্যা, সোহেল আমিন বাবু, রুহুল মাহবুব, মঈন মুরসালীন এবং শাহ সিদ্দিক। গতকাল ছিল মৌসুমী আক্তার সুমির পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘নৃত্যশৈলী’এবং মো. জাকির চিশতির পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘শান্তিধাম ভাবদর্শন চর্যাচর্চা কেন্দ্র’-এর পরিবেশনা।
সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী ইয়াসমিন মুশতারী, পুতুল দাস, এলবার্ট অনিমেষ দাস, শুক্লা ঘোষ, রুমী আজনবী, বিপুল কুমার, মৌমিতা হক সেঁজুতি, তমালিকা হালদার মলি, জান্নাতই ফেরদৌসী এবং দিপু সমদ্দার। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন কাজী মো. ইমতিয়াজ সুলতান (তবলা), গাজী আবদুল হাকিম (বাঁশি), রবিনস চৌধুরী (কী-বোর্ড), ফিরোজ খান (সেতার), বিশ্বজিৎ সেন (মন্দিরা)।
আজকের অনুষ্ঠান: আজ বৃহস্পতিবার মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘বাংলাদেশ বিনির্মাণ: রাষ্ট্র কাঠামো’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন রেজাউল করিম রনি। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন সৈয়দ নিজার। সভাপতিত্ব করবেন কাজী মারুফ।
মন্তব্য করুন