কারিগরি শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের আধুনিক টেকনোলজিবিষয়ক প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর। এরই অংশ হিসেবে দক্ষতা বাড়াতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ পাঠাতে চায় অধিদপ্তরটি। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিদেশ প্রশিক্ষণে খরচ কমানোর নির্দেশনা দেয় পরিকল্পনা কমিশন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী, শিক্ষকদের সংখ্যা এবং মোট খরচ কমেছে, তবে জনপ্রতি ৭ লাখ টাকা করে খরচ বাড়ানোর সংশোধিত প্রস্তাব পাঠিয়েছে সংস্থাটি। অধিদপ্তরের ‘টিভিইটি টিচার্স ফর দ্য ফিউচার (টিটিএফ) প্রোগ্রাম’ শীর্ষক প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাবে এমন আবদার করা হয়েছে।
জানা গেছে, এ প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ২৩৫ জন শিক্ষককে বিদেশ পাঠানোর প্রস্তাব করা হয়েছিল। এজন্য খরচ ধরা হয়েছিল প্রায় ১৩৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বিদেশ প্রশিক্ষণ নিতে প্রত্যেকের পেছনে খরচ ধরা হয় ১১ লাখ টাকারও কম। সংশোধিত প্রস্তাবে বিদেশ প্রশিক্ষণে ৩৭৮ জনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ জন্য খরচ চাওয়া হয়েছে ৬৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। সেই হিসাবে বিদেশ প্রশিক্ষণে একেকজন শিক্ষকের পেছনে খরচ হবে ১৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা। অর্থাৎ মোট খরচ কমানো হলেও শিক্ষকপ্রতি গড়ে ৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা করে খরচ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে। এর আগে একই ধরনের একটি প্রকল্পে বিদেশ প্রশিক্ষণে প্রতিজনে খরচ করা হয়েছিল মাত্র ৬ লাখ ৪২ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে অধিদপ্তরটির সহকারী পরিচালক রেজওয়ানুল হক কালবেলাকে বলেন, আপনারা বিষয়টি যেভাবে দেখছেন তেমন নয়, অন্য প্রকল্পের সঙ্গে তুলনা করলে হবে না। এ প্রকল্পের আওতায় শিক্ষকদের আধুনিক ও নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে দক্ষ করতে বিদেশে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। পরবর্তী সময়ে দেশে ফিরে তারা অন্যদের প্রশিক্ষণ দেবেন।
প্রকল্পের প্রস্তাবনা সূত্রে জানা গেছে, শুধু বিদেশ ভ্রমণ নয়, আলোচ্য প্রকল্পের প্রায় সব খাতেই অত্যধিক ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। কারিগরি শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার দেবে ২০৯ কোটি আর এডিবি দেবে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। যদিও প্রথম প্রস্তাবে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা।
গত ডিসেম্বরে প্রকল্পের মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় প্রকল্পের নানা খাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় প্রস্তাবের আপত্তি জানিয়ে ফেরত পাঠায় পরিকল্পনা কমিশন। পিইসি সভার আপত্তিতে ৪৪৯ কোটি টাকা ব্যয় কমানো হয়েছে সংশোধিত প্রস্তাবে। কিন্তু কয়েকটি খাতে ব্যয় কিছুটা কমানো হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখনো অপ্রয়োজনীয় ও অত্যধিক ব্যয়ের প্রস্তাব রয়েছে। ব্যয়ের খাত পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১ লাখ ৩ হাজার ১০০ বর্গমিটার অনাবাসিক ভবন নির্মাণে ৭১১ কোটি ২৩ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি বর্গমিটারে ব্যয় পড়ছে ৬৮ হাজার ৯৮৫ টাকা। আর ৪০ হাজার ২১ বর্গমিটার আবাসিক ভবন নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ২৭০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এখানে প্রতি বর্গমিটারে খরচ পড়ছে ৬৭ হাজার ৫৭৪ টাকা, যা অন্যান্য প্রকল্পের চেয়ে অনেক বেশি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ ধরনের ভবন নির্মাণে সাধারণত বর্গমিটার প্রতি ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়। খুব বেশি হলেও ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার বেশি কোনোভাবে খরচ হওয়ার কথা নয়। এমনকি আগের প্রকল্পেও ভবন নির্মাণকাজে ২৩ থেকে ৩৩ হাজার টাকা খরচ করেছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর।
পরামর্শক খাতে অত্যধিক ব্যয়:
প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাবে পরামর্শক খাতে ১০০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে। যদিও প্রথম প্রস্তাবে পরামর্শক খাতে খরচ ধরা ছিল ১২৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, সেখান থেকে সরকারের খরচ ৫৫ কোটি টাকা বাদ দিতে বলেছিল পরিকল্পনা কমিশন। সেই হিসেবে সরকারের খরচ বাদ দিলে পরামর্শক ব্যয় হওয়ার কথা ছিল ৭১ কোটি ১০ লাখ টাকা। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শোয়াইব আহমাদ খান বলেন, এ প্রকল্পের বিষয়ে ভালো জানা নেই। না জেনে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। আমি আসার আগেই প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে বিদেশ প্রশিক্ষণ বন্ধ রয়েছে। যদি কোনো অসংগতি থাকে, তাহলে অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ বিষয়টি দেখবে। প্রস্তাব করলেই তো অনুমোদন হয়ে যাচ্ছে না।
আবারও ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত:
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিকল্পনা কমিশনের পিইস সভায় যে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছিল সংশোধিত প্রস্তাবে সেগুলোর প্রতিফলন ঘটেনি। এ কারণে আবারও প্রকল্প প্রস্তাবটি ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. আব্দুর রউফ বলেন, পিইসি সভায় ব্যয় কমানোসহ বেশকিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে প্রকল্প ফেরত পাঠানো হয়েছিল। সেই অনুযায়ী তারা প্রস্তাবনা সংশোধন করে পাঠায়। কিন্তু পিইসি সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের সংশোধিত প্রস্তাবে অসংগতি রয়েছে। এ কারণে বিভিন্ন খাতের ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণের জন্য আবারও ফেরত পাঠানো হবে। অযৌক্তিক কোনো প্রস্তাব অনুমোদনের সুযোগ নেই।
আগের প্রকল্পের যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত থাকলেও নতুন করে প্রায় ৫০০ কোটির যন্ত্রপাতি:
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর আগেও একই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর। ১ হাজার ৭২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘স্কিলস অ্যান্ড ট্রেনিং এনহান্সমেন্ট প্রজক্ট’ শীর্ষক প্রকল্পটি শেষ হয় ২০১৯ সালে। ওই প্রকল্পে শিক্ষকদের দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কাজ করা হয়েছিল। কিন্তু যথাযথভাবে ফিজিবিলি স্টাডি না করার কারণে প্রকল্পটি খুব বেশি কার্যকর হয়নি। এমনকি জনবলের অভাবে আগের প্রকল্পে কেনা ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মেশিনসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত রয়েছে, নিম্নমানের হওয়ায় অনেকই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সমাপ্ত মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এসব তথ্য ওঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় কেনা ডেস্কটপ এবং ল্যাপটপ কম্পিউটার, প্রিন্টার, স্ক্যানার, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ফার্নিচার, এসি ও বিভিন্ন টেকনোলোজির ল্যাবের যন্ত্রপাতি অরক্ষিত এবং অব্যবহৃত রয়েছে। দক্ষ জনবলের অভাবে এগুলোর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা, নিম্নমানের সামগ্রী কেনায় ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের আগেই অধিকাংশ নষ্ট হয়েছে।
মন্তব্য করুন