শনিবার, ২৩ আগস্ট ২০২৫, ৮ ভাদ্র ১৪৩২
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২৫, ১০:২১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

১৬৭ জনের বেশিরভাগের মাথার খুলি ছিল না

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলায় চিকিৎসকের জবানবন্দি
ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে আনা গুরুতর আহত ১৬৭ জনের বেশিরভাগের মাথার খুলি ছিল না। গতকাল বুধবার শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষ্য প্রদানকালে হাসপাতালটির নিউরোট্রমা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান এ কথা জানান।

চিকিৎসক মাহফুজুর রহমান তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘১৮ জুলাই থেকে গুলিবিদ্ধ রোগী আসতে থাকে। রোগীদের মাথায়, হাতে, পায়ে, পিঠে, মুখে, গলায় গুলি ও পিলেটবিদ্ধ ছিল। গুলিগুলো ছিল বড় সাইজের। ৪-৫ আগস্ট যেসব রোগী আসে, তাদের অধিকাংশের মাথায়, বুকে, মুখে, গলায় গুলিবিদ্ধ ছিল। আমাদের হাসপাতালে ৫৭৫ জন গুলি ও পিলেটবিদ্ধ রোগীকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে অনেককেই হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সিট সংকুলান না হওয়ায় এবং গুরুতর আহত রোগীর চাপ বেশি থাকায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। গুরুতর আহত ১৬৭ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের বেশিরভাগেরই মাথার খুলি ছিল না। তাদের মধ্যে চারজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। ২৯ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। ৭ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড পাঠানো হয়।’

সাক্ষী মাহফুজুর রহমান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ দেওয়া জবানবন্দিতে এসব কথা বলেন। এদিন আরও তিনজন সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। এ পর্যন্ত মোট ১৬ জন সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য দিয়েছেন। আগামী রোববার ফের এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হবে। গতকাল ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এস এইচ তামিম। এ সময় প্রসিকিউটর বি এম সুলতান মাহমুদসহ অন্য প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে, এই মামলায় পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। তিনি সাক্ষীদের জেরা করেন। আর এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়া রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।

জবানবন্দিতে চিকিৎসক মাহফুজুর রহমান আরও বলেন, ৩৩টি অস্ত্রোপচার আমার নেতৃত্বে করেছি। ১৫টির মতো বুলেট ও পিলেট আহত আন্দোলনকারীদের শরীর থেকে বের করেছি। কিছু বুলেট বের করা যায়নি। অনেকগুলো গুলি ও পিলেট রোগীরা চেয়ে নিয়ে যায়।’

তিনি বলেন, গত বছরের ১৯ জুলাই যখন রোগীর সংখ্যা বাড়ছিল, তখন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) লোকেরা এসে নতুন গুলিবিদ্ধ ছাত্রদের ভর্তি না করার জন্য তাকে চাপ দেন। তারা (ডিবি) বলে, যাদের ভর্তি করেছেন, তাদের রিলিজ করবেন না। এ বিষয়ে ওপরের নির্দেশ আছে। তাদের (গুলিবিদ্ধদের) বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তখন আমরা কৌশলে ভর্তি রেজিস্টারে রোগীদের জখমের ধরন পরিবর্তন করে গুলিবিদ্ধের স্থলে রোড অ্যাক্সিডেন্ট বা অন্যান্য কারণ লিপিবদ্ধ করে ভর্তি করি।

এ রকম অমানবিক ঘটনার জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ওবায়দুল কাদের ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আরাফাত এবং যারা নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে নিহত ও আহত করেছেন, তাদের বিচার ও প্রকাশ্যে ফাঁসি চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য ও জেরা শেষ করেন এই চিকিৎসক।

ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কল্যাণপুর শাখার সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হাসানুল বান্না তার জবানবন্দিতে বলেন, ১৮ জুলাই দুপুরের পর থেকে আমাদের হাসপাতালে অসংখ্য আহত ব্যক্তি এলে আমরা চিকিৎসা প্রদান শুরু করি। যাদের অনেকের অপারেশন করতে হয়েছে। ১৮ জুলাই সন্ধ্যার পরে পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হাসপাতালে এসে চিকিৎসা প্রদানে বাধা দেয় এবং রোগী ভর্তি করতে নিষেধ করে। রোগীর ভর্তি রেজিস্টার চেক করে এবং রোগীদের তালিকা নিয়ে যায়। ১৯ জুলাই সকাল থেকে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় সন্ত্রাসীরা হাসপাতালের গেট অবরোধ করে চেয়ার নিয়ে সারা দিন বসেছিল। কোনো রোগী হাসপাতালে ঢুকতে দেয়নি। সেদিন তারা হাসপাতালে কোনো অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে দেয়নি এবং বের হতেও দেয়নি। তিনি তার সাক্ষ্যে আরও বলেন, আমাদের হাসপাতালের টেকনোলজিস্ট মিতুর স্বামী মোস্তাকিন বিল্লাহ, যিনি ইনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেকনোলজিস্ট ছিলেন, মিরপুর ১০নং গোলচত্বরে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। তাকে বিকল্প পথে আমাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার জরুরি অপারেশনের প্রয়োজনে নিউরো সার্জন আনার জন্য অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর প্রয়োজন থাকলেও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা অ্যাম্বুলেন্স বের হতে দেয়নি। পরে তাকে বিকল্প পথে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে ভর্তি না নেওয়া হলে তাকে ইবনে সিনা ধানমন্ডি শাখায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

