দেশে বোরোর ফলন ভালো হয়েছে। পর্যাপ্ত চাল আমদানিও হয়েছে। তবুও কেন চালের দাম হুহু করে বাড়ছে, তা কোনোভাবেই বুঝতে পারছেন না ভোক্তারা। মোটা থেকে মাঝারি বা মাঝারি থেকে চিকন—সব ধরনের চালের দামই বাড়ছে। আর এই বাড়তি চাল কিনতে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে হাঁসফাঁস উঠছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের সংসারে। অন্যান্য নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের সঙ্গে চালের বাড়তি দাম যেন জীবনযুদ্ধে টিকে থাকা আরও কঠিন করে তুলেছে। আর এই বাড়তি দামের নেপথ্যে মজুতকারী ও করপোরেট সিন্ডিকেটকেই দুষছেন সংশ্লিষ্টরা।
গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা সৈয়দ আমিনুল ইসলাম এসেছিলেন সূত্রাপুর বাজারে। অন্যান্য নিত্যপণ্যের সঙ্গে পাঁচ কেজি পাইজাম চাল কিনেছেন তিনি। যখন দাম কমের দিকে ছিল তিনি মিনিকেট চাল কিনতেন। দাম বেড়ে যাওয়া পাইজাম চাল কেনা শুরু করেছেন। কিছুটা ক্ষোভ ও কিছুটা আক্ষেপ নিয়ে তিনি কালবেলাকে বলেন, পত্রপত্রিকায় খবর দেখি বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। বিদেশ থেকে চাল আমদানিও করা হচ্ছে। তার পরও কেন চালের দাম বাড়ছে?
সৈয়দ আমিনুলের মতোই একই সুরে কথা বললেন আরও বেশ কয়েকজন। তাদের সবার একই ক্ষোভ, একই আক্ষেপ। বোরোর ভরা মৌসুমের পাশাপাশি পর্যাপ্ত আমদানি এবং সরকারি মজুতে পর্যাপ্ত সংগ্রহ থাকার পরও কেন চালের দাম কমছে না—এটি বোধগম্য নয় কারোরই।
গত বছরের তুলনায় বেড়েছে সব চালের দাম
জানা গেছে, দেশে গত এক বছরে ১৩ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছে। আমদানির পাশাপাশি বোরোর মৌসুমেও ভালো ফলন হয়েছে। তবুও বাড়তির দিকে সব ধরনের চালের দাম। যেখানে গত বছরের একই সময়ে চালের দাম কমতি ছিল—সেখানে এবছর একই সময়ে চালের দাম বেড়ে গেছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত বছরের ৯ জুলাই নাজির বা মিনিকেট চালের দাম ছিল কেজিপ্রতি ৬০ থেকে ৭৮ টাকা। যেখানে এ বছর কেজিপ্রতি ব্যয় করতে হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে এই চালের দাম বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ।
আরও বেশি বেড়েছে পাইজাম বা আটাশ চালের দাম। গত বছরের একই সময়ে এই জাতের চাল কিনতে প্রতি কেজিতে ব্যয় হতো ৫২ থেকে ৫৮ টাকা, সেখানে এ বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। এ হিসাবে গত বছরের তুলনায় এ বছর দাম বেড়েছে ১৮ শতাংশের বেশি।
দাম বেড়েছে গরিবের স্বর্ণা বা মোটা চালেরও। গত বছরের একই সময়ে এ চালটির প্রতি কেজির দাম ছিল ৪৮ থেকে ৫২ টাকা, যা এ বছর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে।
সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবের থেকেও বেশি দাম পাড়া-মহল্লার দোকানে। গেন্ডারিয়া, সূত্রাপুর, শ্যামবাজার এবং বেশ কিছু পাড়া-মহল্লার দোকান ঘুরে দেখা গেছে, স্বর্ণা চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা কেজি, পাইজাম ৭৫ টাকা এবং মিনিকেট ৯০ টাকা কেজি।
গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা আবুল কাসেমের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, প্রতি মাসে এক বস্তা চাল লাগে। রোজার ঈদে যে চালের বস্তা ৩ হাজার ৮০০ টাকা দিয়ে, তা এখন কিনতে হচ্ছে ৪ হাজার ১৫০ টাকা দিয়ে। বস্তাতে ৩৫০ টাকা বাড়তি দিয়ে কিনতে হলো। চালের দাম বাড়ায় সংসারের অন্যান্য খরচও বেড়ে যাচ্ছে; কিন্তু আয় তো আর সেভাবে বাড়ছে না। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
রাজধানীতে চালের হালচাল
সাধারণত মে মাস পর্যন্ত বোরো মৌসুম ধরা হয়। এ সময় থেকে নিয়ে পরবর্তী কয়েক মাস চালের দাম সাধারণত নিম্নগামী থাকে। তবে এবার দেখা গেছে, বোরোর মৌসুমের সময়েই জুন মাসেই চালের দাম বাড়তে শুরু করে। টিসিবির হিসাবে, বছরের ব্যবধানে মোটা চালের কেজি বেড়েছে ৮ টাকা। মাঝারি চালের দর কেজিপ্রতি বেড়েছে ১২ টাকা এবং সরু বা চিকন চালের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ৭ টাকা।
শ্যামবাজারের মা রাইসের শফিকুল আলম কালবেলাকে বলেন, আমি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মিনিকেট চাল বিক্রি করি। এক মাস আগে মিনিকেট চালের ৫০ কেজির বস্তা ৩ হাজার ৭০০ টাকায় কিনেছিলাম। আর গতকাল তা কিনলাম ৪ হাজার টাকা দিয়ে। যখন আমার নিজেকেই বাড়তি দাম দিয়ে কিনতে হবে তাহলে আমিও তো বাড়তি দামেই বিক্রি করব। এই দাম বাড়ানোর পেছনে যারা মজুত করে ও সিন্ডিকেট করে তাদের ধরা হোক। তাহলেই দাম কমবে।
