জুলাই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা তরুণদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) গঠনতন্ত্র ঠিক নেই। নেই দলটির তহবিলের পরিমাণের তথ্যও। দলের ২৫টি উপজেলা কমিটিতে নেই ২০০ জন করে ভোটার সমর্থক। এ ছাড়া কোনো কোনো উপজেলায় একই ব্যক্তিকে বারবার ভোটার সমর্থক হিসেবে দেখানো হয়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য এনসিপির করা আবেদনে এরকম ছয়টি বিষয়ে ত্রুটি বা ঘাটতি পেয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ফলে প্রাথমিক যাচাইয়ে পাওয়া এসব ত্রুটি সংশোধন করে ১৫ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে আগামী ৩ আগস্টের মধ্যে উপযুক্ত দলিল দাখিল করতে দলটিকে চিঠি দিয়েছে ইসি। এনসিপির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলামকে এরই মধ্যে এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠিয়েছেন ইসির নির্বাচন সহায়তা শাখার উপসচিব মো. মাহবুব আলম শাহ।
ইসি সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নিবন্ধনের জন্য ইসিতে এনসিপিসহ মোট ১৪৪টি দল আবেদন করেছে। আবেদনের নির্ধারিত শর্তগুলো পূরণ করা হয়েছে কি না, তা প্রাথমিকভাবে যাচাই করেন ইসির কর্মকর্তারা। আবেদনে তথ্যগত ঘাটতি বা ত্রুটি থাকলে সেগুলো পূরণের জন্য দলগুলোকে সাধারণত ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়। এরপর আবার আবেদন যাচাই–বাছাইয়ের পর যারা শর্ত পূরণ করে, তাদের সব তথ্য ঠিক আছে কি না, তা মাঠপর্যায়ে যাচাই করা হয়। গত বৃহস্পতিবার এনসিপিসহ আরও বেশকিছু দলকে এ-সংক্রান্ত চিঠি দিয়েছে ইসি।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বরাবর পাঠানো চিঠিতে দলটির আবেদনের ত্রুটিগুলোর কথা তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ঠিকানাসহ দলের সব কার্যকর জেলা দপ্তরের তালিকা দেওয়া হয়নি; ঢাকা ও সিলেট জেলা দপ্তরের ভাড়া চুক্তিপত্রে দলের নাম উল্লেখ নেই। ঠিকানাসহ সব উপজেলা ও থানা দপ্তরের তালিকা দেওয়া হয়নি; এর মধ্যে ২৫টি উপজেলা বা থানায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভোটার (ন্যূনতম ২০০ জন) সদস্যের অন্তর্ভুক্তি পাওয়া যায়নি। কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলা কার্যালয়ের ভাড়ার চুক্তিপত্রে দলের নাম উল্লেখ নেই। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলা কার্যালয়ের ভাড়ার চুক্তিপত্রে দলের নাম ও কার্যালয়ের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়নি।
ইসির চিঠিতে আরও বলা হয়, এনসিপির আবেদনে দলের তহবিলের পরিমাণ উল্লেখ নেই, আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত তহবিলের উৎসের বিবরণীতেও তহবিলের পরিমাণ উল্লেখ নেই। নিবন্ধনের বিষয়ে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্তের অনুলিপির শেষ পৃষ্ঠায় স্বাক্ষর নেই। দলের গঠনতন্ত্রে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা, উপজেলা বা ক্ষেত্রমতো জেলা কমিটির সদস্যদের নিয়ে প্রস্তুত প্যানেল থেকে দলের কেন্দ্রীয় সংসদীয় বোর্ড সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করার বিধান রাখা হয়নি।
এ ছাড়া দলের কোনো দলিল বা কার্যক্রম সংবিধান-পরিপন্থি নয় এবং দলে ‘কোলাবোরেটর (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার ১৯৭২’ ও ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট ১৯৭২’-এর অধীন দণ্ডিত কোনো ব্যক্তি নেই, এ ধরনের প্রত্যয়নপত্র আবেদনপত্রের সঙ্গে যুক্ত করা হয়নি বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসির চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব সাংবাদিকদের জানান, তারা ইসির চিঠি পেয়েছেন। ইসি যেসব তথ্য চেয়েছে, সেগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
ইসির আইন অনুযায়ী, নিবন্ধন পেতে ইচ্ছুক দলের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি, এক-তৃতীয়াংশ জেলা ও ১০০টি উপজেলা কমিটি এবং প্রতিটি কমিটিতে ২০০ ভোটারের সমর্থনের প্রমাণ থাকতে হয়। এ ছাড়া কোনো দলের কেউ আগে সংসদ সদস্য থাকলে বা আগের নির্বাচনে ৫ শতাংশ ভোট পেলেও নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্যতা হিসেবে ধরা হয়। এই প্রধান শর্তগুলো ছাড়াও বেশকিছু নিয়মকানুন মেনে আবেদন করতে হয়। প্রাথমিক বাছাইয়ে এসব নিয়ম কানুনই সাধারণত খেয়াল করা হয়।
নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় দলগুলোর আবেদন পাওয়ার পর কমিশন প্রথমে এগুলো প্রাথমিক বাছাই করে। এরপর সেই দলগুলোর তথ্যাবলি সরেজমিন তদন্ত শেষে বাছাই সম্পন্ন করে দাবি আপত্তি চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেয় কমিশন। সেখানে কোনো আপত্তি এলে শুনানি করে তা নিষ্পত্তি করা হয়। আর কোনো আপত্তি না থাকলে সংশ্লিষ্ট দলগুলোকে নিবন্ধন সনদ প্রদান করে ইসি। নিবন্ধন ছাড়া কোনো দল নিজ প্রতীকে নির্বাচনে প্রার্থী দিতে পারে না।
বর্তমানে ইসিতে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৫১টি (স্থগিত হওয়া আওয়ামী লীগসহ)। নবম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালে নিবন্ধন প্রথা চালু হয়। এ পর্যন্ত ৫৫টি দল ইসির নিবন্ধন পেলেও পরে শর্ত পূরণ, শর্ত প্রতিপালনে ব্যর্থতা এবং আদালতের নির্দেশে পাঁচটি দলের নিবন্ধন বাতিল করে ইসি। দলগুলো হলো জামায়াতে ইসলামী, ফ্রিডম পার্টি, ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, পিডিপি ও জাগপা। সম্প্রতি আদালতের আদেশে জামায়াতে ইসলামী ও জাগপা নিবন্ধন ফিরে পেলেও ইসি শুধু জামায়াতের নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরিয়ে দিয়েছে।
মন্তব্য করুন