রাজধানীর চানখাঁরপুলে শহীদ মেহেদী হাসান জুনায়েদের মা সোনিয়া জামাল তার সাক্ষ্যে বলেছেন, ৫ আগস্ট চানখাঁরপুলে আমার ছেলে নিহত হয়। আমার ছেলে ১০ পারা কোরআনে হাফেজ ছিল। আমি নিজেও সেদিন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার সময় আমার ছেলে নাশতা করার পর আমাকে বলে—মা, আমি আমার বন্ধু সিয়ামকে নিয়ে আন্দোলনে গেলাম। কিছুক্ষণ পর আমি আমার মেয়ে নাফিসা নাওয়ালকে সঙ্গে নিয়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে আন্দোলনে যোগদান করার জন্য রওনা দিই। পথিমধ্যে পুলিশ আমাকে কোথায় যাই জিজ্ঞাস করলে আমি বলি, আমার আত্মীয় মারা গেছে, আমি সেখানে যাব। তখন আমাকে যেতে দেয়। আইডিয়াল স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছলে পুলিশ আমার রিকশা থামিয়ে দেয়। রিকশা থেকে নেমে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে হেঁটে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি আনুমানিক দুপুর ১২টার সময়। আনুমানিক এক ঘণ্টা পর মোবাইল চেক করে দেখি, আমার মোবাইলে অনেকগুলো কল এসেছে। কলগুলো ছিল আমার ছোট ভাই আসিফের। আসিফ আমাকে ফোন করে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলে। সে বলে, জুনায়েদ মাথায় ব্যথা পেয়েছে। তখন আমি আমার মেয়েকে নিয়ে বাসায় চলে আসি। আমি আমার ভাশুরের রুমে ঢুকে দেখি, আমার ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার বাঁ চোখের বাঁ পাশে গুলি লেগে মাথার পিছন দিয়ে বড় গর্ত হয়ে বের হয়ে গেছে। অনেক রক্ত বের হচ্ছিল। আমি জানতে পারি, ওইদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটের অন্য পাশে ফুটপাতের ওপর জুনায়েদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। তার বন্ধু সিয়াম ও আব্দুর রউফ তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার বলেন, সে আগেই মারা গেছে।

উল্লেখ্য, মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এ ছাড়া এই মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদ্ঘাটনে (অ্যাপ্রোভার) রাজসাক্ষী হতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আবেদন মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর গত ৩ আগস্ট এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত: রাষ্ট্রদূত আনসারী

লা লিগার কাছে যে অনুরোধ করতে চায় বার্সা

‘নির্বাচনে আমলাদেরকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে’

সাবেক এডিসি শচীন মৌলিক কারাগারে

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা আসছেন শনিবার, যেসব বিষয়ে আলোচনা

সিদ্ধিরগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের শানে রিসালাত সম্মেলন

শেষ দিনেও ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে মতামত দেয়নি ৭ রাজনৈতিক দল

ইউরোপের লিগগুলোতে দল কমানোর প্রস্তাব ব্রাজিল কোচ আনচেলত্তির

নেপালে মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের প্রচার, তাসনিম জারার ব্যাখ্যা

মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে মৃত্যুর মিছিল, তিন বছরে প্রাণ হারান ১৮৩ জন

১০

স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি 

১১

সুদ দিতে না পারায় বসতঘরে তালা, বারান্দায় রিকশাচালকের পরিবার

১২

দেশ বাঁচাতে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে : চরমোনাই পীর

১৩

এএসপির বাসায় চাঁদাবাজি-ভাঙচুর, যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

১৪

জেলের জালে বড় ইলিশ, ৯ হাজারে বিক্রি 

১৫

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন নিয়ে নতুন নির্দেশনা

১৬

আগামী সংসদ প্রথম তিন মাস ‘সংবিধান সংস্কার সভা’ হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব

১৭

ধরলার তীব্র ভাঙন, টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি

১৮

নেতা ও ভোটারের জবাবদিহিই হবে শ্রেষ্ঠ সংস্কার : মঈন খান

১৯

পাপের ফল ওদের ভোগ করতেই হবে : রাশেদ খান

২০
X