‘রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন/ ব্যক্ত হোক জীবনের জয়/ ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়/…মোর চিত্তমাঝে/ চিরনূতনেরে দিল ডাক/ পঁচিশে বৈশাখ’—এমনই বাণীর মধ্য দিয়ে চির-নতুনের প্রতি নিজের জন্মক্ষণটিকে উৎসর্গ করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার আবির্ভাব এ তল্লাটে যেন চির দীপ্তিমান রবিরই আবির্ভাবের মতন। যিনি তার জীবনব্যাপী কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে হয়ে উঠেছেন বাঙালি তথা বিশ্বমানবের অতুলনীয় প্রেরণা। বাঙালির চেতনা বিকাশ ও আত্মিক মুক্তির প্রতীক তিনি। আজ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বহুমাত্রিক উৎকর্ষের মহানায়ক বরেণ্য এই বাঙালির ১৬৪তম জন্মজয়ন্তী। আজ ২৫ বৈশাখ। মহাকালের বিস্তীর্ণ পটভূমিতে এক ব্যতিক্রমী রবির কিরণে উজ্জ্বল এই পঁচিশে বৈশাখ।
আবহমানকালের বাংলার ভাষা ও সাহিত্যকে উনিশ শতকে এসে রবীন্দ্রনাথ একাই পৌঁছে দিয়েছেন বিকাশের চূড়ান্ত সোপানে। ১৯১৩ সালে তিনি নিয়ে আসেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার, যা কি না যে কোনো ক্ষেত্রে এ মহাদেশের প্রথম। শুধু সাহিত্যই নয়, রবীন্দ্রনাথ নিজ গুণের অমিয়ধারায় আধুনিকতার ধারণা দিয়ে উর্বর করেছেন ভারতীয় চিত্রকলাকেও। বাণী ও সুরের গভীরতম সমন্বয়ে উদ্ভাসিত করেছেন সংগীতকে।
নোবেল পুরস্কারের অর্থ দিয়ে তিনি এ দেশে দরিদ্র কৃষকদের ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন কৃষি ব্যাংক। শিক্ষা ও প্রতিভা বিকাশের মানবিক ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তোলেন শান্তিনিকেতন। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে নেমে এসেছেন পথে। পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশ সরকারের ‘নাইটহুড’ উপাধি ত্যাগ করেন। এভাবে বারবার সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্মতার ঘোষণা দিয়েছেন সমাজসচেতন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী ও গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। বাঙালি সমাজে তার রচিত সংগীতের জনপ্রিয়তা এত বছর পরও তুলনাহীনভাবে বাড়ছে। তিনি দুই সহস্রাধিক গান রচনা করেন। অধিকাংশ গানে সুরারোপ করেন। কবির লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। ভারতের জাতীয় সংগীতটিও কবির লেখা।
রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদি ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তার রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শনচেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে; রবীন্দ্রনাথ দেববিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পূজার কথা বলেছিলেন। সংগীত ও নৃত্যকে তিনি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথের গান তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি।
বাংলা ১২৬৮ সনের ২৫ বৈশাখ (৭ মে ১৮৬১) কলকাতায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাতা সারদা সুন্দরী দেবী। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষরা খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী এই মানুষটি দীর্ঘ রোগভোগের পর বাংলা ১৩৪৮ সনের ২২ শ্রাবণ (ইংরেজি ৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈতৃক বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আজীবন মানবতার জয়গান গাওয়া কবি তার জীবিতাবস্থায় পালিত শেষ জন্মদিনে তৎকালীন অশান্ত পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে ‘সভ্যতার সংকট’ নামে যে রচনাটি লেখেন, সেখানেও তিনি সভ্যতার ক্রমবর্ধমান সংকট থেকে মুক্তির জন্য মানুষের প্রতি আশা রেখেছেন। বলেছেন, ‘আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি—পিছনের ঘাটে কী দেখে এলুম, কী রেখে এলুম, ইতিহাসের কী অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ! কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে।’ মানুষের সেই জয়যাত্রার অভিযানে কবি ব্যক্ত করেছেন, ‘ঐ মহামানব আসে।/ দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে’।
প্রতিবারের মতো বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী। জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে বিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার পতিসরে, কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ী, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর এবং খুলনার দক্ষিণডিহি ও পিঠাভোগে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হবে। এ উপলক্ষে রবীন্দ্রমেলা, রবীন্দ্রবিষয়ক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া দিবসটি উপলক্ষে সেমিনার, বিজয়ীদের রবীন্দ্র পুরস্কার ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বাংলা একাডেমি।
মন্তব্য করুন