মাসুক আলতাফ চৌধুরী, কুমিল্লা
প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২৫, ০৮:৫৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কুমিল্লা

স্বকীয়তা হারিয়েছে শাহ সুজা মসজিদ

স্বকীয়তা হারিয়েছে শাহ সুজা মসজিদ

শত প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আজও কিছু পুরাকীর্তি কালের সাক্ষী হয়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। সেগুলোর মধ্যে কুমিল্লার শাহ সুজা মসজিদ অন্যতম। ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মহানগরীর গোমতী নদীর তীরে স্থাপিত হয় মসজিদটি।

প্রায় ৩৬৫ বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী এ মসজিদ। তবে কে, কবে নির্মাণ করেছেন, কিংবা নামকরণ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। তবে এটি যে উপমহাদেশের প্রাচীনতম মসজিদগুলোর একটি, সে বিষয়টি প্রমাণিত। গোমতীর কোল ঘেঁষে কুমিল্লা শহরের মোগলটুলীতে এ মসজিদ তৈরি করা হয়। অবশ্য বর্তমানে চর পড়ে নদীটি প্রায় এক কিলোমিটার দূরে চলে গেছে। আয়তনের দিক দিয়ে বেশি বড় না হলেও মসজিদের সার্বিক অবয়ব মোগল আভিজাত্যের প্রতীক বহন করে। বাহ্যিক কারুকার্য বহন করে স্রষ্টার প্রতি প্রতিষ্ঠাতাদের সুবিশাল আনুগত্য এবং তাদের রুচির পরিচয়। মোগল ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের প্রতীক এই মোগলটুলী শাহ সুজা মসজিদ প্রতিষ্ঠার প্রকৃত সন-তারিখ কোথাও উল্লেখ নেই। তবে জনশ্রুতি রয়েছে, ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি নির্মিত হয়।

শাহ সুজা মসজিদের কেন্দ্রীয় গম্বুজটি পাশের দুটির থেকে বড়। সম্প্রতি মসজিদের দুই প্রান্তে ২২ ফুট করে দুটি কক্ষ এবং সামনে ২৪ ফুট প্রশস্ত একটি বারান্দা নির্মাণ করায় আদি রূপের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। মসজিদের উত্তর-পূর্ব কোণে একটি সুউচ্চ মিনারও নির্মাণ করা হয়েছে।

নামকরণ দেখে ধারণা করা হয়, শাহ সুজা যখন বাংলার সুবেদার তখন এ মসজিদটি নির্মিত হতে পারে। কিন্তু তিনি নিজে এ মসজিদ নির্মাণ করেছেন বলে কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই।

ধারণা করা হয়, কুমিল্লায় মোগল ঘাঁটির মুসলমান অধিবাসীদের নামাজ পড়ার সুবিধার জন্য তৎকালীন মোগল ফৌজদার এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। পরে সুবেদার শাহ সুজার নামে নামকরণ করা হয়েছিল।

প্রথমদিকে মসজিদটি উত্তর দক্ষিণে লম্বা। চার কোণে চারটি মিনার ছিল। সেগুলো মসজিদের ছাদের অনেক ওপরে উঠে গেছে। সামনের দেয়ালে ছিল তিনটি দরজা এবং ভেতরে পশ্চিম দেয়ালে ছিল তিনটি মেহরাব। কেন্দ্রীয় প্রবেশপথ ও মেহরাব অন্য দুটির চেয়ে অনেক বড়। কেন্দ্রীয় দরজাটির বাইরের দিকে কিছুটা প্রসারিত এবং দুপাশে আছে দুটি সরু গোলাকার মিনার। মসজিদের সম্মুখ ভাগে প্যানেল দ্বারা সুশোভিত ছিল। কার্নিশের ওপরে ছিল ব্যাটলম্যান্ট, তার ওপরে গম্বুজ।

জনশ্রুতি রয়েছে, সুবেদার শাহ সুজা ত্রিপুরা জয়ের পর সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে মসজিদটি নির্মাণ করেন। আবার, মহারাজ গোবিন্দ মাণিক্য সুজার নাম চিরস্মরণীয় করার জন্য নিমচা তরবারি ও হিরকাঙ্গুরীয়ের বিনিময়ে বহু অর্থ ব্যয় করে এই মসজিদ নির্মাণ করেন।

গত শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে এটির আকর্ষণ ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। কারণ দফায় দফায় সংস্কার ও সম্প্রসারণের নামে আধুনিক উপকরণে হারিয়ে গেছে মোগল ঐতিহ্যের বহু চিহ্ন। এখন আর পর্যটকরা ক্যামেরাবন্দি করতে পারেন না খিলানরাজির মনোরম বহির্দৃশ্য। অন্যদিকে মসজিদের দক্ষিণের উন্মুক্ত অংশটিতে আম-কাঁঠালের বাগান করে প্রায় পুরো মসজিদটিই আড়াল করে ফেলা হয়েছে।

