২০১৯ সালের শুরুতে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জন্য দুটি রেডিওথেরাপি যন্ত্র ক্রয়ের উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি)। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে নিষিদ্ধ ও মারাত্মক ক্ষতিকর বিবেচিত কোবাল্ট-৬০ মডেলের দুটি যন্ত্র সংগ্রহে দেওয়া হয় ৩২ কোটি ৫০ লাখ টাকার কার্যাদেশ। অথচ অত্যাধুনিক ও তুলনামূলক নিরাপদ প্রযুক্তি লিনিয়ার এক্সিলারেটর না নিয়ে এমন একটি পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রযুক্তির যন্ত্র কেনা হয়, যার কার্যকারিতা নিয়েও চিকিৎসা মহলে প্রশ্ন রয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবরের মধ্যে যন্ত্রগুলো প্রস্তুত ও প্রি শিপমেন্ট ইন্সপেকশন (পিএসআই) শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ছয় বছর পরও সেই যন্ত্রগুলোর দেখা মেলেনি। বরং ২০২৫ সালের ১৪ জানুয়ারি কানাডাভিত্তিক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বেস্ট থেরাট্রোনিক্স আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, তারা যন্ত্র দুটি সরবরাহে অক্ষম। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর)-২০০৮-এর ৪২ ধারা অনুযায়ী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেনি। বরং আইনি বাধ্যবাধকতা উপেক্ষা করে সিএমএসডি প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন করে তিন সপ্তাহ সময় দিয়েছে যন্ত্র সরবরাহের জন্য।
সিএমএসডি সূত্রে জানা গেছে, বেস্ট থেরাট্রোনিক্সের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিতে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের কিছু অসাধু কর্মকর্তা সরাসরি জড়িত। তারা বিভিন্নভাবে প্রভাব খাটিয়ে পারফরম্যান্স সিকিউরিটি বাজেয়াপ্ত হওয়া ঠেকাচ্ছে। এতে শুধু সরকারি অর্থই ঝুঁকিতে পড়েনি, রেডিওথেরাপির জরুরি যন্ত্রের অভাবে দেশের ক্যান্সার রোগীরা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোল্লা ওবায়েদুল্লাহ বাকী বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। তবে আমার মনে হয়, সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশ রয়েছে। নয়তো এ ধরনের অনিয়ম হওয়ার কথা নয়।’ তার এই মন্তব্যই পুরো প্রক্রিয়ার পেছনে জটিল সিন্ডিকেট বা প্রভাবশালী চক্রের সক্রিয় ভূমিকার ইঙ্গিত দেয়।
ঝুঁকিপূর্ণ প্রযুক্তির পেছনে বিপুল বিনিয়োগ: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির তথ্যানুসারে, কোবাল্ট-৬০ থেকে নির্গত গামা রশ্মি অত্যন্ত ক্ষতিকারক। এই যন্ত্রের সোর্স নির্দিষ্ট সময় পরপর পরিবর্তন করতে হয়, যার প্রতিটির মূল্য প্রায় আড়াই কোটি টাকা। বিকিরণের ফলে রোগীর শরীরে ক্ষত, পুড়ে যাওয়া এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকি পর্যন্ত তৈরি হয়।
তবু কেন আধুনিক লিনিয়ার এক্সিলারেটরের পরিবর্তে কোবাল্ট-৬০ কেনা হলো—এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যন্ত্রগুলোর কার্যকারিতা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ, তেমনি রক্ষণাবেক্ষণ খরচও অত্যধিক। রেডিয়েশন অনকোলজিস্টরা একবাক্যে স্বীকার করছেন, সুনির্দিষ্টভাবে শরীরের যে কোনো স্থানে ক্যান্সার চিকিৎসায় লিনিয়ার এক্সিলারেটরের বিকল্প নেই। কোবাল্ট-৬০-এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও গুরুতর।
২০১৯ সালের ২৭ জুন দুটি কোবাল্ট-৬০ যন্ত্র কেনার জন্য পৃথক দুটি কার্যাদেশ দেওয়া হয় বেস্ট থেরাট্রোনিক্সকে। প্রতিষ্ঠানটি ৩০ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যাদেশ গ্রহণ করে এবং পৃথক পারফরম্যান্স সিকিউরিটিও জমা দেয়। সব নিয়ম মেনেই চুক্তি সম্পন্ন হয়। কিন্তু এর পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি একাধিকবার চিঠি পেয়েও জবাব দেয়নি।
২০২০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সিএমএসডি চূড়ান্তভাবে আবার পিএসআই ও শিপমেন্টের জন্য চাপ দিলেও বেস্ট থেরাট্রোনিক্স ছিল নীরব। অবশেষে ২০২৪ সালের ২২ অক্টোবর এবং ২০২৫ সালের ১৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটি যন্ত্র সরবরাহে অক্ষমতা স্বীকার করে।
তবু কেন প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়নি—এ বিষয়ে সিএমএসডির উপপরিচালক (পিঅ্যান্ডসি) ডা. কে এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমরা দেখেছি, কোনোভাবেই কালো তালিকাভুক্তির পর্যায়ে পড়ে না। এটা তো আন্তর্জাতিক কোম্পানি। মামলার পর যদি আমরা টিকতে না পারি, যদি কোনো ক্লোজারে আটকে যাই, তাহলে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে।’
তার এই বক্তব্য অনেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। একজন দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তা কীভাবে চুক্তিভঙ্গের পরও শুধু ভাবমূর্তির আশঙ্কায় প্রতিষ্ঠানকে ছাড় দিতে পারেন, তা নিয়েই সমালোচনা তৈরি হয়েছে।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আরও ভয়ংকর তথ্য। বেস্ট থেরাট্রোনিক্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ‘সেরেনিটি লিমিটেড’, ‘নিউ টেক জিটি লিমিটেড’ ও ‘এমজিসি-মেডিগিয়ার করপোরেশন’ নামে নতুন তিনটি প্রতিষ্ঠান খুলে আবারও সরকারি প্রকল্পে অংশ নিতে তৎপর। এবার তাদের লক্ষ্য দেশের বিভাগীয় ৮টি ক্যান্সার প্রকল্প, যেখানে কোটি কোটি টাকার আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনা হবে।
রাষ্ট্রীয় ক্ষতির মাত্রা ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি: বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ ৫৫ হাজার মানুষ ক্যান্সার আক্রান্ত হন এবং মারা যান প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার। অথচ এই ছয় বছরে প্রয়োজনীয় রেডিওথেরাপি যন্ত্র না থাকায় হাজারো মানুষ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। রাষ্ট্র হারিয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্ভাব্য রাজস্ব এবং ব্যাহত হয়েছে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা।
চুক্তিভঙ্গের ছয় বছর পরও আইনগত কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ না নেওয়া আরেকবার প্রমাণ করে, বাংলাদেশে ‘উন্নয়ন প্রকল্প’ মানেই শুধু সংখ্যার খেলা নয়, বরং একটি শক্তিশালী স্বার্থান্বেষী চক্রের উপার্জনের ক্ষেত্র।
মন্তব্য করুন