কূটনৈতিক প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১:৪৪ এএম
আপডেট : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:০২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ভিন্ন রকম কর্মসূচি

প্রকৃতি-সংস্কৃতি আর মানুষ দেখলেন মাখোঁ

ইঞ্জিনচালিত নৌকায় রাজধানীর উপকণ্ঠের তুরাগ নদ ঘুরে দেখেন ইমানুয়েল মাখোঁ। ছবি: সংগৃহীত
ইঞ্জিনচালিত নৌকায় রাজধানীর উপকণ্ঠের তুরাগ নদ ঘুরে দেখেন ইমানুয়েল মাখোঁ। ছবি: সংগৃহীত

সফর মাত্র সাড়ে ১৮ ঘণ্টার। এ যেন এলেন, দেখলেন এবং জয় করে গেলেন। বাংলাদেশে এসেছিলেন দ্বিপক্ষীয় সফরে। কিন্তু এত অল্প সময়ে জয় করে গেলেন এদেশের মানুষের মন। মিশে গেলেন প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে। এখানে বলা হচ্ছে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর কথা। গত রোববার তিনি বাংলাদেশে আসেন। যে কোনো ভিভিআইপি সফরের চেয়ে তার এই সফরটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। তিনি রীতি ও প্রটোকল মেনে সরকারপ্রধানের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে যেমন অংশ নিয়েছেন, তেমনি শিল্পীর বাড়িতে গিয়ে শুনেছেন গান। হেঁটেছেন ধানমন্ডির লেকের পাড়ে। ঢাকা ছাড়ার আগে তুরাগ নদে নৌকায় ঘুরেছেন কিছু সময়। কথা বলেছেন স্থানীয় মানুষের সঙ্গে, খেয়েছেন শিঙাড়া ও জিলাপি।

রোববার রাত ৮টায় তিনি ঢাকায় আসেন। বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখান থেকে তিনি সদ্য চালু হওয়া এলিভেটেড

এক্সপ্রেসওয়ে পাড়ি দিয়ে হোটেল ইটারকন্টিনেন্টালে আসেন। তিনিই কোনো বিদেশি অতিথি, যিনি প্রথম দ্রুতগতির এ উড়ালপথ ব্যবহার করলেন। হোটেলে এসে তিনি অংশ নেন তার সম্মানে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর নৈশভোজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। এরপর তিনি মধ্যরাতে ধানমন্ডিতে সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও বাদ্যযন্ত্রী রাহুল আনন্দের বাসায় যান।

গতকাল সোমবার সকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের লেকের পাড় দিয়ে হেঁটে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে যান মাখোঁ। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ফরাসি প্রেসিডেন্ট স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সহযোগিতা করবেন বলে জানান। তিনি বলেন, ১১ লাখের মতো রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ মানবতার পরিচয় দিয়েছে। এজন্য আমি বাংলাদেশের প্রতি ধন্যবাদ জানাই। আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করবে ফ্রান্স। বাংলাদেশ এবং ফ্রান্সের মধ্যকার সম্পর্ক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করবে।

দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষ হওয়ার পরে দুপুরে তুরাগ নদে বৃষ্টির মধ্যে নৌকা ভ্রমণ করেন তিনি। এরপর দুপুর ২টা ৩০ মিনেটে একটি বিশেষ ফ্লাইটে প্যারিসের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।

মাখোঁর এই ভিন্ন ধরনের সফর প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত ভিভিআইপি সফরে নিরাপত্তা ও জাঁকজমক বেশি দেখা যায়। মাখোঁর সফর সেই তুলনায় একেবারেই আলাদা। তিনি সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে বাংলাদেশকে দেখার চেষ্টা করেছেন। তার আগ্রহের কারণে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের বাইরের অনুষ্ঠানগুলো সূচিতে যুক্ত করা হয়।

ঢাকার ফরাসি দূতাবাস সূত্র জানায়, মাখোঁ একজন আপাদমস্তক সংস্কৃতিমনা ও প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। তিনি নিজে একজন শিল্পী এবং খুব ভালো পিয়ানো বাজান। তিনি যখন কোনো দেশ সফরে যান, তখন সেখানকার স্থানীয় সংস্কৃতি উপভোগ করেন। ৩৩ বছর পরে ফ্রান্সের কোনো প্রেসিডেন্টের এটি প্রথম ঢাকা সফর। এর আগে ১৯৯০ সালের ২২-২৪ ফেব্রুয়ারি ফ্রাঁসোয়া মিতেরা বাংলাদেশ সফর করেন।

