জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার বাইগুনি গ্রামে নিজের আধা-নির্মিত ইটের বাড়ির সামনে বসে আছেন ৪৫ বছর বয়সী সফিরুদ্দিন। পেটের ডান পাশে হালকা চাপ দিলে এখনো তীব্র ব্যথা অনুভব করেন তিনি। সেই অস্ত্রোপচারের চিহ্ন আজও শরীরে বহন করছেন সফিরুদ্দিন।
শুক্রবার (০৪ জুলাই) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এই বিশেষ রিপোর্টটি করেছেন জয়তী ঠাকুর, আমিনুল ইসলাম মিঠু ও হানান জাফর।
২০২৪ সালে পরিবারের অভাব দূর করতে এবং তিন সন্তানের জন্য একটি ঘর তৈরির আশায় সফিরুদ্দিন নিজের একটি কিডনি বিক্রি করেন ভারতের এক ব্যক্তির কাছে। বিনিময়ে তিনি পেয়েছিলেন সাড়ে তিন লাখ টাকা। তবে সেই অর্থ অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। বাড়ির নির্মাণকাজ থেমে আছে দীর্ঘদিন ধরে। আর প্রতিদিনের শরীরের যন্ত্রণা তাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়- সেই সিদ্ধান্ত কতটা ভয়ংকর ছিল।
বর্তমানে জয়পুরহাটের একটি হিমাগারে দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন সফিরুদ্দিন। অস্ত্রোপচারের পর দুর্বল হয়ে পড়া শরীর নিয়ে প্রতিদিনের পরিশ্রম এখন তার জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, ‘আমি সব করেছি আমার স্ত্রী আর সন্তানদের জন্য।’
শুরুতে ভয় থাকলেও, দালালদের আশ্বাসে ধীরে ধীরে রাজি হয়ে যান তিনি। পাসপোর্ট, ভিসা, বিমানযাত্রা থেকে শুরু করে হাসপাতালের যাবতীয় কাগজপত্র- সবই প্রস্তুত করে দেয় দালালচক্র। যদিও সফিরুদ্দিন মেডিকেল ভিসায় ভারতে যান, হাসপাতালের কাগজপত্রে তাকে দেখানো হয় ‘রোগীর আত্মীয়’ হিসেবে। এমনকি তার জন্য জাল পরিচয়পত্র, ভুয়া জন্মনিবন্ধন ও নোটারি সনদপত্রও তৈরি করা হয়। আর যার শরীরে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, সেই ব্যক্তির পরিচয় আজও অজানা সফিরুদ্দিনের কাছে।
ভারতের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, কিডনি প্রতিস্থাপন শুধু নিকটাত্মীয়দের মধ্যেই অনুমোদিত। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদন থাকলে আত্মীয় নন এমন যে কেউ কিডনি দান করতে পারেন। কিন্তু এই আইনি প্রক্রিয়াকে ফাঁকি দিয়ে দালালচক্র ভুয়া পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি করে কিডনি প্রতিস্থাপনের পথ সুগম করে। কখনো কখনো তৈরি করা হয় ভুয়া ডিএনএ রিপোর্টও।
এ বিষয়ে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অঙ্গসংগঠন ‘অর্গান ট্রান্সপ্লানটেশন টাস্কফোর্স’-এর সদস্য ড. মনিরুজ্জামান বলেন, এই প্রতারণার পদ্ধতিগুলো প্রায় একই রকম। নাম পরিবর্তন, ভুয়া নোটারি সনদ, আত্মীয় হিসেবে প্রমাণের জন্য জাল জাতীয় পরিচয়পত্র ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
কালাই উপজেলার বাইগুনি গ্রামে সফিরুদ্দিনের গল্পটি আলাদা কিছু নয়। প্রায় ছয় হাজার মানুষের এই গ্রামে এত বেশি সংখ্যক মানুষ কিডনি বিক্রি করেছেন যে, স্থানীয়ভাবে জায়গাটি পরিচিত হয়ে উঠেছে ‘এক কিডনির গ্রাম’ নামে।
২০২৩ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল গ্লোবাল হেলথ-এ প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, কালাই উপজেলায় প্রতি ৩৫ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন কিডনি বিক্রি করেছেন। অধিকাংশ বিক্রেতাই ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী পুরুষ, যারা চরম দারিদ্র্যের মুখে পড়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কেউ ঋণের চাপে, কেউবা মাদকাসক্তি কিংবা জুয়ায় আসক্তির কারণেও এ পথ বেছে নিয়েছেন।
সফিরুদ্দিন জানান, অপারেশনের পর দালালরা তার পাসপোর্ট, প্রেসক্রিপশনসহ কোনো কাগজপত্রই ফিরিয়ে দেয়নি। প্রয়োজনীয় ওষুধও জোটেনি তার। অস্ত্রোপচারের পরপরই কোনো চিকিৎসা বা পর্যবেক্ষণ ছাড়াই তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অনেক সময় দালালরা বিক্রেতাদের কাগজপত্র কেড়ে নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো প্রমাণ রাখে না- যাতে ভবিষ্যতে তারা চিকিৎসা দাবি কিংবা আইনি অভিযোগ তুলতে না পারেন।
এই অঙ্গগুলো মূলত বিক্রি হয় ভারতের ধনী কিডনি রোগীদের কাছে- যারা বৈধ প্রক্রিয়ায় প্রতিস্থাপনের দীর্ঘ অপেক্ষা এড়িয়ে দ্রুত সমাধান খুঁজে নিতে চান। ভারতে ২০২৩ সালে মাত্র ১৩ হাজার ৬০০টি কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে, অথচ প্রতি বছর দেশটিতে প্রায় দুই লাখ মানুষ চূড়ান্ত পর্যায়ের কিডনি রোগে আক্রান্ত হন। এই চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধানই গোপন বাজার এবং দালালচক্রকে আরও সক্রিয় করে তুলেছে।
ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, ‘কিছু মানুষ জানাশোনা সত্ত্বেও কিডনি বিক্রি করেন, তবে অনেকেই প্রতারিত হন।’
অনেক সময় কিডনি বিক্রির অর্থও পুরোপুরি হাতে পান না বিক্রেতারা। যেমন মোহাম্মদ সাজল (ছদ্মনাম), যিনি ২০২২ সালে দিল্লির ভেঙ্কটেশ্বর হাসপাতালে ১০ লাখ টাকার চুক্তিতে নিজের কিডনি বিক্রি করেন। তবে প্রতিশ্রুত অর্থের বদলে তিনি পান মাত্র সাড়ে তিন লাখ টাকা। প্রতারিত হয়ে হতাশ সাজল শেষ পর্যন্ত সেই দালালচক্রের সঙ্গেই জড়িয়ে পড়েন- বাংলাদেশ থেকে কিডনি বিক্রেতা খুঁজে বের করে তাদের ভারতে পাঠাতে থাকেন।
তবে টাকার ভাগাভাগি নিয়ে দালালদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে কিছুদিন পর তিনি চক্রটি থেকে সরে আসেন। এখন ঢাকায় রাইড শেয়ারিং ড্রাইভার হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। কিন্তু অতীতের সেই প্রতারণা ও অনুশোচনার অভিজ্ঞতা আজও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
অন্যদিকে, যেসব হাসপাতাল এই অবৈধ কিডনি প্রতিস্থাপনের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে এখনো ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনো সমন্বিত তথ্য আদান-প্রদানের ব্যবস্থা নেই। এমনটা জানিয়েছেন ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনসুলার বিভাগের মহাপরিচালক শাহ মুহাম্মদ তানভির মনসুর। তার মতে, অনেক সময় ভারতের হাসপাতালগুলো দায় এড়িয়ে এমন যুক্তি দেখায় যে, তারা প্রাপ্ত কাগজপত্র যাচাই করেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।
তবে ড. মনিরুজ্জামান বলেন, ভারতের অনেক হাসপাতালই জেনে-বুঝেই জাল কাগজ গ্রহণ করে। কারণ ‘অধিক কিডনি প্রতিস্থাপন মানে অধিক আয়’। ভারতের হাসপাতালগুলো বছরে কয়েক হাজার বিদেশি রোগীকে চিকিৎসা দেয়, যা দেশটির ৭.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মেডিকেল ট্যুরিজম শিল্পের অংশ।
২০১৯ সালে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিডনি পাচার চক্র নিয়ে তদন্ত শুরু করলে কিছু চিকিৎসক ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০২৪ সালে দিল্লিতে গ্রেপ্তার হন ড. বিজয়া রাজাকুমারি- যিনি ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে অন্তত ১৫ বাংলাদেশির কিডনি প্রতিস্থাপন করেছিলেন। তবে, এসব তদন্ত ও আইনি পদক্ষেপ ছিল বিচ্ছিন্ন ও খণ্ডিত। ফলে পুরো ব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত কোনো পরিবর্তন আসেনি। দালালচক্র ও অসাধু হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে সমন্বিত, কঠোর ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের অভাবে এই অবৈধ বাণিজ্য এখনো অব্যাহত রয়েছে।
দালাল মিজানুর রহমানের ভাষ্য অনুযায়ী, একটি কিডনি প্রতিস্থাপনে মোট খরচ পড়ে প্রায় ২৫ থেকে ৩৫ লাখ টাকা। কিন্তু কিডনি বিক্রেতারা এর মধ্যে মাত্র ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা হাতে পান। বাকি অর্থ ভাগ হয়ে যায় দালাল, ভুয়া কাগজপত্র তৈরিতে জড়িত কর্মকর্তারা, কিছু অসাধু চিকিৎসক এবং হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে।
তিনি জানান, অনেক সময় সরাসরি কিডনি বিক্রির কথা না বলে ‘ভালো কাজের’ প্রলোভন দেখিয়ে মানুষকে এই চক্রে ফাঁসানো হয়। কেউ কেউ কাজের সন্ধানে ভারতে গিয়ে অপারেশনের শিকার হন, এরপর আর কোনো সহায়তা না পেয়ে সেখানেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকেন।
ভারতের কিডনি ওয়ারিয়র্স ফাউন্ডেশনের প্রধান বাসুন্ধরা রঘুবংশ বলেন, আইন থাকলেও বাস্তবে এটি একটি কালোবাজারে পরিণত হয়েছে। যেহেতু কিডনির চাহিদা অব্যাহত রয়েছে, সেহেতু এই ব্যবসাও থেমে নেই। তিনি মনে করেন, অঙ্গ দানের সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা সম্ভব না হলে, একটি সুশৃঙ্খল ও মানবিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। যেখানে কিডনি বিক্রেতাদের জন্য বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, অস্ত্রোপচারের পর দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা সুবিধা এবং আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
বাইগুনি গ্রামে সফিরুদ্দিন এখনো অর্ধনির্মিত বাড়ির বারান্দায় বসে ভাবেন, কবে তার সেই স্বপ্নের ঘর পূর্ণ হবে। তিনি ভেবেছিলেন, এই পথ হয়তো পরিবারের জন্য একটুখানি স্বস্তি বয়ে আনবে। কিন্তু আজ তিনি একাকী, অসুস্থ এক পিতা, যার পাশে থাকার কেউ নেই। কণ্ঠে শুধু একটাই তিক্ততা- ‘তারা আমার কিডনি নিয়েছে, আর আমাকে ফেলে চলে গেছে।’
মন্তব্য করুন