ঐতিহাসিক স্থাপনাটির ঐতিহ্য বিলুপ্তির শুরু ধরা যেতে পারে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকে। মসজিদের দক্ষিণ পার্শ্বে গ্রামবাংলার কুঁড়েঘর আকৃতির একটি সুউচ্চ খিলান পথ ছিল, যা পরবর্তীকালে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। এই খিলান পথটির অনুরূপ উত্তর দিকে অপেক্ষাকৃত অনুউচ্চ একটি খিলাপ পথ ছিল, যা সামনের ছাদ নির্মাণের সময় নব্বইয়ের দশকের প্রথমভাগে নষ্ট হয়ে হয়। পরবর্তী সময় আদি মসজিদসহ পুরো মসজিদের মেঝে উৎপাটন করে মোজাইক করা হয়। মসজিদ প্রাচীরের নিম্নাংশের চুনসুরকির পলেস্তারা খসিয়ে আধুনিক মার্বেল পাথর বসানো হয়। তা ছাড়া পাথর বসানোর সময় গম্বুজ তিনটির ভারসাম্য রক্ষাকারী খিলানের নিম্নাংশ ছেঁটে দেওয়ায় মসজিদের স্থায়িত্ব হ্রাস পেয়েছে।

মসজিদটির প্রতিবারের সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যতবারই ধনাঢ্য ব্যক্তিরা অর্থ নিয়ে এসেছে মসজিদ সংস্কারের জন্য ততবারই মসজিদটি ঐতিহ্য হারিয়েছে। যেন অর্থই ঐতিহ্য হারানোর মূল কারণ। যদিও তাদের উদ্দেশ্য মহৎ ছিল; কিন্তু পরিকল্পিত ছিল না।

দুই জাতির বন্ধুত্বের স্মারকও বলা হয় শাহ সুজা মসজিদকে। মোগল স্থাপত্যকলার মডেল বা আদর্শ হিসেবে কয়েক দশক আগেও দেশি-বিদেশি পর্যটক, ইতিহাসবিদ, ইতিহাসের ছাত্র-শিক্ষক ও সাংবাদিকদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল। বর্তমানে স্বকীয়তা হারানোয় মূল সৌন্দর্যেও ভাটা পড়েছে।

সংস্কারের নামে যুগে যুগে মসজিদটি যা হারিয়েছি তা হয়তো কোনো কিছুর বিনিময়ে ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। তবে এখনো সব শেষ হয়ে যায়নি। এখনো কিছু হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাওয়া সম্ভব সুষ্ঠু সংস্কারের মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শে করতে হবে। না হলে বাকি ঐতিহ্যটুকুও হারিয়ে যাবে অচিরেই।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কবি নজরুল ছিলেন মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত : ডা. ইরান

শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু মঞ্চ ও পোশাক কর্মশালা

এবার চতুর্থ সারির ক্লাবের কাছে হেরে ম্যানইউর বিদায়

ড. মাসুদের প্রচেষ্টায় দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেলো ৩ ইউনিয়নের মানুষ

বিশ্বকাপ দলে সুযোগ না পেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশ স্পিনার

রুমিন ফারহানার দুঃখ প্রকাশ

বৃহস্পতিবার প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা

ভারতে নিষিদ্ধ অনলাইন জুয়া, বড় ধাক্কায় আইপিএল ও ভারতীয় ক্রিকেট

পদক্ষেপ নিলে মনে হয় দেশেই থাকা হবে না : ডিসি মাসুদ

রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সভা

১০

ডিআরইউতে মঞ্চ ৭১–এর কর্মসূচি প্রত্যাহারের দাবি

১১

জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব অপরিহার্য: উপদেষ্টা

১২

কনভেনশন হলে গেরিলা বৈঠকে গ্রেপ্তার শিমুল ৪ দিনের রিমান্ডে

১৩

শাহবাগে এসে ডিএমপি কমিশনারের ‘দুঃখ প্রকাশ’

১৪

ইনকিলাব সম্পাদককে লিগ্যাল নোটিশ পাঠাল ছাত্রশিবির

১৫

বিএনপি নেতাকে কোপাল যুবলীগ নেতা

১৬

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী হাটহাজারী বিমানবন্দর

১৭

ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে রুয়েট শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

১৮

ডাকসু নির্বাচন / ১৩২ শিক্ষার্থীকে খাওয়ালেন প্রার্থী, রিটার্নিং কর্মকর্তা বললেন আচরণবিধি লঙ্ঘন

১৯

সাদাপাথর লুটপাট নিয়ে সিলেটে গণশুনানি

২০
X