তুরাগে নৌকা ভ্রমণ: মাখোঁ ঢাকা ছাড়ার আগে গতকাল দুপুর ১টার দিকে বৃষ্টির মধ্যেই রাজধানীর তুরাগ নদে নৌকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ফ্রান্সের ইউরোপ ও পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী ক্যাথরিন কোলোনা, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী, ঢাকায় নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মারিয়ে মাসুদুপুয়ে। যদিও এই নৌভ্রমণ নির্ধারিত ছিল না। বেসরকারি সংস্থা ফ্রেন্ডশিপের ‘ফ্লেচে ডি অর’ নামের নৌকায় করে ভ্রমণ করেন তিনি। এ সময় সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রুনা খানও সঙ্গে ছিলেন। সে সময় সেখানে চলমান নৌকাবাইচও উপভোগ করেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। তুরাগ পাড়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। সড়কের পাশের হোটেলের শিঙাড়া ও জিলাপির স্বাদও নেন। তথ্যমন্ত্রী তার ফেসবুক পোস্টে ছবি দিয়ে বলেন, তুরাগ নদে নৌকা ভ্রমণের পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সেলফি। তিনি নৌকা ভ্রমণ অনেক উপভোগ করেছেন।

শিল্পী রাহুলের বাসায় আড্ডা: রাষ্ট্রীয় সফরে এসে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মধ্যরাতে ধানমন্ডিতে সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও বাদ্যযন্ত্রী রাহুল আনন্দের বাসায় যান। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ ঢাকার পরিচালক ফ্রাঁসোয়া গ্রোজ্যঁ। তাদের স্বাগত জানাতে বাসার গেটের অংশ গোলাপ ও গাঁদা ফুলে সাজিয়েছিলেন রাহুল ও ও তার স্ত্রী শর্মিলা শুক্লা। সেখানে তিনি প্রাণ ও প্রকৃতির শিল্পী জলের গানের স্রষ্টা রাহুলের গান শোনার পাশাপাশি তার তৈরি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে পরিচিত হন। ঘুরে দেখেন তার বাসা ও স্টুডিও। সময় কাটান ব্যান্ডের গীতিকার ও শিল্পীদের সঙ্গে। সেখানে পুরো এক ঘণ্টা ৪০ মিনিট বাংলার প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে বিমোহিত থাকেন তিনি। মাখোঁকে প্রথমে ফকির লালন সাঁইয়ের ‘আর কি বসবো এমন সাধুর সাধবাজারে/না জানি কোন সময় কোন দশা ঘটে আমারে’ গেয়ে শোনান রাহুল। এরপর পরিবেশন করেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ‘আমি বাংলায় গান গাই’। যে একতারা বাজিয়ে রাহুল গান গেয়েছেন, সেটি উপহার দেন মাখোঁকে। তিনি সেটি হাতে পেয়ে বাজানোর চেষ্টা করেন। মরমি শিল্পী আব্দুল আলীমের ‘নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইলা’ গানটি গাইতে গাইতে রাহুল তাকে দেখিয়ে দেন কীভাবে বাজাতে হবে। তারপর দুজন একসঙ্গে একতারা বাজাতে থাকেন। রাহুল বলেন, ‘এই পরিবেশনাকে বলতে পারেন বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের দুই সংগীতশিল্পীর সম্মিলন! প্রেসিডেন্ট হলেও আপনি দারুণ সংগীতশিল্পী। বিদায়ের আগে রাহুলকে একটি কলম উপহার দেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। রাহুল কলমটি দিয়ে নতুন গান লিখবেন বলে জানান। এ কথা শুনে বেশ খুশি হয়ে মাখোঁ বলেন, আপনার গানের অপেক্ষায় থাকব। রাহুলের ছেলে তোতার সঙ্গেও কিছুটা সময় কাটান তিনি। এ সময় তাকে অটোগ্রাফ দেন এবং তার সঙ্গে ছবি তোলেন।

