শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫, ২৫ আশ্বিন ১৪৩২
আলাউদ্দিন আরিফ
প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১০:০৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দিনে অপমৃত্যুর ৮৩ মামলা!

বড় কারণ আত্মহত্যা
প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

রাজধানীসহ সারা দেশের থানাগুলোতে দৈনিক গড়ে ৮৩টি অপমৃত্যুর মামলা রেকর্ড হচ্ছে। নানান দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা, পানিতে পড়ে বা অজ্ঞাত হিসেবে কারও লাশ উদ্ধার হওয়ার পর থানাগুলোতে অপমৃত্যুর মামলা হয়। এসব মামলার মধ্যে কিছু মামলা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে হত্যা মামলায়ও রূপান্তরিত হচ্ছে।

এর বাইরেও প্রতিদিন থানাগুলোতে হত্যা মামলা ও সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার মামলা রয়েছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, অপমৃত্যুর সংখ্যা কমাতে ট্র্যাডিশনাল পুলিশিং ব্যবস্থা, জনসচেতনতাসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য ব্যবস্থা নিতে হবে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, প্রতি মাসে সারা দেশের থানাগুলোতে প্রায় আড়াই হাজার অপমৃত্যুর মামলা রেকর্ড হয়। গত জুলাইয়ে অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে ২ হাজার ৪৬০টি। জুনে এ সংখ্যা ছিল আড়াই হাজারের বেশি। গত বছরের জুনে অপমৃত্যু মামলা হয় ২ হাজার ৫৩টি, জুলাইয়ে ২ হাজার ৪১১ ও সেপ্টেম্বরে ২ হাজার ২০২টি।

পুলিশের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অপমৃত্যুর বেশি মামলা হয় আত্মহত্যার ঘটনায়। আত্মহত্যা করা ব্যক্তির মধ্যে ৫২ শতাংশ পুরুষ ও ৪৮ শতাংশ নারী। তাদের প্রায় ৬০ শতাংশ আত্মহত্যা করেন গলায় ফাঁস নিয়ে। বিষপানে আত্মহত্যা করেন ২৫ শতাংশের বেশি। আত্মহত্যা করা ব্যক্তির ২৫ শতাংশেরই বয়স থাকে ১৮ বছরের নিচে। ১৯ থেকে ৩০ বছর বয়সী প্রায় ৩৮ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪৫ বছর বয়সী প্রায় ২২ শতাংশ এবং ১০ শতাংশের বয়স ৪৬ থেকে ৬০ বছর। ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক ৫ শতাংশ।

পুলিশ সদর দপ্তর আত্মহত্যার প্রবণতা প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে এলাকাভিত্তিক কর্মশালা করার নির্দেশনা দিয়েছে। পাশাপাশি প্রত্যেক জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের (ক্রাইম) নেতৃত্বে অপমৃত্যুর মামলাগুলো পর্যালোচনা করে কারণ নির্ণয় ও প্রতিকারের উদ্যোগ নিতে বলেছে।

অপমৃত্যুর মামলা কী—জানতে চাইলে পুলিশ জানায়, কোনো ব্যক্তি প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে মারা গেলে তাকেই অপমৃত্যু বা অস্বাভাবিক মৃত্যু বলে। আর এ মৃত্যুর কারণে যে মামলা রেকর্ড করা হয়, তাকেই অপমৃত্যু বা ইউডি কেস বলে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৪ ধারা, পিআরবি ২৯৯ বিধি অনুযায়ী এই মামলা রেকর্ড ও তদন্ত হয়।