কারওয়ান বাজারে মেসার্স জনতা রাইস এজেন্সির জিয়াউল হক বিভিন্ন ধরনের চাল বিক্রি করেন। তিনি বলেন, এই সময়টায় সাধারণত চালের দাম কমতির দিকেই থাকে। তবে এবার একটু বাড়তির দিকে। আমরাই কিনছি বাড়তি দাম দিয়ে। আমাদের আর করণীয় কী আছে? বিভিন্ন করপোরেট কোম্পানি চালের ব্যবসায় নেমে গেছে। তারাই এখন বাজারে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে। ধান মজুত করে রাখে, চাল মজুত করে রাখে। আর এভাবেই কৃত্রিম সংকট তৈরি করে চালের দাম বাড়ানো হয়। প্রতি বস্তায় মাসের ব্যবধানে চালের দাম বাড়ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা।
রাজধানীর শ্যামবাজার বা কারওয়ান বাজার—প্রতিটি বাজারের চিত্রই অভিন্ন। সব ধরনের চালের বাড়তি দামে ক্রেতা-বিক্রেতা কারও মুখেই হাসি নেই। দাম বেশি থাকলে বিক্রি কম হওয়ায় এবং চাহিদা অনুযায়ী পাইকারদের কাছ থেকে চাল না পাওয়া বিক্রেতারাও অখুশি। আর হাসি নেই ক্রেতাদের মুখে।
খাদ্যশস্যের সন্তোষজনক মজুত
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৩ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে সরকারিভাবে এসেছে ৮ লাখ ৩৫ হাজার টন। বেসরকারি আমদানিকারকরা এনেছেন প্রায় ৪ লাখ ৭০ হাজার টন চাল। একই সময়ে ৬২ লাখ টন গমও আমদানি হয়েছে।
সরকারের কাছে গত ৮ জুলাই পর্যন্ত খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে ১৮ লাখ ৮ হাজার ৫৮৬ টন। এর মধ্যে ১৪ লাখ ৫২ হাজার ৩৭৯ টন চাল, ২ লাখ ১ হাজার ১৮২ টন ধান এবং ২ লাখ ২৫ হাজার ৪৩৮ টন গম রয়েছে; যা সন্তোষজনক বলে ধরা হয়।
বিশ্ববাজারে কমেছে চালের দাম
বিশ্ববাজারে যখন চালের দাম কমতির দিকে, ঠিক একই সময়ে বাংলাদেশে তার উল্টো চিত্র। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে থাইল্যান্ড ৫ শতাংশ ভাঙা চালের প্রতি টনের গড় দাম ছিল ৫৮৬ ডলার, যা গত মাস জুনে নেমেছে ৪১৯ ডলারে। ভিয়েতনামের চাল ৫৪৩ ডলার থেকে কমে নেমেছে ৩৭৭ ডলারে। গত জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকের তুলনায় চালের দাম কম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের বিশেষ অনুমতি ছাড়া চাল আমদানি করা যায় না। সরকারের অনুমতি নিয়েই চাল আমদানি করে। বিশেষ অনুমতির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। শুল্কছাড়ের মেয়াদও শেষ। এ কারণে চাল আমদানি হচ্ছে না। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
ট্যারিফ কমিশনের তথ্য যা বলছে
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) তথ্য বলছে, গত এক বছরে দেশের বাজারে চালের দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। অথচ একই সময়ে বিশ্ববাজারে চালের দাম কমেছে ২৪ দশমিক ১৯ শতাংশ।
রমজান মাস সামনে রেখে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে টিসিবির তথ্য উদ্ধৃত করে বিটিটিসি বলছে, দেশে বছরে চালের চাহিদা ৩ কোটি ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি ৮০ লাখ টন। শুধু রমজানেই চাহিদা থাকে ৩০ লাখ টনের। বছরে দেশে চাল উৎপাদন হয় ৪ কোটি ৬ লাখ ৯৫ হাজার টন। সেই হিসেবে দেশে চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ জানুয়ারি প্রতি কেজি মোটা চালের দর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। আগের বছর একই সময়ে ছিল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে ৫ জানুয়ারি প্রতি টন চালের দাম ছিল ৫২৫ ডলার। এক বছর আগে ছিল ৬৫২ ডলার।
কঠোর তদারকি দরকার
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন কালবেলাকে বলেন, চালের কোনো সংকট নেই। পর্যাপ্ত মজুত আছে। এটা হলো সিন্ডিকেটের কারসাজি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বলে এসেছি; কিন্তু সিন্ডিকেট ভাঙতে পারিনি। তখন সরকারের আন্তরিকতা ছিল না, সরকার সিন্ডিকেট ভাঙেনি।
তিনি বলেন, এখন পর্যাপ্ত চালের মজুত আছে। আমদানিও প্রচুর আছে। তার পরও চালের দাম বাড়ছে। সিন্ডিকেটরা প্রতিনিয়ত এটি বাড়িয়েই যাচ্ছে। চালের বাজার কোনো সময় তদারকির মধ্যে থাকে না। তাই চালের বাজার কঠোর তদারকির মধ্যে আনা হোক। যারা মজুত করে রেখেছে তাদের ধরা হোক, তাহলেই সব বেরিয়ে যাবে।
মন্তব্য করুন