মাখোঁ যেসব খাবার খেলেন: মাখোঁ ঢাকা সফরে বাংলার সংস্কৃতি ও প্রকৃতি দেখার পাশাপাশি খেয়েছেন হরেক রকম খাবার। পাঁচতারকা হোটেলে বসে ঐতিহ্যবাহী খাবারের পাশাপাশি তিনি স্বাদ নিয়েছেন রাস্তার পাশের দোকানের শিঙাড়া ও জিলাপিরও। সফরের প্রথম দিন গত রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া নৈশভোজে ছিল ১৬ পদের খাবার। শুরুতেই ছিল স্মোকড ইলিশ, পেঁয়াজু ও সমুচা। রুটি আর মাখনের সহযোগে দেওয়া হয় দক্ষিণ ভারতীয় মাল্লিগাতওয়ানি কারি স্যুপ। ওয়েলকাম ড্রিংকসে ছিল আমড়ার জুস। মেইন কোর্সে ছিল খাসির কাচ্চি বিরিয়ানি, গরুর শিক কাবাব, মুরগির কোরমা, রোস্টেড লবস্টার, টক বেগুনের তরকারি ও লুচি। ডেজার্টে পরিবেশন করা হয় পাটিসাপটা পিঠা, মিষ্টি দই, রসগোল্লা আর নানা রকম ফল। পানীয়তে ছিল ফলের রস, কোমল পানীয়, চা ও কফি। মাখোঁ ইলিশ, কাচ্চি বিরিয়ানি, পেঁয়াজু এবং সমুচার স্বাদ নিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা: গতকাল সকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে দিন শুরু করেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। সকালে লেকের পাড় দিয়ে হেঁটে প্রবেশ করেন বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে। সেখানে তাকে স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা, তার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এবং জাদুঘরের কর্মকর্তারা। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর সময় তিনি এক নিমিট নিরবতা পালন করেন। এরপর জাদুঘরে যান তিনি। সেখানে স্মৃতি জাদুঘরের পরিদর্শন বইতে স্বাক্ষর করেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পার্বত্য অঞ্চলকে অশান্ত করে খোয়াব পূরণ হবে না : জাগপা

‘আসল শিবির হইলো আমার মা, বাড়ি এলেই জোর করে বোরকা পরায়’

উৎসবের আবহে উদযাপিত হলো টাইমস স্কয়ার দুর্গা উৎসব

অবশেষে মুখ খুললেন আরিয়ান খান

৮-৯ অক্টোবর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি নিয়ে কী বলছে মাউশি

গণভবন কখনোই প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ছিল না : উপ প্রেস সচিব

ফ্রিডম ফ্লোটিলায় ইসরায়েলি বাধা / ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সহিংস বিক্ষোভ

বিশ্বকাপে রেকর্ডের বৃষ্টি তুলে প্রোটিয়াদের উড়িয়ে দিল ইংল্যান্ড

১০০ আসন ছেড়ে দিতে পারে জামায়াত : গোলাম পরওয়ার

জুলাই সনদের আইনিভিত্তি দেওয়া না হলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে : ড. আযাদ

১০

দেশের অগ্রগতির জন্য নারীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ : খোকন

১১

মুলাদীর সাবেক পৌর মেয়র রুবেল কারাগারে

১২

গাজা অভিমুখে যাচ্ছে আরও ১১ জাহাজ

১৩

টসে জিতে ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশ, দেখে নিন একাদশ 

১৪

বিএনপির বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়ে লাভ হবে না : মাহবুবুর রহমান

১৫

ইসলামকে ক্ষমতায় নিতে নারী সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে : চরমোনাই পীর

১৬

নির্বাচন নিয়ে ধর্ম ব্যবসায়ী একটি দল বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে : মির্জা আব্বাস 

১৭

শনিবার বিদ্যুৎ থাকবে না সিলেটের যেসব এলাকায়

১৮

তারুণ্যের শক্তিই দেশে পরিবর্তনের প্রধান চালিকাশক্তি : জুয়েল

১৯

জাতিসংঘ সভাপতির পদে বাংলাদেশের প্রার্থিতা প্রত্যাহারে কৃতজ্ঞতা ফিলিস্তিনের

২০
X