যেসব মৃত্যুতে অপমৃত্যুর মামলা রেকর্ড হয়ে থাকে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে গলায় ফাঁসজনিত, বিষপানে মৃত্যুসহ আত্মহত্যা, সাপ বা হিংস্র পশু ও প্রাণীর আক্রমণে মৃত্যু, পাহাড় বা মাটিচাপায় মৃত্যু, নৌযানচালিত যানবাহন ডুবে মৃত্যু, পানিতে ডুবে মৃত্যু, বজ্রপাতে মৃত্যু, বিদ্যুতায়িত হয়ে মৃত্যু, গাছ বা ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু, আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া, আগ্নেয়াস্ত্রের কারণে মৃত্যু ও যন্ত্রপাতি চালাতে গিয়ে মৃত্যু। অপমৃত্যুজনিত কোনো ব্যক্তির মৃতদেহ দাফনের পরও যদি ওই ব্যক্তির মৃত্যু সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দেয়, তবে পুলিশ অফিসারের লিখিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাজিস্ট্রেটকে অবগত করতে হবে। প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মৃতদেহটি তুলে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠাতে হবে।

পুলিশ জানিয়েছে, কারও অস্বাভাবিক বা অপমৃত্যুর সংবাদ পেলে এবং ওই মৃত্যুর বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট অভিযোগ পাওয়া না গেলে থানার পুলিশ কর্মকর্তা অপমৃত্যুর বিষয়টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে আদালতকে অবহিত করবেন এবং ঘটনার তদন্ত করবেন। এই ধরনের অস্বাভাবিক ও অভিযোগবিহীন মৃত্যুর মামলায় ইউটি কেস বা অপমৃত্যুর মামলা। ইউডি কেসের ঘটনা তদন্তের পর ঘটনার সঙ্গে কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া না গেলে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা পিআরবির ২৭৫ প্রবিধান অনুসারে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন। আদালত চূড়ান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় ইউডি মামলা এখানেই নিষ্পত্তি করবেন। অপমৃত্যুর পর পুলিশ সুরতহাল প্রতিবেদন করবেন। মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে সন্দেহ থাকলে অথবা অন্য কোনো কারণে এই সম্পর্কে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত নিয়ম সাপেক্ষে পুলিশ অফিসার ময়নাতদন্তের জন্য পাঠাবেন। সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির সময় চিহ্ন, লক্ষণ দেখে অপমৃত্যু মামলা হত্যা মামলায় পরিণত হতে পারে। যেমন আঘাত বা জখমের চিহ্ন, ধস্তাধস্তির চিহ্ন, গলায় কোনো কিছুর দাগ, শরীরের কোনো অংশ ফুলে যাওয়া, হাত-পায়ে রশি দিয়ে বাঁধার দাগ, গলায় রশির দাগ গোলাকার হওয়া, জিহ্বা বের হওয়া, মুখ দিয়ে লালা বের হওয়া, রক্তক্ষরণের চিহ্ন থাকা, চোখ ফুলে যাওয়া, মুখমণ্ডলে অস্বাভাবিক ভাব থাকা ইত্যাদি লক্ষণ দেখে ধারণা করা হয় যে হত্যা করার পর আত্মহত্যা হিসেবে সাজানো হয়েছে কি না। এ ক্ষেত্রে মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয় করতে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনকারী চিকিৎসকের মতামতের ভিত্তিতে অপমৃত্যুর মামলা হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।

পুলিশের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডিআইজি কালবেলাকে বলেন, দেশে অপমৃত্যুর মামলা বৃদ্ধির বড় কারণ আত্মহত্যার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়া। আমরা দিনে দিনে অনলাইন ও মোবাইল ফোন ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। সবারই অনলাইনকেন্দ্রিক লাইফস্টাইল গড়ে উঠেছে। প্রযুক্তির কারণে তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরীরা সহজেই একে অপরের সান্নিধ্যে চলে আসছে। আবেগ, হাসি, কান্না, সুখ, দুঃখগুলো সহজেই প্রযুক্তির মাধ্যমে অন্যের কাছে প্রকাশ করছে। এসব কারণে আবেগতাড়িত হয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। অনেক গেমস আছে, যেগুলো আত্মহত্যার প্রবণতাকে উদ্বুদ্ধ করে। অনেকে লাশ ও রক্ত দেখলে ভয় পায় আবার অনেকে সেটা দেখে স্বাভাবিকভাবেই।

পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, আগে দেখা গেছে মানুষ লবণ দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়ে খুশি থাকত। এখন তারা চায় দামি জামা, জুতা, আইফোন-১৭ প্রো ম্যাক্সের মতো দামি মোবাইল ফোন। পণ্যকেন্দ্রিক আমাদের আবেগ অনুভূতি প্রকাশ পাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, কোনো ক্লাসে তার বন্ধু দামি আইফোন বা দামি মোবাইল ফোনসেট নিয়ে আসছে। তখন অন্য বন্ধু যার হয়তো সামর্থ্য নেই তার মধ্যেও সেটি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগে। মা-বাবার কাছে চেয়ে না পেলে কেউ কেউ আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে। প্রযুক্তি বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারও আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়ানোর জন্য দায়ী। এখন কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু আপলোড করলে কেউ হয়তো না জেনেই আপত্তিকর কমেন্টস ও শেয়ার করে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রবণতা উসকে দেয়। তিনি আরও বলেন, আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানকে একযোগে কাজ করতে হবে। গবেষণার মাধ্যমে আত্মহত্যার যথাযথ কারণগুলো চিহ্নিত করে প্রতিকারে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ফারজানা রহমান বলেন, আত্মহত্যাসহ অপমৃত্যুর মামলা বৃদ্ধির প্রবণতা রোধে মানুষকে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। সন্তানকে বোঝাতে হবে অধিকার এবং দায়িত্ব একে অপরের পরিপূরক। শুধু তার অধিকার পেলেই হবে না, তারও কিছু দায়দায়িত্ব আছে। কারণ, আমরা শুধু সন্তানকে চাওয়া শেখাই, সন্তানের যে মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব আছে, সেটি বুঝতে শেখাই না। তাই আমাদের অভিভাবকদেরও দায়দায়িত্ব নতুন করে শেখার বিষয় আছে। এই দায়িত্ব নিজেরা শিখতে পারলে সন্তানদের আত্মহত্যার মতো ভয়ানক অপরাধ প্রবণতা কমানো সম্ভব। এতে অপমৃত্যুর ঘটনাও কমে আসবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মা-বাবাকে হত্যা করে ঘরে পুঁতে রাখল জুয়ায় আসক্ত ছেলে

বৃহত্তর মিরপুরে সম্মিলিত খতমে নবুওয়ত ওলামা সম্মেলন অনুষ্ঠিত

দেশ বাঁচাতে হলে বিএনপির বিকল্প নেই : টুকু

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা / বস্তিবাসী ও শহীদ পরিবারের ন্যায্য দাবি মেনে নিন

মা-মেয়েকে গলা কেটে হত্যা

রাজধানীতে ১৭ ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জাগপা ছাত্রলীগের বৈঠক

হাত-মুখ বেঁধে শিশুকে ধর্ষণ, যুবককে খুঁজছে পুলিশ

এনসিটিবির নামে ‘নকল’ ছাপাখানা, আটক ৫ 

পচা চাল ক্রয়, বাচ্চু মিয়াকে বাধ্যতামূলক অবসর

শহিদুল আলমসহ নৌবহর থেকে আটক ব্যক্তিদের কারাগারে বন্দি

১০

পা হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন আইসক্রিম বিক্রেতা রফিকুল

১১

গুণগত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা তারেক রহমানের অঙ্গীকার : সাঈদ

১২

চাকসু নির্বাচনের প্রচারে এগিয়ে ছাত্রদলের প্যানেল

১৩

জনপ্রশাসনের এপিডি এরফানুল হককে বদলি

১৪

কর্ণফুলীর তীরে নতুন আশা

১৫

চাকসু নির্বাচনে আরও তিন প্যানেলের ইশতেহার ঘোষণা

১৬

সিলেট বিমানবন্দরে বিদ্যুৎস্পর্শে যুবকের মৃত্যু, থানায় মামলা

১৭

বৃষ্টি আর কতদিন থাকবে, জানাল আবহাওয়া অফিস

১৮

আগে টাইফয়েড টিকা গ্রহণকারীরা কি আবার নিতে পারবে?

১৯

বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামছেন সাবেক মেয়র আরিফ

২০
X